প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
ভিশন (রূপকল্প) এবং মিশন (অভিলক্ষ্য)- শব্দ দুটি আলাদা হলেও একটি আরেকটির পরিপূরক। ভিশন হলো চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য ছোট ছোট স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হলো মিশন। একটা মিশনকে একটা প্রকল্প মনে করা যায়। আর ভিশন হলো অনেক প্রকল্প ধরে এক চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছানো। অর্থাৎ ভিশন হচ্ছে ‘ভবিষ্যৎ’, মিশন হচ্ছে ‘বর্তমান’। মিশন শব্দটি বলতে বোঝায় উদ্দেশ্য। আর ভিশন বলতে বোঝায় ‘সেন্স অব ডায়রেকশন’।
যেখানে উল্লেখ থাকবে ভবিষ্যতে আপনার বা দেশের কি অবস্থান হতে চলেছে, তা। অর্থাৎ দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। যেমন- বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ছিল ২০২১ সাল নাগাদ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা। সেই ভিশন অর্জনের জন্য বছরের পর বছর ধরে নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একেক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে মিশন হিসাবে চিন্তা করা যায়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১-এর সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সরকার এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অত্যাধুনিক পাওয়ার গ্রিড, গ্রিন ইকোনমি, দক্ষতা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং, গ্রামনগর ও ভূমি উন্নয়নের ডিজিটাইজেশন চলছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল কথা হচ্ছে সবক্ষেত্রে অটোমেশন। মানুষ ব্যস্ততার জন্য যা করতে পারে না, তাই যন্ত্রের সাহায্যে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অথবা প্রোগ্রাম সেট করে দেওয়ার মাধ্যমে সুচারুরূপে সম্পন্ন করাই হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গোড়ার কথা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের যাপিত জীবনকে অনেক সহজ করে দেবে। তবে এর সুফল পেতে হলে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ হতে হবে।
আর এই কাজটিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে আজকের প্রজন্ম, প্রযুক্তির সহায়তায় যারা হবে স্মার্ট সিটিজেন। স্মার্ট সিটিজেনের দক্ষ হাতিয়ার হচ্ছে আজকের ছাত্রসমাজ, যাদের ভিশন বা কল্পনাশক্তির চেয়েও অসীম হবে আগামীর বাংলাদেশ। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং ফিউচার বাংলাদেশের ধারণাটি সকলের কাছে সহজে তুলে ধরার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে গণমাধ্যম, যেমনটি করেছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির ক্ষেত্রে।
স্মার্ট এডুকেশনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই মানের লেখাপড়া, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং ভর্তি থেকে শুরু করে সকল কার্যকলাপ হবে স্মার্টলি অনলাইনে। প্রতিষ্ঠান তার মানে ও গুণে এক থাকবে। ফলে, শিক্ষার্থীরা যার যার এলাকায় লেখাপড়া করবে, গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে বিদেশে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করবে না। একটি নির্দিষ্ট আইডি দিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হবে, যা শিক্ষার শেষ জীবন পর্যন্ত চলবে। অন্য সকল নাগরিকের জন্যও জন্মের পর থেকেই একটি সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার দেওয়া হবে, যা চলবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সিকিউরিটি নাম্বার দিয়েই তার চাকরি, পেনশন, আয়-ব্যয়ের সকল হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ হবে। ফলে, এমন একটি নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য ডাটাবেজ প্রস্তুত করতে হবে, যা হবে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান ভিত্তি।
এক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশের সব বিষয়ের নির্ভুল ডাটাবেস তৈরি করতেই লেগে যাবে প্রায় ১০ বছর, তাও যদি থাকে পর্যাপ্ত দক্ষ লোকবল। এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এটি করতে হবে নিখুঁতভাবে, সবার আগে। নির্ভুল ডাটাবেস নিশ্চিত না করায় ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন কি অবস্থায় আছে তা আমরা কিছুটা টের পাচ্ছি। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর অভাবে অপতথ্যপ্রচার, মানিলন্ডারিং ইত্যাদি ঘটছে হরহামেশাই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এমনটি যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্ভুল এবং পরিপূর্ণ ডাটাবেস নির্মাণের পর কমপক্ষে পাঁচ বছর লেগে যাবে প্রয়োজনীয় সব ইন্টিগ্রেটেড এবং কমপ্রিহেনসিভ সফটওয়্যার তৈরি করতে।
অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে, ডাটাবেস তৈরি এবং সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ পাশাপাশি চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সেটা করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, ডাটাবেসের ধরনের ওপর ভিত্তি করেই মানসম্পন্ন সফটওয়্যার নির্মাণ করা হয়। এরপর সেই সফটওয়্যারের ভুল সংশোধন, প্রয়োগ এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এর পরিপূর্ণতা দিতে গেলে আরও পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যাবে। এসব হিসাব মাথায় রেখেই ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা করতে হবে।
কেমন হবে আগামীর সেই স্মার্ট বাংলাদেশ এবং কারা থাকবে এর নেতৃত্বে, সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ এই নয় যে, স্মার্টফোন হাতে স্মার্টলি ঘুরে বেড়ানো বা সব সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা খুশি তাই মন্তব্য করা। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ দেশের যে অঞ্চলেই বসবাস করুক না কেন, সে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে সমতার ভিত্তিতে। তখন শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে জীবনযাপন এবং সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য থাকবে না। ঢাকা শহরের নাগরিক যেমন ঘরে বসেই সব করতে পারবে, তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও তাই করতে পারবে। যেমন- প্রত্যন্ত গ্রামের একজন নাগরিককে তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কোনো অবস্থায়ই অন্য কারও দ্বারস্থ হতে হবে না।
সে তার গ্রামে বসেই আবেদন করবে, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আবেদনকারীর নতুন পাসপোর্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে তার কাছে পৌঁছে যাবে। একইভাবে ভূমির ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা, পণ্যের সরবরাহ, চাহিদা ও লেনদেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, বাস-গাড়ি-ট্রেনের টিকেট শতভাগ অনলাইনে চলে আসা ইত্যাদি।
আয়কর রিটার্ন দাখিলব্যবস্থা এমন হবে যে, মানুষ তার এলাকায় বসে নিজেই রিটার্ন জমা দেবে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যায়িত হয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমেই অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ করদাতার কাছে পৌঁছে যাবে। আয়কর কর্মকর্তার তেমন কোনো ভূমিকা থাকবে না। স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তারা জানতে পারবে কারা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে কিংবা দেয়নি। এসব প্রযুক্তিগত সুবিধার ফলে তখন একেবারে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কোনো নাগরিক যখন ইচ্ছা তখনই যেকোন আমলা, মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে নিমিষেই।
কিন্তু আগামীর বাংলাদেশের জন্য এরকম একটি পরিবেশ তৈরি করতে কিংবা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকবেন, তাদের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং মুনশিয়ানার ওপরই নির্ভর করবে ২০৪১ সাল নাগাদ সত্যিকারের একটি স্মার্ট বাংলাদেশ হবে, নাকি হবে না। এভাবে সর্বক্ষেত্রে আজকের কল্পনাকে নিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের দিকে এবং রূপায়ণ করতে হবে আগামীর বাংলাদেশ। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন সর্বত্র থাকবে প্রযুক্তির সঙ্গে আধুনিক চিন্তার সখ্য।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।