প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
গবেষণায় দেখা গেছে, যদি আপনি প্রতিদিন একটি ভালো মানের বইয়ের পেছনে অন্তত ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করেন, তাহলে সেই বইটি আপনার জীবনে কয়েক বছর আয়ু বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। ৫০ বছর বয়স্ক ৩ হাজার ৬৩৫ জন মানুষের ওপর প্রায় ১২ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালান লিয়েন ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ। তারা ঐ সব মানুষকে তিনটি দলে ভাগ করেন। প্রথম দল, যারা একেবারেই বই পড়ে না। দ্বিতীয় দলটি সপ্তাহে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বই পড়ে। আর তৃতীয় দলটি সপ্তাহে সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় বই পড়ে। ফলাফলটা বেশ চমকপ্রদ। বইবিমুখ মানুষের চেয়ে বইপড়ুয়া মানুষ প্রায় দুই বছর বেশি বাঁচতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয়—এই তিনটি পরিবর্তনশীল সূচকের ভিত্তিতে ঐ গবেষণায় দেখা যায়, সপ্তাহে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি বই পড়া দলটির মৃত্যুঝুঁকি বইবিমুখ দলের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম ছিল। আর সাড়ে তিন ঘণ্টার কম সময় বইপড়া দলটির মৃত্যুঝুঁকি বইবিমুখ দলের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম ছিল। অর্থাৎ বইপ্রেমীদের মারা যাওয়ার আশঙ্কা অন্য দলের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড মেডিক্যাল জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। লিয়েন ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ গবেষণার মাধ্যমে দেখতে চেয়েছিলেন যে, কীভাবে বই ও ম্যাগাজিন পড়া মানুষের জীবনচক্রের ওপর প্রভাব ফেলে। তারা জানান, বই পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মস্তিষ্কে জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি আরেকটি গবেষণা বলছে, উপন্যাস পড়লে মস্তিষ্কের সংযোগ সামর্থ্য ও সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় এবং সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করে। বিশ্ব সংস্কৃতি বলছে, সবচেয়ে বেশি পড়ার অভ্যাস রয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড এবং চীন দেশে। শীর্ষ বই পড়ুয়া জাতির তালিকায় টানা দুই বছর ধরে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের মানুষ সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট ব্যয় করেছে বইপড়ার পেছনে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ওখানে সাক্ষরতার হার কম হলেও যারা মোটামুটি শিক্ষিত, তারা পড়ার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। চীনের মানুষ বই পড়েছে সপ্তাহে আট ঘণ্টা। তালিকার পেছনের সারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। মার্কিনিরা সপ্তাহে গড়ে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা ৪২ মিনিট বই পড়ে।
বইপড়া বা জ্ঞানার্জনের সঙ্গে মানবিক গুণাবলির বিকাশ, গবেষণার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি, নেতৃত্ব ও ব্যবসাক্ষেত্রে সফলতার নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্ব প্রযুক্তির রাজধানী খ্যাত সিলিকন ভ্যালির তিন ভাগের এক ভাগ প্রকৌশলী ভারতীয়। গুগল, অ্যাডোবি, মাইক্রোসফট, আইবিএম, টুইটারের মতো স্বনামধন্য কোম্পানির সিইও ভারতীয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ কোম্পানির সিইওর আসন অলংকৃত করে রেখেছে ভারতীয়রা। প্রতি বছর ব্যবসাক্ষেত্রে চরম সফল ৫০০ কোম্পানির তালিকা তৈরি করে ফরচুন ম্যাগাজিন। ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির ৩০ শতাংশ সিইও হলো ভারতীয়। সম্প্রতি সবচেয়ে কম খরচে ভারত সফলতার সঙ্গে চাঁদে রকেট উেক্ষপণ করেছে।
চীনের একটি ভাস্কর্যের কথা বলছি। ভাস্কর্যটিতে একটি ব্যালেন্সের এক পাশে হালকা গড়নের এক জন তরুণ অনেক বই সঙ্গে নিয়ে বসে আছে। অন্য পাশে এক জন স্থূলকায় ব্যক্তি একটি বই হাতে বসে আছে। ব্যালান্সটি কিন্তু অল্প বয়সি ছেলেটির দিকে হেলে পড়েছে। নিচের ক্যাপশনে লেখা ‘তোমার ওজন কিলোগ্রাম অথবা আকারের ওপর নির্ভর করে না। বরং তা নির্ভর করে তুমি কতগুলো বই পড়েছ তার ওপর’। চীনারা জাতিগতভাবে এই কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। সেজন্যই হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে তারা জ্ঞানভিত্তিক উপনিবেশ তৈরি করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধমনি ও হূিপ- খ্যাত গণিত ও প্রোগ্রামিং পারদর্শিতায় চীনারা এখন বিশ্বসেরা। ফলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্রে চীনাদের অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে শিল্প পণ্যের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে চীন।
বিস্ময়ের বিষয়টি হলো বাংলাদেশের নাম নেই পড়ুয়া জাতির ঐ লিস্টটিতে। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ তুলনামূলক কম বই পড়ে। কিন্তু সেই কম আসলে কতটা, তা জানার কৌতূহল মেটাতেই ইন্টারনেটে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করলাম; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত তথ্য মিলল না। এর প্রথম কারণ হতে পারে বাঙালির পাঠাভ্যাস নিয়ে তেমন কোনো জরিপ বা গবেষণা হয়নি। আর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে পড়ুয়া জাতির তথ্যভাণ্ডারে নিজেদের কীভাবে সংযুক্ত করতে হয় বা এর জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়, তা আমরা জানি না। কারণ যাই হোক না কেন, আমাদের পাঠাভ্যাস নিরূপণের বিষয়টি জাতির সত্যিকার সমৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক।
বিদেশে অধ্যয়নকালে বইপ্রেমী একটি জাতিকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ট্রেনে কারো হাতে বই থাকতে পারে কিন্তু লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে কেউ পড়ে? মেট্রোরেলে? হ্যাঁ ঐ দেশটিতে পড়ে। এমন এক জন-দুই জন নয়, শত শত। কী বই তারা পড়ে? শুধুই কি গল্প-উপন্যাস? না। কেউ খেলাধুলা, কেউ ফ্যাশনের, কেউ জাদুর, কেউ বিজ্ঞানের, কেউ গণিতের জটিল সমস্যা সমাধানের, কেউ দর্শনের, কেউ জীবনযাপন প্রণালির, কেউ পড়ে চিরায়ত বই। কর্মজীবীরা নিজের কাজে আরো পারদর্শী হওয়ার জন্য, উন্নতি করার জন্য বই পড়ে। আমরা কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়লে ভাবী, পড়া শেষ! আর বইপ্রেমী জাতি ভাবে নতুন ক্ষেত্রে পড়া শুরু। আমাদের সংস্কৃতিতে কিছু বইকে ‘পাঠ্যবই’ নাম দিয়ে প্রকারান্তে অন্য বইগুলোকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। আবার স্কুল-কলেজে সৃজনশীল প্রশ্নের কারণে পাঠ্যবই তার গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ পরীক্ষার বৈতরণী পার হতে গাইড বই-ই মূল ভরসা। ফলে গাইড বইয়ের ভিড়ে পাঠ্যবইয়ের জীবনপ্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলছে। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির যুগে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের হতে হবে জ্ঞানান্বেষণে বদ্ধপরিকর, প্রকৃত বইপ্রেমী।
বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। ভারত ও চীনের মতো বাংলাদেশের পাঠাভ্যাসের প্রকৃত চিত্র আমাদের সামনে দৃশ্যমান হলে জাতির সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করা সহজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। এতে সমৃদ্ধ হবে জাতি, এগিয়ে যাবে দেশ।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।