প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আলো, বাতাস ও পানির প্রয়োজন। জীবকে বাঁচিয়ে রাখতে খাদ্যের প্রয়োজন। আর অন্তরকে বাঁচিয়ে রাখতে পড়াশোনার প্রয়োজন। অন্তরকে সজীব ও প্রসারিত রাখার মাধ্যম হলো শিক্ষা।
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মিলিয়নেয়ার ও বিলিয়নেয়ার ৮৫ শতাংশ প্রথম প্রজন্মের। শুধু ১৫ শতাংশ উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী। প্রথম প্রজন্মের ধনীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এত অল্প সময়ে কিভাবে আপনারা আর্থিক সফলতা অর্জন করেছেন। তাঁরা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা বই পড়ি’।
ওয়ারেন বাফেট দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা পড়েন। বিল গেটস একজন ভালো পাঠক। বই পড়া আত্মোন্নয়ন ঘটায়। আলোকিত মন জীবনধারণের জন্য যেকোনো ইতিবাচক সৃজনশীল কর্ম খুঁজে নিতে পারে। তাই ইতিবাচক ভাবনা মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। যার প্রকৃত উৎস পাঠাভ্যাস।
শিক্ষার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো নিজে পড়ে অনুধাবন করার ক্ষমতা। কিন্তু স্কুল-কলেজে এমন একটি পরিবেশ বিরাজ করছে যে নিজে পড়ে বোঝার চেষ্টা যেন মহা বিড়ম্বনা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বইগুলো নিজে পড়ে বোঝার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
আবার শিক্ষকরাও পাঠদান ও পঠনের মধ্যে একটি শৈল্পিক দেয়াল তুলে রাখেন, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়। প্রাইভেট পড়ার কারণে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে শিক্ষক বোঝালে ছাত্র বোঝে, না বোঝালে নিজে পড়ে বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। শ্রেণিকক্ষে সিলেবাস অনুসরণ করে পাঠদান হয় না বললেই চলে।
হাল আমলে আউটকাম বেইসড এডুকেশনের কথা সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে, তবে শুধু আউটকাম বেইসড এডুকেশন (ওবিই) নয়, দরকার আউটকাম বেইসড ম্যান (ওবিএম)। যাদের যোগ্যতা হবে দক্ষতা, সততা ও কৃতজ্ঞতা। এখনো এ দেশ থেকে প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যায় পার্শ্ববর্তী দেশে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাকরির বাজারে দক্ষ মানুষের অপ্রতুলতার প্রকৃষ্ট নির্ণায়ক। অথচ আমাদের শিক্ষিত মানুষ বেকার। যত দিন না ‘স্টেম’ শিক্ষা (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথমেটিক্স) আমাদের ধ্যান, জ্ঞান ও অধ্যবসায়ে পরিণত হবে, তত দিন আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে পিছিয়ে থাকব।
প্রায় সর্বত্র কর্মসম্পাদনে এক ধরনের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। একটি লিমিটেড কম্পানিতে সেখানকার স্টোরে রক্ষিত ওষুধের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার সরকারি ওষুধ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। বিষয়টি যে কর্মকর্তা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেছেন তাঁর ওপর প্রতিষ্ঠানটির স্টোরকিপার বেশ চড়াও হন এই মর্মে যে কেন বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। একই কম্পানিতে একজন কর্মচারী সাত দিন অফিসে আসছেন না, ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় তাঁর হাজিরা খাতায় লাল কালি দিয়ে অনুপস্থিতির বিষয়টি চিহ্নিত করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেও ক্ষোভ দেখানো- এ যেন মগের মুল্লুক। অথচ স্বাধীন দেশ উপহার দিতে ৫৫ বছরের জীবনের ১৩ বছরের মতো সময় জেলে কাটিয়েছেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর উক্তি ‘যার ওপর যে দায়িত্ব সে সেটা করলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না।’ বাস্তবিক অর্থে দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভর করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন।
চাকরিটা যদি দায়িত্ব পালনের পবিত্র ক্ষেত্র না হয়ে সাইনবোর্ড হয়, তাহলে অবশ্যই সেখানে সার্বিক অগ্রগতি পেছাবে দ্রুত হারে।
কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি স্থাপনা তৈরির সময় যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে, তা হলো কোনো রকমে স্থাপনা তৈরি করে বুঝিয়ে দিতে পারলেই হলো। একটি খবরে দেখলাম, ব্রিজে সিমেন্টের তৈরি স্লাব বা পাটাতনের মধ্যে রড না ব্যবহার করে সুপারির চটা ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওই একই ব্যক্তি যখন নিজের বাড়ি তৈরি করবেন তখন বিবেচনায় রাখবেন ওই বাড়ির স্থায়িত্বকাল যেন ১০০ বছরের বেশি হয়। সাত রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পেও যেন বাড়িটি অক্ষত থাকে।
চিন্তার এই ফারাক কেন? একবার ভাবুন তো আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ তার সঞ্জীবনী শক্তি গ্রহণ করেছে এই দেশের মাটি, পানি, বাতাস ও আলো থেকে। এভাবে ভাবলে দেশকে পর ভাবার কোনো সুযোগ আছে কি?
ড. মোঃ নাছিম আখতার : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।