বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

রাজনীতির কবি কবির রাজনীতি শেখ মুজিবুর রহমান
সরকার আবদুল মান্নান

বাঙালি জাতির ইতিহাসে রাজনীতির যে মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছর ধরে পরাধীন একটি জাতিকে স্বাধীনতার দীক্ষায় যিনি জাগ্রত করে তুলেছিলেন এবং পরিশেষে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তাই এ যাবৎকাল বাঙালি জাতির যে মহিমামণ্ডিত ইতিহাস রচিত হয়েছে, সেই ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হয়ে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোয় বঙ্গবন্ধুর আরেক সত্তার পরিচয় জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছে, আর তা হলো- তিনি শক্তিমান একজন লেখক। তার জীবদ্দশায় কেউ যদি তাকে লেখক বলে সম্বোধন করতেন, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি বিস্মিত হতেন এবং কৌতূহলাবিষ্ট হতেন। কারণ তিনি নিজেও জানতেন না যে, তার লেখকসত্তা কতটা শক্তিমান। বন্দিদশার নিঃসঙ্গ দিনগুলোয় তিনি নিরন্তরভাবে লিখে গেছেন এবং বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর রাজনীতির মঞ্চে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে, হাট-বাজারে, রাস্তাঘাট চষে বেড়িয়েছেন নিরন্তরভাবে। সেই দুর্বিনীত দিনগুলোয় তার কোনো ক্লান্তি ছিল না, বিশ্রাম ছিল না, বিনোদন ছিল না। এ সবকিছু উৎসর্গ করে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য। তাই জেলখানায় বসে তিনি কী লিখেছেন, না লিখেছেন, তার কথা ভাবার সুযোগ তিনি পাননি। তাই তার নিজের কাছেই নিজের লেখকসত্তা হারিয়ে গিয়েছিল। জেলখানার বাইরে এসে তিনি আর তা মনে করতে চাননি, মনে করার ফুরসতও তার ছিল না।

তার পর অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবার-পরিজন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহকর্মীসহ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকেসহ পরিবার-পরিজনদের। কিন্তু প্রাণাধিক প্রিয় পিতার অপ্রকাশিত সেই সাহিত্যকর্ম খুঁজে খুঁজে বের করে আলোর মুখ দেখিয়েছেন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তার সেই নিরন্তর চেষ্টার কথা, শ্রমের কথা ও আত্মনিষ্ঠার কথা লেখা আছে শেখ মুজিবের লেখা গ্রন্থ তিনটির ভূমিকায়। আজ আমরা জেনে গেছি, বঙ্গবন্ধু বাঙালির রাজনৈতিক মহাকাব্যের মহানায়কই নন শুধু, তিনি অসামান্য একজন লেখক। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তিনটি গ্রন্থ। প্রথমটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দ্বিতীয়টি কারাগারের রোজনামচা এবং এবং তৃতীয়টি আমার দেখা নয়চীন। তিনটি গ্রন্থের মধ্যে বিষয়, ভাষা ও উপস্থাপনগত বিপুল বৈচিত্র্য রয়েছে। কিন্তু একটি সহজ মিলও আছে। আর তা হলো, তিনটি গ্রন্থই এক ধরনের অভিজ্ঞতার বয়ান- স্মৃতিগদ্য। কিন্তু সহজাত এক সৃষ্টিপ্রতিভার তাড়নায় বিষয়ের পটভূমিতে গ্রন্থ তিনটির ভাষাগত সৌকর্য, উপস্থাপন কৌশল ও চিন্তার গড়ন বেশ আলাদা।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী সত্যিকার অর্থে জীবনী কিনা, তা নিয়ে গবেষণার অবকাশ আছে। কেননা এই গ্রন্থটিতে শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ওপর তেমন কোনো আলো ফেলেননি বললেই চলে। তিনি আলো ফেলেছেন তার সময়ের রাজনীতির ওপর, সমাজের ওপর, অপরাপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ওপর এবং তার রাজনৈতিক যাত্রাপথ যত বাঁক ও মোড় নিয়েছে, সেসব পথের ওপর তিনি মনোনিবেশ করেছেন। নিজেকে প্রধান করে তোলার, মুখ্য করে তোলার, আলোচ্য করে তোলার কোনো প্রবণতাই এই গ্রন্থটিতে লক্ষ করা যায় না। আমরা সাধারণত আত্মজীবনীর কিছু সাধারণ প্রবণতা লক্ষ করি। আর তা হলো, লেখক বারবার নিজের ওপর আলো ফেলেন, নিজের পরিবার-পরিজনের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন এবং এর সঙ্গে অন্য জীবন ও চরিত্র চলে আসে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এই কাজটি করেননি। তিনি নিজেকে গ্রন্থটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে গড়ে তোলেননি। অধিকন্তু যে রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি দোর্দ- প্রতাপে অবস্থান করেছেন, সেই মঞ্চের আর দশজনের মতো তিনিও নিজেকে একজন সাধারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। ফলে পুরো গ্রন্থটির মধ্যে এক ধরনের নির্মোহতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও সহজাত নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনা আছে, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, কিন্তু ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. কর্তৃক ২০১২ সালে প্রকাশের পর থেকে আজ প্রায় এক দশক অতিবাহিত হওয়ার পরও এই গ্রন্থটির কোনো ঘটনা, কোনো ব্যক্তি, কোনো তথ্য ও তত্ত্ব, কোনো স্থান বা কালের অসঙ্গতি নিয়ে বা অসত্যতা নিয়ে কিংবা অবাস্তবতা নিয়ে কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া, আলোচনা-সমালোচনা লক্ষ করা যায়নি। অধিকন্তু দেশে এবং দেশের বাইরে গ্রন্থটি যারাই পাঠ করেছেন, তারা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ঐশ্বরিক কোনো স্মৃতিশক্তি না থাকলে এতটা নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে এবং এতটা সাবলীলভাবে একটি জটিল রাজনৈতিক পটভূমিকে উপস্থাপন করা একেবারেই অসম্ভব। শুধু তাণ্ডই নয়, গ্রন্থটির ভাষিক জগৎ, উপস্থাপন কৌশল, ঘটনার বিন্যাস ও পারস্পর্য, চরিত্র উপস্থাপনে নির্মোহতা ও মাত্রাবোধ নিয়ে প্রায় সবাই প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে এই গ্রন্থে অতিকথনের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। বাড়িয়ে বলা বা কমিয়ে বলা, কাউকে ছোট করা বা বড় করা, কোনো কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা কিংবা কোনো সামান্য ঘটনাকে অসামান্য করে তোলার কোনো প্রবণতাই গ্রন্থটিতে নেই। ফলে ইতোমধ্যেই অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমির একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

অন্যদিকে কারাগারের রোজনামচা নামক গ্রন্থটি ভিন্ন এক স্বাদে ভিন্ন এক মাত্রায় অনন্য হয়ে উঠেছে। তারিখ দিয়ে দিয়ে লেখা এই গ্রন্থটির মধ্যে একটি সময়ের পটভূমি খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা নামের গ্রন্থ দুটির মধ্যে ঘটনাগত যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। তবে একটি গ্রন্থ কিছুতেই অন্যটির পরিপূরক নয়। কী ভাষা উপস্থাপনে, কী ঘটনার বিবরণে অন্য কোনো সাহিত্যিক মানদ-ে গ্রন্থ দুটির মধ্যে সমন্বয় নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। একজন লেখকের কলমে বিষয়ের ভিন্নতার পটভূমিতে কী করে সম্পূর্ণ আলাদা, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি স্বাদের গ্রন্থ রচিত হতে পারে, তা বিস্ময়কর।

ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে আমার দেখা নয়চীন গ্রন্থটিতে। এই গ্রন্থটি ভ্রমণআখ্যান। ১৯৫২ সালে ১২ দিনের জন্য তিনি নয়াচীনে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তিনি চীনের কোনো দর্শনীয় স্থান পর্যবেক্ষণ করতে যাননি কিংবা কেনাকাটা করার জন্য শপিংমলগুলোয় ঘুরে বেড়াননি। অধিকন্তু নয়াচীনের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি ২৫ দিন নয়াচীনে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি চীনের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন, তাদের কাছ থেকে চীনের বিচিত্র বিষয় জানতে চান। আর তিনি দেখতে চেয়েছেন, ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় এসে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এতটা দ্রুততার সঙ্গে কী করে একটি বিপর্যস্ত দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। কী করে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনছেন, দুর্নীতি-অন্যায়-অপরাধ নির্মূল করছেন; শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করছেন, সামাজিক সংক্ষুব্ধতা নিরসন করছেন, তার ব্যাকরণ খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর তারই পটভূমিতে রচিত হয়েছে আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থটি।

সহজাত সৃষ্টিপ্রতিভা সবার থাকে না। এ এক প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ। ভেতরে সৃষ্টির তাড়না প্রবল না হলে কোনো কিছুই রচিত হয় না। জীবনে চলার পথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা অনেক কিছুই করি। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে সৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দ্বারা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু তার মধ্যে ছিল সৃষ্টিশীলতার সেই পরম শক্তি, যার প্রেরণায় কলম না ধরে পারেননি তিনি। তিনি কলম ধরেছেন এবং একের পর এক রচনা করে গেছেন অসাধারণ কিছু গ্রন্থ। বাঙালি জাতির একটি ক্রান্তিকালের স্থান-কাল ও সময়ের পটভূমি সাহিত্যের ভাষায় বোঝার জন্য গ্রন্থ তিনটি অপরিহার্য।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়