প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
আমি দুঃখকে সুখ ভেবে বইতে পারি/যদি তুমি পাশে থাকো/আমি সব কিছু হাসিমুখে সইতে পারি/যদি তুমি পাশে থাকো/একটু বাতাস যদি হয়ে যায় ঝড়/সে ঝড়ে ভেঙ্গে যদি যায় বাঁধা ঘর/আবার নতুন ঘর বাঁধতে পারি/যদি তুমি পাশে থাকো। গীতিকারের লেখা আর শিল্পীর কণ্ঠে গাওয়া গানের মতই আমাদের জীবন।
পাঠক বলছিলাম, আমার স্বপ্নে দেখা এক মানুষের কথা। যিনি সাধারণের মতই, তবে অন্যান্য মানুষের তুলনায় অতি সাধারণ। যিনি একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন, শিক্ষা-কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তিনি হলেন প্রিয় খায়রুল আলম টুটুল চৌধুরী ভাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
১৯৯০ সাল থেকে প্রিয় টুটুল চৌধুরীকে আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শিল্পী হিসাবে দেখেছি। তার অভিনয় দেখে ভক্ত হয়েছি। আগের যুগে টেলিভিশন কিংবা সিনেমার পর্দায় যাদের দেখতাম তাদের আমরা যারা সাধারণ মানুষ রয়েছি তারা ভাবতাম অভিনয় শিল্পীরা ভিন্ন জগতের। তাদের ধরে দেখার বা কাছে যাওয়ার খুব আগ্রহ থাকতো। অভিনয়শিল্পীদের রাস্তায় বা কোথাও দেখলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো একটু দেখার জন্য। আবার অনেকেই একটা অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগতো, সেই অটোগ্রাফ বাসায় নিয়ে যত্ন করে রেখে দিতো। তখনকার সময়ে হাতে হাতে ক্যামেরা মোবাইল ছিলো না। হাতেগোনা সংবাদকর্মী আর সাধারণ মানুষের হাতে ছিলো না ক্যামেরা, ক্যামেরা যারাই ব্যবহার করেছে তারা কোডাক, ফুজি ফিল্ম ব্যবহার করতেন। সেই ছবি ল্যাবে গিয়ে লাইন ধরে বের করতেন। বাসায় এনে ঘরে বেড়া বা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। আবার অনেকেই প্লাস্টিকের অ্যালবাম কিনে সেখানে রাখতেন। কেউ এলেই দেখাতেন।
বলছিলাম, টুটুল চৌধুরী ভাইয়ের কথা। যাকে দেখার জন্য খুব আগ্রহ ছিলো দেখতে পাইনি, তবে মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা স্বপ্নের হাল ছাড়িনি। একজন ক্ষুদ্র নাট্যকর্মী হিসেবে দেশের মধ্যে বহু নাটকে কাজ করেছি, ১৯৯৬ সালে নিজ জেলা চাঁদপুর শাহরাস্তি অপরূপা নাট্যগোষ্ঠী যুব ও মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন নামে একটা নাট্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। তার কারণ ছিলো তখন এই শাহরাস্তি উপজেলায় ব্যাপকভাবে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথাসহ নানাবিধ সমস্যা ছিলো। কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো না, কাজীর কিতাবের মতো উপজেলা পরিষদের এককোণায় শিশু একাডেমির নাম সাইনবোর্ড থাকলেও সেখানে শিশু ছিলো না চর্চাও নেই। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে বসে মঞ্চনাটকের রিহার্সাল করার জন্য উপজেলা পরিষদের অডিটোরিয়াম বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার সপ্তাহে ২ দিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম, সংগঠন করতে টাকা লাগে, অনেক ধারদেনা করেছি, একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য যে বরাদ্দ পেতাম তা দিয়ে হতো না, এ নিয়ে পরিবারের অনেক বকা শুনেছি। থাক সেসব কথা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সৌদি আরব চলে এসেছি একটু স্বাবলম্বী হওয়ার আশায়। কাজের ফাঁকে একাকী লাগছে জীবন। তখন একটু সুস্থধারার বিনোদন খুঁজে পাচ্ছি না। বেশ কিছু দিন প্রবাসের সামাজিক নানা আয়োজনে যেতাম সংবাদকর্মী হিসাবেই। সেই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বলে অভিনয় বা কৌতুক করতাম, এমনিই চলছে জীবন।
২০১৪ সালে ৫ সেপ্টেম্বর আমার মতই কয়েকজন সাংস্কৃতিক ভাইদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলাম রিয়াদ বাংলাদেশ থিয়েটার, প্রবাসের মাটিতে দেশীয় সাংস্কৃতিক চর্চা হবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে, আজও চলছে। বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। পেয়েছে দর্শকপ্রিয়তা। বলছিলাম টুটুল চৌধুরী ভাইয়ের কথা অবশেষে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে খুঁজে পেলাম উনাকে, ভক্ত হিসাবে রিয়াদ বাংলাদেশ থিয়েটার এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে একটা ভিডিও শুভেচ্ছা চেয়েছিলাম, তিনি পাঠিয়েছেন। শুরু বন্ধুত্ব, ২০২৩ সালে দেশে ছুটিতে গেলাম, টুটুল চৌধুরী ভাইকে দেখার বাসনা রয়েছে মনে, দেখা করতে চাইলাম স্কুল টুয়েন্টি জুম লাইভে, তিনি তারিখ দিলেন ০৯ জুলাই সকাল ১০ টায় ঢাকা শনির আখড়া সহজ পাঠ স্কুল ক্যাম্পাসে। যথারীতি তিনি এলেন ৯০-২৩ এর মধ্যে মনে লালিত কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন, হয়ে গেলো এক ইতিহাস । ভাই হাসিমুখে দীর্ঘসময় কথা বলেছেন, ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন সহজপাঠ স্কুল ক্যাম্পাসের করিডর, আমার সাথে ছিলো ভাতিজা পারভেজ রবিন, সেও মহাখুশি টেলিভিশন সেলিব্রিটি টুটুল চৌধুরীকে দেখা, হাতের মোবাইলে সেল্পি। ছোট ছো শিশুদের সাথে টুটুল চৌধুরীর ভালোবাসা তা দেখেই অবাক। বাংলাদেশের সরকারি - বেসরকারি বহু স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক চলছে যেমন বকুলপুর সিজন টু, ব্যাচেলর পয়েন্ট ইত্যাদি। অনেক অভিনয় শিল্পী আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখেছি, কিন্তু একজন টুটুল চৌধুরীকে দেখেছি ভিন্ন ভাবে। দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে খাবার খেলাম, আমার লেখা কিছু বই স্কুল পাঠাগারে এবং টুটুল ভাইয়ের হাতে শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে তুলে দিলাম। তিনিও তার সহজপাঠ স্কুলের পক্ষ থেকে উপহার দিলেন। এসময় হঠাৎ করে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক, অভিনেতা এইচ আর অনিক ভাই, মাসুদ হাওলাদার, এম জেড রবিনের সঙ্গে। উনাদের ক্ষণিকের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তার কাছে আমি ঋণী। অচেনা, অদেখা একজন মানুষকে আপন করা নিতে সবাই পারেনা। ক্ষণিকের জীবনে এমন স্মৃতিগুলো থেকে যাবে আর কিছুই নয়। ৯ জুলাই বিদায় নিলাম ১০ জুলাই ডিরেক্টরস গিল্ডের ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে টুটুল চৌধুরী, অনিক ভাইসহ সবাই যাবো সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই মুতাবেক পরের দিন অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য শনি আখড়া সহজ পাঠ স্কুলে গেলাম, খুঁজে পেলাম অনিক ভাই, রবিন, মাসুদ ভাইকে। সেখানেই গিয়ে শুনি আকাশে কালো মেঘের ছায়া সহজ পাঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অভিনেতা টুটুল চৌধুরী ভাইয়ের বোন পারভিন আপা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে মারা গেছেন, সকলের মানসিক অবস্থা কেমন বুঝে নিন, অনন্ত হিরা ভাইদের ডিরেক্টর গিল্ডের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আর যাওয়া হয়নি। টুটুল চৌধুরী ভাইকে সান্ত¡না দিতেই রয়ে গেলাম সেখানে সমবেদনা জানাতে। সেখানেই ছুটে এলেন টুটুল ভাইয়ের স্ত্রী বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি সালমা বেগম আপা। এক ফাঁকে টুটুল ভাই এর স্ত্রী ডিআইজি সালমা আপার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শোকে কাতর সবাই,স্কুলশিক্ষক, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা সেখানে ভিড় জমাতে লাগলেন। সহজ পাঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পারভিন আপাকে শেষ বিদায় জানাতে। ২০২৩ সালের ৯-১০ জুলাই আমার জন্য এক ইতিহাস। যা স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে, ভালো থাকুন সবাই দুদিনের মুসাফির হিসাবে এলাম ক্ষণিকের দুনিয়ায়। পারভিন আপাকে মহান আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন।