মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

আত্মসম্মানবোধের সংকট
অনলাইন ডেস্ক

আমার জন্মের ৫১ বছর চলছে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। আমার অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো হলেও আত্মিক উন্নতি ঠিক তেমনি তলানির দিকে এসে ঠেকার উপায়। আত্মসম্মানবোধ আজ গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যার আছে সে-ও হাত পাতে আর যার নাই সে-ও হাত পাতে। আত্মসম্মানবোধের সংকটের মধ্য দিয়ে একটি জাতি কখনো উন্নতির শিখরে অবস্থান করতে পারে না। মানুষ শুধু হাত পাততে শিখছে। দেয়ার মানসিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ মুছে ফেলার অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে। অফিস-আদালতে চলছে আত্মসম্মানবোধ সংকটের মহামারি। ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মাদক কারবার, টাকা পাচার, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, বলাৎকার, নারী ও শিশু পাচার, কালো টাকার মালিক বনে যাওয়া, ধর্মান্ধতা, আত্মসাৎ ইত্যাদি সবই হচ্ছে আত্মসম্মানবোধ সংকটের কারণে। আত্মসম্মানবোধ সংকটের প্রধান শত্রু হলো লোভ। লোভ আমাদেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। আর তা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, খুন, রাহাজানি ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারবো না।

আত্মসম্মানবোধ সংকটের মানুষ নিজের সঙ্গে শান্তিতে যেমন থাকতে না পারে তবে অন্যের সঙ্গেও শান্তিতে থাকতে পারে না। আত্মসম্মানবোধের সংকট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে বিঘœ ঘটায়। আত্মসম্মানবোধের সংকট একসময় নিজের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে। আত্মসম্মানবোধহীন মানুষ সবসময়ই মৃত। তারা কখনো জীবনের স্বাদ পায় না। তারা অবৈধভাবে আরো চাই, আরো চাই করতে থাকে। এই চাওয়া-পাওয়া, বৈধ-অবৈধ ভেদাভেদ বিচার করে না। এমনিভাবে তারা নিজেদরকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে। ভুলে যায় মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, মানবিকতা।

উন্নত আত্মসম্মানবোধ সুখী, পরিতপ্ত এবং অভীষ্ট লাভে উদ্যোগী জীবনযাপন সম্ভব করে। নিজের যথার্থ গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন না হলে আত্মসম্মানবোধ বাড়ে না। ইতিহাসের মহান বিশ্বনেতা ও আচার্যরাও এই কথাই বলেছেন যে, অন্তরের প্রেরণা ব্যতীত সফল হওয়া যায় না। উন্নত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষের বিশ্বাস, যোগ্যতা ও দায়িত্ব নেয়ার ইচ্ছাও উন্নত হয়। তারা আশাবাদী, সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখেন এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপন করেন। তাদের থাকে কর্মপ্রেরণা ও উচ্চাশা এবং তারা সংবেদনশীলও হয় অনেক বেশি। আত্মসম্মানবোধ কাজকর্মের মানকে উন্নত করে এবং ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। মানুষের ধ্যানধারণা ও তার উৎপাদনশীলতার মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ যোগ আছে। যারা নিজের প্রতি ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মাতাণ্ডপিতা, আইন-কানুন ও ধন-সম্পদকে সমীহ করেন এবং নিজের দেশকে ভালোবাসেন তারাই উন্নত আত্মসম্মানবোধের পারিবারিক শিক্ষা, সমাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আত্মসম্মানবোধ সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিশু যদি কেবল নিন্দা শুনতে শুনতে বড় হয়, তবে সে নিন্দা-মন্দ করতেই শিখবে। আবার যদি প্রশংসা শুনে বড় হয়, তবে প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে শিখবে। যদি সে বেড়ে হয়ে উঠে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তবে সে লড়াই করার শক্তি যাবে বেড়ে। আর যদি তার পরিবার হয় সহনশীল, সে-ও হয়ে উঠবে ধৈর্যশীল। শৈশব থেকে যদি কেবল উপহাসই পায় তবে সে হবে লাজুক। আর যদি ভালো কাজে পেয়ে থাকে ক্রমাগত উৎসাহ তবে তার আত্মবিশ্বাস যাবে বেড়ে এবং খারাপ কাজের জন্যে তিরষ্কার পায় বা সমালোচনার স্বীকার হয় তবে সে-ও আত্মসংযমী হয়ে উঠবে। যদি বড় হয়ে উঠে লজ্জাজনক আবহাওয়ায় তাহলে সে নিজেকে ভাববে দোষী, আর যদি পায় সকলের সমর্থন, তবে সে নিজের উপরেই আস্থা রাখতে পারবে।। শৈশবে যদি সুবিচার পায়, তবে সে ন্যায়বিচার করতে শিখবে। নিরাপত্তার মধ্যে বাস করলে, সে শিখবে বিশ্বাস করতে। শিশু যদি পায় বন্ধুত্ব ও স্বীকৃতি, তবে সে পৃথিবীতে ভালোবাসার সন্ধান করবে। শিশুদেরকে শেখাতে হবে নিজের জন্যে বা নিজ পরিবারের জন্যে হাত পাতার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, কোনো সম্মান নেই, আছে শুধু হীনমন্যতা, লজ্জা আর লজ্জা। আমরা কেবল ভাবাবেগ সম্বল করে বাঁচতে পারি না। বয়স যা-ই হোক না কেনো, আমাদের শৃঙ্খলাবোধ আনতেই হয়।

আত্মসম্মান বোধের মধ্যে দিয়ে দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করা যায়। নিজেদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তোলার শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে হবে। মানবাধিকার সম্পর্কে তারা যেনো সজাগ থাকে সে বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলা যায়, ‘মানুষই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যাকে কি না জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুনতে হয়, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। কিন্তু অন্য প্রাণীকে সেই প্রাণী হওয়ার কথা বলা হয় না।’ আত্মসম্মানই মানুষের বিচিত্র পরিচয় বহন করে। মানুষকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণীত করে মানবিকতায়।

আত্মসম্মানবোধ মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমাদের সমাজে প্রাচীন কিছু নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে, যা বাঙালিরা তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেমন সত্যবাদিতা, অহিংসা, শান্তি, ক্ষমা, অধ্যবসায়, সরলতা, জ্ঞানের তৃষ্ণা, সহনশীলতা, সহযোগিতা এবং শ্রদ্ধা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ শেখায়। আর এগুলো চর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধি পাবে এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখণ্ডসমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে।

যে জাতি বুকের রক্ত দিয়ে আমার স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, আমাকে শত্রুমুক্ত করতে পারে সেই জাতির কখনো আত্মসম্মানবোধের সংকট থাকতে পারে না। তারা কখনোই দেশের সাধারণ মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করে হাত পাতা জাতিতে পরিণত করা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। পারিবারিক শিক্ষা আত্মসম্মানবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকার কালন করে। আজকের আধুনিক বিশ্বসভ্যতার সময়ে আমাদেরকে আত্মসম্মানবোধের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পারিবারিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জাতীয় দায়বদ্ধতার শিক্ষার ব্যাপক প্রচলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের ব্যাপক প্রসার এবং জাগরণ ঘটানো সম্ভব।

মনে রাখা দরকার, আত্মসম্মানবোধ না থাকলে একটি জাতি কখনোই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ভাষা এবং ঐতিহ্যগত দিক থেকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারে না। আর একটি জাতি হিসেবে তা আমাদের কখনোই কাম্য হতে পারে না। মানবিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। যার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। দেশপ্রেমের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ নিহিত থাকে। সোনার বাংলা গড়ে তুলতে উৎকৃষ্ট আত্মসম্মানবোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়