সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২২, ০০:০০

মাদকের আগ্রাসন বন্ধে করণীয়
অনলাইন ডেস্ক

সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনায় আমরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। ১৩ এপ্রিল ২০২২ মাদক কারবারিদের গুলিতে কুমিল্লায় একজন সাংবাদিক নিহত হন। ৭ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে সংঘবদ্ধ মাদক কারবারিদের গুলিতে র‌্যাব-১১-এর এক করপোরাল গুলিবিদ্ধ হন। ৩১ মার্চ হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে একটি চা-বাগানে মাদক কারবারিদের হামলায় এক এসআইসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন এবং ১৩ মার্চ খোদ রাজধানীতেই পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছেন মাদক কারবারিরা।

হাতকড়া পরানো এক সঙ্গীকে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়েছেন তারা। এ তো মাত্র চারটি ঘটনা। এভাবে হঠাৎই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সাংবাদিকের ওপর মাদক কারবারিদের চড়াও হওয়ার ঘটনা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে সরকারের শীর্ষ মহলকে। কেউ কেউ বলছেন, সর্বশেষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর মাদক কারবারিরা অনেকেই তৃপ্তিতে আছেন। এই সুযোগে বড় বড় চালান তারা দেশে ঢুকিয়েছেন বলে গ্রেপ্তারকৃত অনেকেই তথ্য দিয়েছেন। মাদক কারবারিরা মনে করছেন, শিগগিরই কোনো বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটবে না।

মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে শীর্ষ থেকে মধ্যম মানের মাদক কারবারি হবেন সর্বোচ্চ ১০ হাজার। তাদের দমন করতে না পারায় দেশের ১৭ কোটি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ফেনসিডিল-ইয়াবার পাশাপাশি এখন ক্রেজি ড্রাগ ‘আইস’ নতুন করে ভাবাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। সঙ্গে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ‘এলএসডি’ ও ‘ডিওবি’। কয়েক বছর আগের হিসাবে বলা হতো, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ। করোনার এক বছরে ২০২০ সালে তা বেড়ে ৭৫ লাখ হয়েছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে এক কোটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এই সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরো অনেক বেশি। ইন্টারনেটের কারণে ঘরে বসে অর্ডার দিলেই যেহেতু হাতের নাগালে মাদক পৌঁছে যায়, তাই এর প্রবাহ এখন অনেক বেশি। তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারে অপরাধ বেড়েছে। এসব অপরাধের ৮৯ শতাংশ মাদক গ্রহণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

আমরা সভা, সেমিনার, বক্তব্যে প্রায়ই বলি, জনসংখ্যাই বাংলাদেশের সমৃদ্ধির মূল শক্তি। কথাটি শতভাগ সত্যি যদি জনসংখ্যা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও কর্মক্ষম হয়। সুস্থ জনসংখ্যাকেই শুধু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞাননির্ভর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করা সম্ভব। শারীরিকভাবে অসুস্থ একজন ব্যক্তি সমাজের জন্যে শুধু বোঝা হয়। সে পরিবার ও দেশের জন্যে আলাদা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু দেশের মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তাদের শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সুস্থতা তিরোহিত হয়। মাদকাসক্ত মানুষ কোনো যুক্তি বা আইন মানে না। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে যে কোনো ধরনের সমাজবিরোধী কাজ অবলীলায় এরা করতে পারে। এদের দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তৈরি করে, যাদের মাধ্যমে ভূমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজিসহ, ভাড়ায় মানুষ হত্যা ইত্যাদি কাজ করিয়ে নেয়। চালকের মাদক সেবনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সার্বিক হার চরমভাবে বেড়েছে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার কিছু মর্মান্তিক খবরের শিরোনাম দেখলেই সর্বনাশা মাদকের পরিণতি উপলব্ধি করা যায়- ‘তিন মাসের শিশুকে আছাড় মেরে হত্যা করলেন মাদকাসক্ত বাবা’, ‘দুই শ টাকার জন্য মায়ের গলা কেটে হত্যা’, ‘নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা’ ইত্যাদি। সংবাদগুলো আমাদের সভ্য সমাজের ভিতকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় এবং দেশের ভয়াবহ ভবিষ্যৎ পরিণতির আশঙ্কা আমাদের শঙ্কিত করে।

জনসংখ্যার কারণে সব প্রাকৃতিক সম্পদই আমাদের অপ্রতুল। মাদকের আগ্রাসনে জনসম্পদ যদি ‘মানববোমায়’ পরিণত হয়, তাহলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। ১৭ এপ্রিল ২০১৮ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভিক্ষা, অনুদান- এই শব্দগুলো আমি বদলে ফেলতে চাই। বাংলাদেশ এখন আর সাহায্য চায় না। বিনিয়োগ চায়।’ বিনিয়োগের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী স্থান আমাদের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আইন করে মদ ও মাদক নিষিদ্ধ করেন। ফলে দেশের মানুষ মাদক বা মদের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এ কারণেই এ দেশে যে কোনো শিল্পে শ্রমিক-কর্মচারী সব সময় সুস্থ ও সবল মানসিকতার পাওয়া গেছে। গার্মেন্টস ও অন্যান্য সেক্টরে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা কর্মচঞ্চল প্রান্তিক মানুষই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ভরসা। কিন্তু পরিসংখ্যান মতে, এক কোটি মানুষ মাদকের ছোবলে নিষ্কর্মা ও পঙ্গু জনবলে পরিণত হয়েছে। এরা এখন অন্যের জীবন ও সমাজের জন্যে হুমকিও বটে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছে। তার পরও আগ্রাসী মাদক জাতির স্বপ্নভঙ্গ করছে। ২১ এপ্রিল ২০২২ জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনাম ‘জনপ্রতিনিধিরাও মাদক কারবারে জড়িত’। খবরে প্রকাশ, মাদক কারবারে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সারা দেশে প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীও মাদকের টাকার ভাগ পান নিয়মিত।

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের সূচকে পৃথিবীতে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। এমন পরিস্থিতিতে মাদকের আগ্রাসন রোধ করতে না পারলে বিদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা খুব সহজ হবে না। মাদকের কারণে সমাজে সংঘটিত নৃশংস ও ভয়াবহ অপরাধগুলো তথ্য-প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। বার্ষিক জনপ্রতি অ্যালকোহল গ্রহণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। জনপ্রতি জিরো লিটার। মাদক ব্যবহার রোধেও এমন পরিসংখ্যান আমাদের সবার কাম্য। কর্মবান্ধব নিরাপদ পরিবেশ বিধানে এবং সুস্থ-সবল জাতি গঠনে রাষ্ট্রকেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাড়াতে হবে সরষের মধ্যের ভূত। গভীরভাবে ভাবতে হবে, ১০ হাজার লোকের সমাজ বিধ্বংসী মুনাফার সিন্ডিকেট আরো শক্তিশালী হবে, নাকি রাষ্ট্রের সুচিন্তা ও জনগণের কল্যাণের ইচ্ছাটাই জয়ী হবে। সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ প্রয়োজনে অবৈধ মাদক রাখার দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে আমাদের আইনও বেশ কঠোর, এর যথাযথ প্রয়োগে সবাইকে হতে হবে আন্তরিক। তবেই আসবে সমস্যার প্রকৃত সমাধান।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

* সুচিন্তা বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়