প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২১, ০০:০০
অনেক বন্ধু-পরিচিতকে দেখেছি ‘হিমু’ হওয়ার নেশায় হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটতে। উথাল-পাতাল জোছনায় ঘরবাড়ি ছেড়ে রেললাইন বা মেঠোপথের ধারে বসে থাকতে। উদাস চোখে আকাশপানে তাকিয়ে তারাদের সঙ্গে কথা বলতে। উদ্ভট কথা বা হঠকারী কাজ দিয়ে কাউকে চমকে দিতে। তাদের এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ডেসাধারণত অভিভাবকদের সমর্থন থাকতো না। উপরন্তু অধিকাংশ সময় তারা পরিবারের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতো।
হিমুদের পৃথিবীতে রূপাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। হিমু সত্তা জিইয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত কোনো মেয়েকে রূপা হওয়ার বাসনা প্রকাশ করতে শুনিনি! বরং অনেকের হিমু হওয়ার আকাক্সক্ষা ছুটে গেছে রূপার মতো কাউকে পাশে না পেয়ে। গৃহত্যাগী হওয়ার পরিবর্তে তারা বিয়ে-শাদি করে পুরোদস্তুর সংসার পেতেছে। কিছুদিনের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে রুটিন বাঁধা, পোষমানা জীবন-যাপনে। এসব রূপা হতে না চাওয়ার ভিড়ে একজন ছিলো ব্যতিক্রম। আমাকে সে ‘হিমু’ হওয়ার তালিম দিয়েছিলো। যেনো ‘হিমু’ হওয়া সাধনার বিষয়! প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে হিমু বানানো যায় না, এ সত্যের বিপরীতে ছিলো তার অবস্থান। হিমুকে ধারণ করার স্পর্ধা পেয়েছিলাম তার কাছ থেকেই। ঠা-া-জ্বরের ভয়ে জড়সড় আমার হাত ধরে বাইরে এনে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে বাধ্য করেছিলো। গভীর রাতে খোলা ছাদে বসে জোছনা যাপন করা শিখিয়েছিলো সে। রাস্তার ধারে ফুল-বিক্রেতা কোনো শিশুকে ডেকে মাসের শেষ সম্বল টাকা ক’টা ধরিয়ে দিয়ে বাকি দিনগুলো খালি হাতে পার করার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার জন্যে। কারও চোখ দেখে মনের খবর বলে দেয়ার কৌশলটাও রপ্ত করে ফেলেছিলাম তার কাছ থেকে। সে-ই আমাকে হুকুমের সুরে একদিন বলেছিল, কাল থেকে এ নামে আমাকে আর ডাকবে না। ‘রূপা’ বলে ডাকবে। আমি তোমাকে ডাকবো ‘হিমালয়’!
রূপার সব নির্দেশ কোনো প্রকার আপত্তি ছাড়াই মেনে নিয়েছিলাম। ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়ে আমি তখন অল্প অল্প করে হিমু হয়ে উঠছিলাম। জীবন থেকে নিয়মের শৃঙ্খল দূরে সরিয়ে রেখে পথ চলতে মন্দ লাগতো না! কেবল একটা কাজই পারতাম না, রূপার সঙ্গে একটানা যোগাযোগ বন্ধ রাখতে। সময়ের ব্যবধানটা একদিন থেকে দুদিন হলেই চারপাশ শূন্য শূন্য লাগতো। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠতো। অস্থির হয়ে উঠতাম রূপাকে দেখার জন্যে, ওর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে। কারও প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, এটা ও চাইতো না। আমার আকুলতা অবলীলায় অগ্রাহ্য করতো। কষ্ট লুকিয়ে প্রবোধ গুনতাম, হিমুদের বোধ হয় এতোটা উতলা হতে নেই!
টানা কয়েক দিন রূপার দেখা নেই। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। ওর বাড়ি গিয়ে চমকে দেবো কি না ভাবছি! হঠাৎ রূপা নিজেই এসে হাজির! ওকে চমকে দেয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। অথচ এমন ভাব করলাম, যেনো এটাই স্বাভাবিক! আগে থেকেই জানতাম ও আসবে! রূপাকে আজ অন্যরকম লাগছে। ওর চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে না। কখনও কখনও অতি আবেগে এমন হতে পারে। আরোপিত সৌন্দর্যে ওর একেবারেই আগ্রহ নেই। তবু আজ অনেক সময় নিয়ে সেজেছে, বোঝা যাচ্ছে। পরনের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে টিপ পরেছে। খোঁপায় দিয়েছে বেলি ফুলের মালা। শুচি-শুভ্র আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে ওর অবয়ব থেকে। আমি প্রশংসাসূচক কিছু বলতে যাব, তার আগেই ব্যাগ থেকে মেরুন রঙের একটা কার্ড বের করে। উদ্বেগহীন কণ্ঠ নামিয়ে বলে, ‘এই কার্ডটা রাখো। এখানে যা লেখা আছে সব সত্যি। এটা পারিবারিকভাবে পূর্বনির্ধারিত ছিলো। আমার কোনো হাত নেই। এটা তোমার জন্যে ভালোই হয়েছে। হিমুদের গৃহমুখী হতে নেই। কষ্টও পেতে নেই। তাদের কাছে সবই স্বাভাবিক। তুমিও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম হবে না!’
রূপা চলে গেছে। বিয়ের কার্ডটা বিছানার ওপর পড়ে আছে। কনের স্থানে ওর নামের রূপালি অক্ষরগুলো চিকচিক করছে। ঠিক আমার চোখের আড়াল করা অশ্রুর মতো। হঠাৎ খেয়াল হয়, এ কী করছি আমি! হিমুদের যে কখনও কাঁদতে নেই! কোনো ঘটনাই তাদের কাছে অস্বাভাবিক নয়। এমনকি রূপাকে হারানোও নয়!
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা