প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৬.
আবার একনিষ্ঠ শিক্ষা গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর শিক্ষা ভাবনা আমাকে বিশেষভাবে প্রাণিত করে। তিনি যেন আমার চিন্তাকেই সার্বজনীন করে তোলেন তাঁর রচনা দক্ষতায়। তাঁর ভাষ্যকে গুরুত্ব দিতেই হয় যখন তিনি লেখেন, ‘শিক্ষক বিপুল পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কিন্তু তিনি সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। তিনি কিছুতেই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। তাকে অবশ্যই শিক্ষার লক্ষ্য (aims of education), শিক্ষার বিষয়বস্তু (subject matter of education), শিক্ষার পদ্ধতি (methods of teaching) এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি (assessment strategy) সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। তা হলে তিনি চমৎকারভাবে একটি ফলপ্রসূ শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন এবং সকল শিক্ষার্থী উপকৃত হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুতির কথা একেবারেই ভুলে বসে আছেন। তারা মনে করেন, শিক্ষকতার জন্য কিছুই করতে হয় না। ফলে তারা শিক্ষক ছাড়া আর সবই হন অথবা কিছুই হন না। অনেকে মাতাব্বর হন, মোড়ল হন, পলিটিশিয়ান হন, ব্যবসায়ী হন, কৃষক হন, চাকরিজীবী হন কিন্তু কিছুতেই শিক্ষক হতে পারেন না এবং কোনো রকম মর্যাদার আসনও লাভ করেন না। অথচ এরা সারাক্ষণ বলে বেড়ান যে, শিক্ষকদের কোনো মর্যাদা নেই এবং শিক্ষকতা হলো একটি বাজে পেশা।’ (দৈনিক সংবাদ, ১৭ জুলাই, ২০১৮)
৭.
তাঁর বিশেষ কিছু রচনা রয়েছে- বিশেষ করে কবিতা, যা তাত্ত্বিক স্তরের অর্থাৎ সাহিত্য-দর্শনের প্রেক্ষাপটে, এবং কিছু আছে নির্দিষ্ট সাহিত্য-স্রষ্টার বিচার ও মূল্যায়নের নিরীখে। কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার অভিনবত্ব যে কোনো পাঠককেই মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। কেবল কবি হয়ে ওঠাই নয়, কবিতা ভাষ্যকার হিসেবে, কবির শিল্পকলার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সরকার আবদুল মান্নানের সদা তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। ফলে ‘কবিতার স্থাপত্যরীতি’র মতোন প্রবন্ধ যেমন রচনা করেন, তেমনি দেখা মেলে কবিতা প্রসব যন্ত্রণা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত লেখারও। কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি অকপটে বলছেন, ‘অধিকাংশ সময়ই বিষয়টি অত সহজ নয়। কবি তাঁর ভাবনার চিত্রটিকে শব্দের মধ্যে সংস্থাপিত করতে চান। সুতরাং শব্দই তাঁর প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার। আর শব্দকে যে তিনি কতভাবে পরিবর্তন করেন, পরিমার্জন করেন, অদল-বদল করেন, প্রতিস্থাপন করেন, স্থান পরিবর্তন করেন তার ইয়ত্তা নেই। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তিনি ভাবনার সর্বোত্তম ভাষিক পরিস্থিতি তৈরি করেন। একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি পদ/অতিপর্ব/পর্ব/পঙ্ক্তি সুস্থিত করে নেন। এর জন্যও তিনি আশ্রয় নেন পর্ব ছোট-বড় করার, স্থান পরিবর্তন করার, পঙ্ক্তি ছোট-বড় করার, ভাঙা-গড়ার। এছাড়া যতিচিহ্ন দিয়ে বা না-দিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অর্থময়তাকে সন্তুষ্ট করতে চান। ভাবনার উল্লম্ফন কিংবা দূরান্বয়ের মধ্যেও তিনি কবিতাটির মধ্যে একটি ভেতরগত ঐক্য ও সংস্থাপনা রক্ষা করতে চান কিংবা ঐক্য ও সংস্থাপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রত্যয় প্রবল করে তুলতে চান। এভাবে যখন পুরো কবিতাটি সৃষ্টি হয়ে যায় তখন তিনি কবিতাটি পড়েন- মনে মনে পড়েন, কখনো কখনো সশব্দে পড়ে নিজেকে শোনান। কবিতাটির ধ্বনিগত সাম্য ও প্রকটিত ছন্দ কিংবা অন্তর্গত ছন্দের যথার্থতা অনুভব করে নেন। পরিশেষে একটি কবিতা সৃষ্টি হয় এবং কবি একটি কবিতা সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেন।’
৮.
‘কবিতা : কথার ভিতরে অনেক কথার শিল্প’ প্রবন্ধটিতে তিনি কবিতা নিয়ে বলেছেন মনে রাখবার মতোন অনুভবশ্লোক, ‘রহস্যময়তা কবিতার প্রাণ। এই রহস্যময়তার সৌন্দর্য ও শক্তির বলেই কবিতা আলাদা হয়ে যায় গল্প-উপন্যাস থেকে, গদ্যসাহিত্য থেকে, ছড়াসাহিত্য থেকে। কবিতার এই অনন্য স্বরূপের জন্যই তার নিকট আত্মীয়তা চিত্রশিল্পের সঙ্গে, ভাস্কর্যের সঙ্গে, কখনো কখনো সংগীতের সঙ্গেও। এবং এই একই শক্তিতে কবিতা তার ক্ষীণ তনু অবয়বে ধারণ করতে পারে মহাকাব্যিক জীবনতৃষ্ণাকে। ধ্বনি মাত্রের মধ্যে, শব্দের মধ্যে, পঙ্ক্তির মধ্যে একজন শক্তিমান কবিকে ফলিয়ে তুলতে হয় অনেকান্ত জীবনের আখ্যান। কেননা অনেক কথা বলার স্বাধীনতা তার নেই, গদ্যশিল্পীর মতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়ার সুযোগ সে পায় না, ছড়াকারের মতো অর্থহীন বা প্রত্যক্ষ কিছু বলাও তার অন্বিষ্ট নয়। সুতরাং কবির স্বাধীনতাহীনতার জায়গাতেই তাঁকে তৈরি করে নিতে হয় অফুরন্ত স্বাধীনতার গোপন এক ফল্গুধারা। আর এখানেই কবি সৃষ্টি করেন রহস্যময় এক জগৎ, যেখানে বহুতর ভাবনার আনন্দিত বিহার মুক্তির আস্বাদ লাভ করে, কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক কথা। কবিতার এই রহস্যময়তার উদ্ভব ভাবনার জটিলতা থেকে ঘটে না এবং বিষয়টি এমন নয় যে, নিরন্তর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জট উন্মোচন করে একটি সুনিশ্চিত সমাধানে উপনীত হওয়া যায়। বিজ্ঞানে, গণিতে, দর্শনে এবং জ্ঞানতত্ত্বের অন্যান্য শাখায় সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, সমাধান লাভ করা যায়। এই সিদ্ধান্ত বা সমাধান চিরকালীন নাও হতে পারে, তবে সময়ের চাহিদা বেশ ভালোভাবেই মেটানো যেতে পারে। কিন্তু কবিতার রহস্য জ্ঞানকাণ্ডের পরিধির মধ্যে পড়ে না। ব্যক্তি তার বিচারবোধ দিয়ে, চিন্তাশক্তি, আবেগ ও কল্পনার সাহচর্যে কবিতার রহস্যময়তার নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে; কিন্তু সেই ব্যাখ্যা অন্যের কাছে তো নয়ই, কখনো কখনো নিজের কাছেও অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। কবিতার এই যে মীমাংসাহীন রহস্য, এর মধ্যে নিহিত থাকে কবিতার চিরকালীনতার শক্তি। কবিতা থেকে যদি রহস্য ফুরিয়ে যায় তাহলে কবিতার মৃত্যু ঘটে। রহস্যহীন কবিতা কবিতা নয়- পদ্য, ছড়া। পদ্য বা ছড়ার সামাজিক মূল্য থাকে, এক ধরনের সাহিত্যমূল্যও নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু কবিতা অনন্য এক শিল্প, অফুরন্ত এর মাহাত্ম্য। রহস্যময়তা কবিতাকে এই অনন্য মাহাত্ম্য দান করে। একটি কবিতা শত শত বছর ধরে পাঠকের আনন্দিত অভিজ্ঞতার বিষয় হয়ে ওঠে এ-রহস্যকে আশ্রয় করে। এ হচ্ছে কবিতার এমন এক শক্তি যা পাঠককে আনন্দিত ভাবনায় নিমজ্জিত করে, নতুন বোধের উদ্বোধন ঘটায়, চেতনার জগতে শুদ্ধতার সৃষ্টি করে, নতুন জীবন-তৃষ্ণায় উদ্বুদ্ধ করে।’
৯.
সরকার আবদুল মান্নানকে আমার প্রবন্ধকার হিসেবেই বেশি ভালো লাগে, কারণ তাঁর রচনাভাষ্য মনে দাগ কেটে যায়, ভাবনারা আমার মতোন পাঠকের মনের আকাশে মেঘমালা হয়ে খেলা করে। আসলে কথাশিল্পী কিংবা কবি- সকলেই তো শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন, শব্দের জাল বুনতে বুনতে স্বপ্নকে ধরে ফেলেন। আর এমনই ভাবনার দেখা পাওয়া তাঁর ‘শব্দের সীমানা’ প্রবন্ধটি আমার ভালো লাগা একটি অন্যতম রচনা। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘অনেক দিন চলতে চলতে টাকা একসময় অচল হয়ে যায়। লোকে বলে অচল টাকা। শুধু টাকা নয়, অনেক কিছুই অচল হয়। মানুষ, হাটবাজার, শহর-বন্দর, রাস্তাঘাট অচল হয়। আবার অচল হয় না। এমন কিছু বিষয়-আশয়ও আছে। এই পৃথিবী, এই চাঁদণ্ডসূর্য কতদিন ধরে চলছে- আমরা তা জানি না। মাথার ওপরে আছে বিপুল আকাশ, আছে রহস্যময় রাতের তারা। লক্ষ-কোটি বছর ধরে আছে। এসব কখনো হারিয়ে যাবে কি-না আমরা তার কিছুই জানি না। আর আমাদের চারপাশে এই যে রঙের খেলা, গন্ধের বিস্তার, প্রাণের কোলাহল- এসবও যে কত সহস্র বছর ধরে আছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব কি কখনো অচল হবে, হারিয়ে যাবে? আমরা জানি না; কিন্তু কিছু শব্দ চলতে চলতে এক সময় আর চলতে পারে না। অচল হয়ে যায়। হৃদয়ের আনন্দ আর আর্তিতে ভরপুর এবং মমতারসে সিক্ত শব্দগুলো এক সময় হারিয়ে ফেলে তার সব ঐশ্বর্য, সব আবেদন। কখন থেকে যেন শব্দগুলো কেউ আর ব্যবহার করে না। কোন জাদুমন্ত্রে কবিগণ জেনে যান যে, এসব শব্দ ব্যবহার-উপযোগী নয় আর। পাঠকের ভাষাবোধে বোধ করি হোঁচট খায়। সময়ের সঙ্গে শব্দগুলো আর যায় না, সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। ফলে কবিগণ সহজাত ও সচেতন এক ভাষিক সদস্য হিসেবে বুঝে যান, কোন শব্দ কবিতায় আর ব্যবহৃত হতে পারে না। ব্যবহার করেন না বটে, কিন্তু কখনো ব্যবহৃত হতো; অসাধারণ শক্তি, সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর রহস্য নিয়ে যখন শব্দগুলো কবির ভাবের জগৎকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলত, সেই কবিতাগুলো তো আবেদন হারায় না কখনো। কবিভাষার কিছু কিছু উপাদান পুরনো হয়ে গেলেও কবিতাগুলো কখনো পুরনো হয় না। তার মানে, শব্দ পুরনো হয়ে যেতে পারে; কিন্তু কিছু কবিতা কখনোই পুরনো হয় না। বিস্ময়কর আবেদন আর ব্যঞ্জনা নিয়ে বেঁচে থাকে বহুকাল। এই চিরকালীনতার রহস্য কোথায়? কবিতার মধ্যে, নাকি পাঠকের মধ্যে, নাকি কবিতা ও পাঠক- এই উভয়ের মধ্যে। কবিতার আপন স্বভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার বিষয়টি সব কালেই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। চিরকালীনতার রহস্য কবিতারই অন্বিষ্ট। আর পাঠক-অবচেতনে শব্দণ্ডসংস্কৃতির ঐতিহ্য লুকিয়ে থাকেই। শত শত বছরের আগের শব্দ, যে-শব্দে এখন আর কেউ বলেন না, যে-শব্দে কেউ আর লেখেন না, যে-শব্দ সেই সময়ের কবিতার দেহে আসীন হয়ে আছে, সেই শব্দ কবিতার দেহ থেকে পাঠকমনে আলোড়ন তোলে শব্দণ্ডসংস্কৃতির অবচেতন ঐতিহ্যের জন্যই। যে-ভাষায় একজন পাঠক কোনোদিন লেখেননি, লিখবেনও না- মাতৃভাষার সেই রূপের কবিতা তাকে কেন মোহাবিষ্ট করে, কেন তার চিরকালীন এক ভালোলাগার জগতের দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয়, তার রহস্যও লুকিয়ে থাকে তার ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যে, ভাষা-পুরানের প্রত্ন-ইতিহাসের মধ্যে।
(চলবে)