প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২১, ০০:০০
বিম্বিত বীক্ষণ
অধ্যক্ষ রতন কুমার মুজমদার
পর্ব-২২
|আরো খবর
ছাত্র জীবনে যে শিক্ষক আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন তিনি আমার শিক্ষাগুরু শ্রদ্ধেয় নারায়ণ স্যার। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে আসার পর সিক্স থেকে অটো প্রমোশন পেয়ে সেভেনে উঠি। স্যার ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। স্যার আমাদের বাড়িতে থাকতেন। আমরা তিন ভাই স্যারের ছাত্র ছিলাম। স্যার আমাদের সকল বিষয় পড়াতেন। স্যারের হাতের লেখা ছিল মুক্তার মত। বাড়ির সবার কাছে স্যার ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। ধীরে ধীরে স্যার আমাদের শিক্ষক থেকে অভিভাবক হয়ে উঠলেন। আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে স্যার আমাকে বেশি আদর করতেন বলে আমার বিশ্বাস। আমার আজকের এখানে আসার প্রেরণা স্যারের। আমি সবার কাছে এখনো গর্বের সাথে বলি, নারায়ণ স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন। স্যার যেমন ছিলেন শিক্ষক তেমনি অভিভাবক। এতবছর পর এসে মনে পড়ে, স্যার যখন ছুটিতে বাড়ি যেতেন আমাদের খুব মন খারাপ হতো। জীবনেও স্যারের ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। স্যারকে সবসময় আমি অনুসরণ করতাম। নারায়ণ স্যারের মত শিক্ষক আজ সত্যিই দুর্লভ। এমন আদর্শবান শিক্ষকরা দিন দিন সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। এমন স্যারদের সংখ্যা যত কমে যাবে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর বন্ধন ততটা ¤্রয়িমান হবে। একজন শিক্ষকই হতে পারেন শিক্ষার্থীর আদর্শ ব্যক্তি।
একজন শিক্ষক যে কী পরিমাণ ছাত্রের উপর প্রভাব ফেলতে পারে সেটা আমি বুঝি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষককে পিতৃতুল্য মনে করে। এ সুযোগটা ইচ্ছে করলে আমরা শিক্ষকরা কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকের অতিলোভ, ব্যক্তি আকাক্সক্ষার কাছে সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায়। আমি আবারো জোর দিয়ে বলতে পারি, একজন শিক্ষক সমাজে যা প্রভাব ফেলতে পারে তা আর অন্য কেউ পারে না। গ্রামে-গঞ্জে এখনো শিক্ষকদের সকলে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষকের একটা বড় ভূমিকা থাকে। শিশুরা সবসময় তার শিক্ষককে অনুসরণ করে। যদি শিক্ষক সৎ চরিত্রের হন এবং ভালো ব্যবহার করেন তাহলে শিশুরাও ভালো হয়। জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশলও শিক্ষকই শিশুকে শেখান।
সৎ ও ভালো মানুষ হতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। একজন শিক্ষিত ও সৎ মানুষ দেশের উন্নয়নের সহায়ক শক্তি। দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি ও অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারে কেবল সুশিক্ষা। আর এই সুশিক্ষার কারিগর হলেন শিক্ষক। নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে, শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিহার্য।
একটি আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন জাতি তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নৈতিকতা। শিশুরা নৈতিকতার প্রথম পাঠ নেয় মা বা তারপর তার শিক্ষক থেকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে ও ধ্যানে- জ্ঞানে আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সততা, আচরণগত অভ্যাস, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারলে কখনোই আদর্শবান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। যে কাজটি সহজেই করতে পারে শিক্ষকরা। ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে শিক্ষকদের ভূমিকা অনন্য। সমাজের ভালো কাজ করার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন। জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে আর সেটা করবে একজন শিক্ষক। সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেটা রোধ করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব। কেননা শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের ন্যায়-অন্যায়, সৎপথ, সঠিকপথের নির্দেশনা প্রদান করবে। সত্য-অসত্য, দেশের স্বার্থ এবং দেশের উন্নয়নের করণীয় সকল বিষয় তাদের কাছে পৌঁছে দিবে একজন দায়িত্ববান শিক্ষক।
পরিবার থেকে বের হয়ে এসে একজন শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তির মধ্য দিয়ে তার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে মা-বাবা যেমন তার প্রথম শিক্ষক, এই পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা হন তার দ্বিতীয় মাতা-পিতা। বিদ্যালয়ে একটি শিশু শৈশব পার করে দিয়ে যৌবনে পা রাখে। অপরিণত বয়স থেকে পরিণত বয়সের দিকে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে। বড় কঠিন এই দ্বিতীয় পর্যায়। একজন শিক্ষার্থীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সময় এটা। সেজন্য এই পর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী কর্মজীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তি রচিত হয় এখানে। দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক’।
শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি শিশুর মানসিকতা এবং নৈতিকতা তৈরি করেন। শিক্ষকরা শিশুর জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষক নতুন প্রজন্মকে কুসংস্কার, অন্যায় থেকে দূরে রাখবেন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। তাই তো শিক্ষকদের বলা হয় ‘সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ তথা সমাজ নির্মাণের স্থপতি।
একজন ভালো শিক্ষকের নিজের শিখবার আগ্রহ থাকতে হবে। কারণ নিজের শিখবার আগ্রহ না থাকলে ছাত্র-ছাত্রীদের শিখবার আগ্রহ তৈরি করতে পারবেন না। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুই ধরনের মানুষের প্রয়োজন কখনোই শেষ হবে না শিক্ষক ও চিকিৎসকের। শিক্ষকতা একটা ধর্ম, এটিকে জীবনে ধারণ করতে হয়। মনে রাখতে হবে জ্ঞানীমাত্রই শিক্ষক নন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকের পড়ার মানসিকতা নেই। সারা জীবনে একজন ছাত্র যা পড়ে তার কয়েকগুণ বেশি পড়তে হয় শিক্ষকতা করতে গিয়ে। অথচ অধিকাংশ শিক্ষকের পড়ার মানসিকতা নেই।
অনেক তরুণ ছোটবেলা থেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই শিক্ষক হতে চায়। প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিসের সময় থেকে আজকের এই শতাব্দীতে এসে অনেক পেশা হারিয়ে গেছে, অনেক পেশার উত্থান ঘটেছে, কিন্তু শিক্ষকতা টিকে আছে। শিক্ষকতায় সম্মানের জায়গাটা কতটুকু অটুট আছে সেটা প্রশ্ন। শিক্ষক হতে চাইলে কী করণীয় অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। সহজ উত্তর হলো, শেখাতে হলে আগে শিখতে হবে। অর্থাৎ আপনি স্কুল, কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক হতে চান না কেন, আগে নিজের পড়ালেখাটা করতে হবে মন দিয়ে। নিজেকে গড়তে হবে একজন আদর্শবান, মানবিক মানুষ হিসেবে। এর বাইরেও কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা, কিছু নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।