প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
একজন সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষকের উপর হামলা ও তার প্রতিকার
এবার চাঁদপুরে এসেই দুঃসংবাদটি পেলাম। এই শহরের সংস্কৃতির অঙ্গনে এই প্রজন্মের শিল্পী ফাতেমা, মঞ্চে অভিনয় করে মেয়েটি। একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করে। কোনো কারণে এক যুবক মেয়েটির মাথায় আঘাত করে। মেয়েটি মূর্ছা গেলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। বেশ ক’দিন চিকিৎসার পরে মূর্ছাবস্থা কেটেছে। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। কিন্তু তাতে কি ফাতেমার আরো বিপদের আশংকা কেটে গেছে? এমন ভাবনার অনেক কারণ আমার আছে। ফাতেমা আমার সংগঠনের কেউ না। আমার কোনো শিল্প নির্মাণের কাজেও ছিল না। ওর তেমন কোনো কাজও আমার দেখা হয়নি। খুব একটা পরিচয়ও নেই। তাতে কী। তবুও সে একজন নাট্যকর্মী। একজন মঞ্চকর্মী। একজন শিল্পীর দায়িত্ব কাঁধে নিতে চায়। একজন সংস্কৃতি কর্মী এবং একজন শিক্ষক। এভাবেই তাকে আমার সহযোদ্ধা মনে হয়েছে। আমার সাথে মতের মিল আছে কি নেই কিংবা আমার কোনো কাজে আছে কি নেই অথবা আমার বিপক্ষে অবস্থান কিংবা হীনতায় অপমান করুক, তবুও আমিতো শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের সহযোদ্ধাই মনে করি। একই ময়দানে নেমেছি...কেউ আপন...কেউ পর।
এমনিতেই ছোট শহরগুলোতে সংস্কৃতি চর্চার সু-বাতাস নেই। নানান বিপরীত অবস্থার মধ্যে ছেলে-মেয়েরা কাজ করে যাচ্ছে। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় তাদের অনেক ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত থেকেও অধিকাংশ সময়ে ওরা তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। এছাড়া উপায়ও আপাতত নেই। এটা ওরা জানে। নিজেদের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সরকারি অনুষ্ঠানগুলোও বাস্তবায়ন করে চলেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ওদের ছাড়া তো হয়ই না। এসবের বিপরীতে এখানে শিল্পীদের ভাগ্যে কী আর জোটে! চারপাশে কত কী উন্নয়ন, কত কত অবকাঠামো আর তদারকি। কিন্তু শিল্পীদের বেলায় এর তুলনায় কিছুই হয় না। অনেকটা ‘ওয়ান ওয়ে ট্রাফিকে’র মতো চলে শিল্পীদের জীবন। স্থানীয়ভাবে সংস্কৃতি চর্চার দলগুলো এবং নাট্য চর্চার জন্যে থিয়েটার দলগুলোকে সরকারিভাবে বাৎসরিক কিছু অর্থ অনুদান দেয়া হয়। দেখেছি করোনা মহামারীকালে কিছু প্রণোদনাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বিচারে তা অনেক কম। অন্তত সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় সংস্কৃতির যে ভূমিকা তার সঠিক বিবেচনায় এটা অতি সামান্য। তবুও শিল্পীরা তুষ্ট থাকে। তবুও শিল্পীরা নাচণ্ডগান করে, সাহিত্য চর্চা করে, আবৃত্তি করে, সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ তোলে, সমাজটাকে জাগ্রত করে রাখে।
আমিতো দেখেছি একমাত্র শিল্পীরাই জোর গলায় ‘সংস্কৃতি বান্ধব সরকার’ বলে স্বীকৃতি ঘোষণা করে। দেখেছি স্থানীয় সরকারকেই শিল্প সংস্কৃতির অভিভাবক অভিধায় স্বীকৃতি উচ্চারণ করে। এতো কম পেয়ে এতো বড় স্বীকৃতি আর কে দেয়! ঐ যে বলছিলাম ‘ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক’। একতরফা চাহিদা পূরণ চলছে। আমাদের মন ভালো নেই-বিনোদন দাও। মনটা আজ ফুরফুরে, নেচে গেয়ে সবাইকে জানান দাও। কোন সমাজ বিরোধী গোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, নাট্য আন্দোলনে সোচ্চার হও। তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্ত হচ্ছে, পাড়ায়, মহল্লায় সচেতনতামূলক নাটক গান কর। বাল্যবিবাহ রোধে পথে পথে অভিনয় করে বাবা-মাদের বোঝাও। স্বদেশ বন্দনা শেখাও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মেলা করো, বই উৎসব করো। পহেলা বৈশাখে পাঞ্জাবী-শাড়ি-টিপ পরে নাচে গানে মুখরিত করে গোটা বিশ্বকে জানান দাও এ জাতির আছে অহংকার। ভাষার মাসে শহীদ মিনারকে জাগ্রত করে তোলো।
একবার ভাবুনতো, শিল্পীরা যদি না থাকে, যদি এসব কাজ না করে, তাহলে কেমন ভয়াবহ অবস্থা হবে! সমাজে মানুষ একত্রিত হওয়ার কোনো আয়োজনই থাকবে না। এই যুগে মোবাইল ফোনটা না থাকলে মানুষ যেমন যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, তেমনি শিল্পসংস্কৃতি না থাকলে দশ কোটি হাজার টেরাবাইটের আলোক জ্বালিয়েও গোটা সমাজটাকে গভীর নিমজ্জন থেকে রক্ষা করা যাবে না। সমাজটা মানসিক কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হবে। ভবিষ্যতের জন্যে জন্ম নেবে এক অমানবিক বিকলাঙ্গ সমাজ। তখন কোন উন্নয়ন, কোন অবকাঠামো, কোন নীতিনৈতিকতা, কোন শিক্ষা মানুষের মনের ঘরে আলো জ্বালাতে পারবে না। তবুও এই সমাজে শিল্পীদের, নাট্যকর্মীদের, সাহিত্য-কবিদের সম্পর্কে কটুক্তি করেই বলা হয়, ‘এরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়’। আমি বলি হ্যাঁ, ঠিক তাই..তাই তো..একদম সঠিক। বলি এরা না থাকলে বুনো মোষদের কামড় থেকে তোমরা বাঁচবে কি করে ? এরা না থাকলে তোমরা নিজ দেশেই বনবাসী হয়ে যেতে। তোমাদের মানুষের ইজ্জতে বেঁচে থাকার দায়িত্বটা এরাই সে¦চ্ছায় প্রণোদিত হয়ে নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে বলেই তোমরা আছো...বেঁচে আছো...মানুষ হয়ে। অথচ সেই সে¦চ্ছায় প্রণোদিত হয়ে নিজের কাঁধে দায়িত্বটা তুলে নেয়ার একজন সহকর্মী, একজন শিল্পী...একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলার চেষ্টা হলো। মেয়েটা মূর্ছা গিয়ে হাসপাতালে যেতে হলো।
শুনেছি ঘাতক এখনো ঘুরে বেড়ায়। এমন আশ্চর্য বেদনার অপমানের গ্লানির দায়ভার কে নেবে? প্রশাসনকে বলি, আপনি যদি শিল্পে কাতর হোন, যদি বিবেক তাড়নায় কাতর হোন, যদি কৃতঘœ না হোন, যদি স্থানীয় শিল্পীদের অভিভাকত্বের দায়িত্বে দায়িত্ববান হোন, যদি সমাজ সচেতন মানুষের মতো শিল্পকে ‘ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক’ মনে না করেন, তবে একজন শিল্পী ও শিক্ষক ফাতেমা-তুজ জোহরার উপর এমন নির্মমতায় তার সহমর্মী হোন এবং যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করুন। আর এর মাধ্যমে শিল্পীদের আশঙ্কামুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে ভূমিকা রাখুন।