বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাজীগঞ্জে তাল গাছ থেকে পড়ে আহত যুবকের মৃত্যু
  •   অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন চৌধুরী মারা গেছেন
  •   ছেলের মামলা-হামলায় বাড়িছাড়া বৃদ্ধা মা
  •   মতলব উত্তরে ইকবাল হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
  •   মতলবে ১০ কেজি গাঁজাসহ আটক ৩

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৭

আমাদের সর্বোচ্চ বৈষম্য শিক্ষায়, সমাধান জরুরি

সুধীর বরণ মাঝি
আমাদের সর্বোচ্চ বৈষম্য শিক্ষায়, সমাধান জরুরি

সভ্যতা ও জাতীয় উন্নয়ন এবং উন্নতির রূপকার বৈষম্যহীন শিক্ষা। শিক্ষায় বৈষম্য চরম দীনতার পরিচয়। যে জাতি শিক্ষায় যতো বেশি বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, সেই জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে ততো বেশি পিছিয়ে পড়েছে, জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনযাপন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষা ও শিক্ষকদের যতো বেশি মর্যাদা দিয়েছে, সেই দেশ সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ততো বেশি উন্নত। আমাদের এখানে প্রতিদিন শিক্ষকরা বৈষেম্যের শিকার হন, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরাও বৈষম্যের শিকার হন। শিক্ষা তো শিক্ষাই। শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি কথাটাই অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, অমানবিক এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

 শিক্ষা মানুষের জন্মগত মৌলিক মানবিক অধিকার ও গুণ। একটি উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক, ধর্ম নিরপেক্ষ, বাস্তব জ্ঞানসমৃদ্ধ মানবিক শিক্ষার বিকল্প নেই। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহু ধারায় বিভক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠে বহুধারায় শিক্ষা নয় একই ধারায় শিক্ষা চাই। যার মধ্যে পুরো জাতি একই বিশ্বাস ও জাতীয়তায় গড়ে উঠবে। শিক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর তারাও বহু ধারায় বিভক্ত। ফলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

 

 

 জাতি গঠন এবং উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি। দিনে দিনে শিক্ষা বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখনই এর সমাধানের পথ খুঁজে বের করার মোক্ষম সময়।

বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি থেকেই হরেক রকমের শিক্ষাব্যবস্থা এবং হরেক পরীক্ষা চালু আছে। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা ১২ রকমে দেওয়া যায়। এক সনদের জন্যে ১২ রকমের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। প্রচলিত বা সাধারণ স্কুলগুলোতে যারা পড়ালেখা করে তারা ‘সাধারণ’ এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে থাকে। আর মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা দেয় দাখিল পরীক্ষা।  ভোকেশনাল নামেও একটি পরীক্ষা দেখা যায়। কারিগরিতে যারা পড়ে তারা দেয় এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেও দেওয়া যায়। প্রাইভেট এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। মাধ্যমিকে যেসব বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন রয়েছে, সেখানে ইংরেজি ভাষায় এসএসসি পরীক্ষা দেয়া যায়। ইংলিশ মিডিয়ামে (ইংরেজি ভার্সন নয়) যারা পড়ে, তাদের এসএসসি সমমানের পরীক্ষার নাম ‘ও’ লেভেল। সে ব্যবস্থাতেও এডেক্সেল ও কেমব্রিজ কারিকুলামের স্কুলে পৃথক পড়ালেখা। আর সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কওমি মাদ্রাসা। এ শিক্ষাকেও সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করা শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সের সম্মান দেয়া হয়েছে। কওমিতে হাফেজি ও মাওলানা (টাইটেল) ধারায় পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। সাধারণ এসএসসি ও ইংরেজি ভার্সনের এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে আছে ৯টি শিক্ষা বোর্ড। মাদ্রাসায় দুধরনের দাখিলের জন্যে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। কারিগরি শিক্ষার জন্যে আছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেও দেয়া যায় এসএসসি পরীক্ষা। শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনেই প্রাইভেট এসএসসি দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

 

 

 ইদানীং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। বিভাগীয় এবং জেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এসবের বেশিরভাগের নিবন্ধন নেই। তারা এডেক্সেল ও ক্যামব্রিজ কারিকুলামে পরীক্ষা দিলেও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নেই। শিক্ষা বোর্ডগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করে না। অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা চালু রয়েছে। তাদের পরীক্ষার জন্যে তারা নিজেরাই একাধিক বোর্ড বানিয়েছে। এগুলোতে সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষায় বৈষম্যের নেতিবাচক দিকগুলো সমাজ ও দেশের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর পরে আছে ফি, আছে মাত্রা অতিরিক্ত ফি আদায়ের নানা ব্যবস্থা। যার কারণে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ অভিভাবক।

 

 

পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল তৈরি করার জন্যে শিক্ষকদের  ওপর থাকে অনৈতিক চাপ। নানা সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষক সমাজকে বছরের বেশির ভাগ সময় দেখা যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দাবি আদায়ে ব্যস্ত থাকতে। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষা সম্পন্ন হয় বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা। অথচ তারা পরতে পরতে অবহেলিত। একই সিলেবাস এবং কারিকুলাম ও নিয়মনীতি মেনে সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত এবং নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বৈষম্য আকাশ-পাতাল। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা (বেতন নয় অনুদান) পেয়ে থাকেন। বেসরকারি, এমপিওভুক্ত এবং নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুদানের বাইরে যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তা অনেকটা  তাদের সাথে তামশা করার মতো।

 

 চাকরিতে যোগদান থেকে শুরু করে অবসর জীবন পর্যন্ত পদে পদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরা । আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা  অনুদান পেয়ে থাকেন। অনুদান কোনো সম্মানের বিষয় হতে পারে না। আজকের দিনে আমাদের দেশে কোথাও কি ১০০০ টাকায় বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকায় চিকিৎসা সেবা পাওয়া সম্ভব?

পরিকল্পিতভাবে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের শিক্ষাকে বিভক্ত ও মানহীন করে ফেলা হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনঅধ্যুষিত শিক্ষার পরিসরকে দখল করে অপরিণামদর্শী এক ব্যবস্থা, যেখানে দুর্নীতি, নকল ও সন্ত্রাস একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। রাষ্ট্রের অবহেলায় বিপজ্জনকভাবে বেড়ে উঠতে থাকে মূল্যবোধহীন, অদক্ষ সনদনির্ভর একটি শ্রেণি, যারা কেবলই বেকারত্ব বাড়ায়, সমাজে অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও অসহনশীল শ্রেণির বিকাশ এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা বাণিজ্য, দুর্নীতি ও অব্যবস্থা শিক্ষাসেবার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের তীব্র অভাব লক্ষ্য করা যায়। পরীক্ষার সনদও সন্দেহের কাঠগড়ায় দঁাড়িয়ে যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবেশ বৈরী হয়ে উঠে। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারিক ক্লাসের চর্চা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার ও ল্যাব গুরুত্ব হারাতে থাকে। পাবলিক পরীক্ষায় এখন নকল প্রায় উঠে গেলেও সুষ্ঠু পরীক্ষা বলতে যা বোঝায়, তা অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। কোচিং-গাইডের দাপট, শ্রেণিকক্ষে সক্রিয়তার অভাব ও মূল্যবোধের অবক্ষয় শিক্ষার মানকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। ইনকোর্স থেকে ব্যবহারিক পরীক্ষা--সবখানেই বোঝাপড়ার সংস্কৃতি নামে নতুন একটা চর্চা কর্তৃত্ব আরম্ভ করে। বেসরকারি মানসম্পন্ন বিদ্যালয়ের খরচের ভার বহন করা অনেক অভিভাবকের পক্ষেই খুব কঠিন। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং সেন্টারের খরচও জোগাতে হয়। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এতোসব খরচের জোগান দিতে পুরোপুরি অসমর্থ। ঢাকা মহানগরে সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রয়েছে বেসরকারি কিংবা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়। এজন্যে আর্থিকভাবে অসচ্ছল অভিভাবকদের সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়। ঢাকায় কোনো কোনো বেসরকারি বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন ৫-১০ হাজার টাকার বেশিও আছে। আর কোনো কোনো ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন ২০-৫০ হাজার টাকার বেশি।

 

 আমাদের শিক্ষা অবকাঠামোর অবস্থাও করুণ। বিপুল অধিকাংশ স্কুল-কলেজে উপযুক্ত গবেষণাগার, পাঠাগার এবং যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক নেই। অথচ অন্যদিকে অত্যাবশ্যক হলেও হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি পড়ে থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে ব্যয় বিশ্বে একেবারে নিচের সারিতে। ফিনল্যান্ড, জাপান তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কাও জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করে। অন্যদিকে আমাদের দেশে তা ২ শতাংশেরও কম। বেতনবৈষম্য, দুর্বল অবকাঠামো, শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অসম অনুপাত এবং বিভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় ভয়াবহ বৈষম্য শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পথে বড়  প্রতিবন্ধকতা--এ বিষয়গুলো অস্বীকারের অবকাশ নেই।  শিক্ষা উপকরণের মূল্য আজ সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। দ্বিতীয়ত, এখানে ‘টাকা যার, শিক্ষা তার’ এই নীতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

 

 

 পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু করা করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ আজ তাদের সন্তানদের খেলাপড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষা আজ বাণিজ্যিকীকরণের রূপ নিয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, প্রাইভেট স্কুল-কলেজের সংখ্যা বেশি। ব্রিটিশদের মতো আমাদের স্বাধীন দেশের সরকারগুলোও কি দেশের মানুষকে শোষণ এবং কেরানি তৈরি করার জন্যে যতোটুকু শিক্ষার প্রয়োজন, ততোটুকুই দিচ্ছে? শিক্ষা এবং শিক্ষকদের উন্নতি না হলে, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনোভাবেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নত দেশের মানদণ্ড অর্জন করতে পারবো না। সর্বজনীন শিক্ষাকে কৌশলে বেঁধে রাখা অমানবিক, অনৈতিক এবং অসাংবিধানিক। কোনো একদল মানুষ বা কোনো এক গোষ্ঠীকে খুশি করার বা খুশি রাখার শিক্ষা কখনো দেশ ও জাতির জন্যে সুফল ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। শিক্ষায় যে জাতির যতো বেশি বিনিয়োগ সে জাতি ততো বেশি উন্নত। তারা বিজ্ঞান, আধুনিক, সভ্যতা, মানবিকতা, মূল্যবোধের ততো শিখরে অবস্থান করে। তারা জ্ঞানের অন্বেষণে তৃপ্তি লাভ করে।

 

আর এখনকার দিনে শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি প্রদান ও হত্যা করা এবং লাঞ্ছনার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দঁাড়িয়েছে। এ লজ্জা যে গোটা জাতির। এ দেশে অনেক শিক্ষক হত্যাসহ অনেকবার শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানো এবং তাদের বারবার লাঞ্ছনার শিকার হতে হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ঘটনারই বিচার হয় নি। ফলে অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটাতে উৎসাহী হয়ে উঠছে, যা জাতির জন্যে চরম অশনি সংকেত। শিক্ষকরা যখন তাদের বঁাচা-মরার অধিকারের প্রশ্নে রাজপথে আন্দোলনে, তখনই শিক্ষকদের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিক নির্যাতন। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি, শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষকদের ওপরে লাঠিচার্জ করা হয়। তখন জাতি হিসেবে আমরা নির্বোধের মতো চেয়ে থাকি। শিক্ষক হিসেবে আমরা কতোটা অবহেলিত? যদিও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, তথাপি শিক্ষার গুণগত মান এবং শিক্ষার সুযোগে বড়ো ধরনের পার্থক্য রয়ে গেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড এবং পদোন্নতির জায়গাটি খুবই সঙ্কুচিত। এ যেন সোনার হরিণ! শিক্ষকতা এখনো আমাদের দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণির, আবার কোথাও তৃতীয় শ্রেণির, আবার কোথাও দ্বিতীয় শ্রেণির, আবার কোথাও প্রথম শ্রেণির। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে শিক্ষকদের মধ্যে এরকম বৈষম্য আছে বলে আমার জানা নেই।

 

 

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত একই পদ্ধতির মানবিক  শিক্ষা এখন সময়ের দাবি। সময়ের দাবিকে উপেক্ষা করা মানে হলো সময়ের চাহিদার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। আর এই বিশ্বাসঘাতকতার কুফল দীর্ঘ মেয়াদী হয়। প্রশ্নপত্র ফঁাস, পাঠ্যপুস্তকে একদলকে খুশি রাখার আয়োজন ইত্যাদি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রসমাজকে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও যান্ত্রিক করে তুলেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই খেলার মাঠ, নেই খেলাধুলার সরঞ্জাম, খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারিকুলাম শিক্ষা উপেক্ষিত। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। শিক্ষা হতে হবে  সবার জন্যে এবং মানবিক। যেই শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে, মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটবে, অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে যুক্তি নির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার বিকাশ ও প্রসার ঘটবে।

 

 কমনওয়েলথের সুপারিশ অনুযায়ী দেশের জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা থাকলেও কোনো সরকারই তা আমলে নেয় না। শাসক শ্রেণির উদাসীনতার কারণে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষানীতি অপরিপক্কতার চাদরে মোড়ানো। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রাইভেট কোচিং আছে, তবে এ খাতে বাংলাদেশের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হয় সবচেয়ে বেশি। এ হার এখানে ৬৭ শতাংশ।

 

 জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২’ প্রকাশিত হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বেসরকারি খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। এখানে শিক্ষার মধ্য দিয়ে দায়বদ্ধতার পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিকতাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে মেধাবীদের তেমন একটা মূল্যায়ন করা হয় না। শিক্ষার জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে শুধু শিক্ষকরাই নন, সমগ্র জাতি এর সুফল ভোগ করবে, আমাদের উন্নয়ন ও উন্নতি স্থায়ী হবে।

 

 

 শিক্ষাই যে উন্নতির একমাত্র মাধ্যম তা আমরা সর্বশেষ জাপানের দিকে তাকালেই বুঝি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখন জাপান সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থান থেকে ঘুরে দঁাড়ানোর জন্যে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে জাপান আজকে উন্নত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত থাকলেও বাংলাদেশে এর লেশমাত্র নেই। সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অগ্রগতিতে শিক্ষা এবং শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার সময় এসেছে। জাতিকে শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর দঁাড় করাতে হলে শিক্ষা এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

 

 

 জার্মানিতে একজন শিক্ষককে চ্যান্সেলর পদমর্যাদা দেয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষকদের বেতন এবং সামাজিক মর্যাদা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির পরবর্তী স্থান। সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, দেশের যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার অর্ধেক অর্থ দিয়ে এই শিক্ষা জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করা সম্ভব। সদিচ্ছাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।  দেশের শিক্ষার সত্যিকার সংস্কার চাইলে শিক্ষা জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কোনো বিকল্প নেই। সরকার এক্ষেত্রে শিক্ষা জাতীয়করণে একটি কমিশন গঠন করে দিতে পারে। যদি একান্তই জাতীয়করণ সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করে দিতে পারে সরকার। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষকতার পেশাকে এক নম্বর পেশা হিসেবে ঘোষণা করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।  

সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইামচর, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়