প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
চাঁদপুরে অধিক মুনাফার আশায় বাজারে সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। ফলে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমের শুরুতেই ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট সারের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রান্তিক কৃষকরা তাদের জমিতে সার দিতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সার সংকটের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন রাসায়নিক সারের জেলাওয়ারি মাসভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী সারের সংকট রয়েছে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেলেও, সংশ্লিষ্টরা বলছেন জেলায় সারের কোনো সংকট নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি মূল্য অনুযায়ী প্রতি কেজি টিএসপি সার ২২ টাকা, এমওপি/পটাশ সার ১৫ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকা, ইউরিয়া ১৬ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু জেলার আটটি উপজেলার অধিকাংশ সারের ডিলার, সাব ডিলাররা টিএসপি সার বিক্রি করছে ২৫/৩০ টাকা, এমওপি ২০/২২ টাকা, ডিএপি ১৮/২০ টাকা, ইউরিয়া ১৮/২১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। দুই মাস আগেও এক বস্তা ইউরিয়া সার ৮০০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন এর দাম ৯৫০ থেকে ১১০০ টাকা। অনেক জায়গাতেই দেখা মিলছে না পটাশ সার। কয়েক জায়গায় এমওপি/পটাশ সার পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। বহু জায়গায় টিএসপি সারের সংকটও তীব্র।
কৃষকরা বলছেন, সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন। তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু ডিলার দোকানে মূল্য তালিকা টাঙিয়ে রাখলেও সেই অনুযায়ী বিক্রি করছেন না। এমনকি তালিকায় সারের মূল্য লিখছেন না। বিক্রেতারা সরকারি দলের রসিদ দিলেও বাড়তি দরের রসিদ দিচ্ছেন না। প্রতিবাদ করলে সার বিক্রি করবেন না স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। ক্রেতার কাছে বিক্রি করা সার কেড়ে নিয়ে রেখে দিচ্ছেন অধিকাংশ ডিলার। সরকার বিভিন্ন সারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও সেই দামে সার বিক্রি করছেন না অনুমোদিত বিএসইসি ডিলাররা এমন অভিযোগ প্রান্তিক কৃষকদের। যার কারণে সার ডিলার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে জেলার আট উপজেলার হাজার হাজার প্রান্তিক কৃষক।
সম্প্রতি ডিলার সিন্ডিকেটের সীমাহীন অনিয়মের কারণে শাহরাস্তিতে বিভিন্ন সারের দোকানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে স্থানীয় প্রশাসন। শাহরাস্তি পৌরসভার ঠাকুর বাজারে বিভিন্ন সারের দোকানে এ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শিরীন আক্তার। এ সময় সার বিক্রয়ের লাইসেন্স ও মূল্য তালিকা না থাকায় একজন দোকানদারকে ২০ হাজার টাকা অর্থদ- প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন রাসায়নিক সারের জেলাওয়ারি মাসভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী চলতি জানুয়ারিতে জেলায় ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে ছয় হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন। চাহিদা অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন। উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দকৃত চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৯৫০, মতলব উত্তরে ৫৯০, মতলব দক্ষিণে ২৬৫, হাজীগঞ্জে ৬১৫, শাহরাস্তিতে ৬৬০, কচুয়ায় ৯৯১, ফরিদগঞ্জে ৫৮০ ও হাইমচর উপজেলায় ১০৫ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে দুই হাজার ২৭৪ মেট্রিক টন সার কম বরাদ্দ রয়েছে।
অপরদিকে জেলায় টিএসপি সারের চাহিদা রয়েছে এক হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন। চাহিদা অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার ৮৭ মেট্রিক টন। উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দকৃত চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৫২ মেট্রিক টন, মতলব উত্তরে ১০৫, মতলব দক্ষিণে ৩২, হাজীগঞ্জে ১৮৬, শাহরাস্তিতে ৮০, কচুয়ায় ৩৬৪, ফরিদগঞ্জে ২৫০ ও হাইমচর উপজেলায় ১৮ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে ৬৫৫ মেট্রিক টন সার কম বরাদ্দ রয়েছে।
ডিএপি সারের চাহিদা রয়েছে এক হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন। চাহিদা অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার ৬৬৫ মেট্রিক টন। উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দকৃত চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৮৩, মতলব উত্তরে ৩৯০, হাজীগঞ্জে ১৮৫, শাহরাস্তিতে ৭৫, কচুয়ায় ৬১৫, ফরিদগঞ্জে ২৯০ ও হাইমচর উপজেলায় ২৭ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে ১২৫ মেট্রিক টন সার কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে দুই হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। চাহিদা অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দ রয়েছে ৮৭৭ মেট্রিক টন। উপজেলাওয়ারি বরাদ্দকৃত চাঁদপুর সদর উপজেলায় ২২, মতলব উত্তরে ১৮০, মতলব দক্ষিণে ১২, হাজীগঞ্জে ১৮৮, শাহরাস্তিতে ৮৮, কচুয়ায় ২০৭, ফরিদগঞ্জে ১৬০ ও হাইমচর উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে এক হাজার ৪৭৮ মেট্রিক টন সার কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জিপসাম সারের চাহিদা রয়েছে ৭৫১ মেট্রিক টন। চাহিদা অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দ রয়েছে ২৮০ মেট্রিক টন। উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দকৃত চাঁদপুর সদর উপজেলায় ১৫, মতলব উত্তরে ১৩৩, হাজীগঞ্জে ১১, শাহরাস্তিতে ১৮, কচুয়ায় ২২, ফরিদগঞ্জে ৯২ ও হাইমচর উপজেলায় ৯ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে ৪৭১ মেট্রিক টন সার কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা সূত্রে জানা গেছে, চলতি জানুয়ারিতে টিএসপি সারের জেলা ও মাসওয়ারি সরকারি বরাদ্দপত্রে জেলায় টিএসপি সারের চাহিদা এক হাজার ৮৭ মেট্রিক টন দেখানো হলেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, এলসি নম্বর, আমদানির তারিখ, মোকামের নাম, আমদানিকৃত সারের পরিমাণ উল্লেখ না থাকলেও বিএডিসিকে ৯৬৭ মেট্রিক টন ও বিসিআইসিকে ১২০ মেট্রিক টন সার বরাদ্দের কথা উল্লেখ রয়েছে। জেলায় ডিএপি সারের চাহিদা এক হাজার ৬৬৫ মেট্রিক টন দেখানো হলেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ডাইরেক্ট ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড ০৭৩ নম্বর এলসিতে চীন থেকে এক হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার আমদানি করে বিএডিসিকে ৫৩২ মেট্রিক টন ও বিসিআইসিকে ১৩৩ মেট্রিক টন সার বরাদ্দের উল্লেখ রয়েছে।
এমওপি সারের চাহিদা দুই হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন দেখানো হলেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের নোয়াপাড়া ট্রেডিং ০০৬ নম্বর এলসিতে বেলারুশ থেকে এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন এমওপি সার আমদানি করে বিএডিসিকে ৮৭৭ মেট্রিক টন বরাদ্দ উল্লেখ রয়েছে।
চাঁদপুরের আট উপজেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ইরি-বোরো চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৫১ হাজার ৯৪৫ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে উন্নত ফলনশীল ৫১ হাজার হেক্টর চাষাবাদ এবং হেক্টরপ্রতি ৪১০ মেট্রিক টনে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৯ হাজার ১০০ মেট্রিক টনে হাইব্রিড ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর চাষাবাদ এবং হেক্টরপ্রতি ৪৯৫ মেট্রিক টনে উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন। উপজেলাভিত্তিক চাঁদপুর সদরে আবাদ পাঁচ হাজার ২৫০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২১ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন। মতলব উত্তরে আবাদ ৯ হাজার ১৩০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৭ হাজার ৭৮৬ মেট্রিক টন। মতলব দক্ষিণে আবাদ ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন। হাজীগঞ্জে আবাদ ৯ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ হাজার ৫৪৯ মেট্রিক টন। শাহরাস্তিতে আবাদ ১২ হাজার ২৩০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। কচুয়ায় আবাদ ১২ হাজার ২৩০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। ফরিদগঞ্জে আবাদ ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪১ হাজার ২২১ মেট্রিক টন। হাইমচরে আবাদ ৫৭০ হেক্টর এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দুই হাজার ২৬৬ মেট্রিক টন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া উপজেলার বিএসইসি অনুমোদিত সার ডিলারদের গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার মজুত রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য উপজেলায় অনুমোদিত বিএসআইসি ডিলাররা জানিয়েছেন, সারের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ সার মজুত রয়েছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা সূত্রে আরও জানা গেছে, জেলায় সার সংকট রয়েছে। যার কারণে সারের সংকট দেখিয়ে কৃষকদের জিম্মি করে ফায়দা লুটছে সংঘবদ্ধ ডিলার সিন্ডিকেট চক্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষিবিদ জানান, কৃষকের সারের চাহিদা পূরণ করতে একটি সুবিধাভোগী চক্র সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্তাব্যক্তির যোগসাজশে বাজারে নকল সার সরবরাহ করে কৃষকের সর্বনাশ করতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ জালাল উদ্দিন বলেন, জেলায় সারের সংকট নেই। কৃষকদের হাহাকার নেই। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সার ডিলার সিন্ডিকেটের কাজে জিম্মি প্রান্তিক কৃষক এই পরিস্থিতিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভূমিকা কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কোনো সার ডিলাররা অনিয়ম করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেব। সূত্র : শেয়ার বিজ।