প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত ক্যাশিয়ারের অঢেল অবৈধ সম্পদ
হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর আছেন গা ঢাকা দিয়ে
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার এসেসর /ক্যাশিয়ার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) গিয়াস উদ্দিন অবৈধভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আছে নগদ টাকাসহ রায়পুরে বিলাসবহুল বাড়ি ও দোকানপাটসহ ক্রয়কৃত সম্পত্তি।
মৃত কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নয়-ছয় করে এবং পৌরসভা কর্মচারীদের বেতন ও মাস্টাররোলের কর্মচারীদের ছাঁটাই করে বেতন আত্মসাৎ করে বানিয়েছেন এই অবৈধ সম্পদ। বিভিন্ন সময় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন নামে বেনামে সাধারণ মানুষ ও কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করলেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে চলছেন ভিআইপি হিসেবে। তার ২ ছেলে ও স্ত্রীসহ ছোট একটা পরিবার। ছোট ছেলে ফরিদগঞ্জ এ আর হাইস্কুলে পড়াশোনা করে। ছোট ছেলে ও স্ত্রী সহ থাকেন ফরিদগঞ্জের ভাড়া বাসায়। বড়ো ছেলে ঢাকা আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটিত পড়াশোনা করেন। সেখানে ভর্তি হতে খরচ হয় ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা এবং প্রতি সেমিস্টার ফি দিতে হয় ১ লক্ষ ২ হাজার টাকা করে। গড়ে প্রতি মাসে বড়ো ছেলের পিছনে ২০-২৫ হাজার খরচ হয়। ৪০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে বড়ো ছেলের পেছনে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।
লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার কেরোয়া গ্রামের দেওয়ানজি বাড়ির সন্তান এই গিয়াস উদ্দিন। বাড়ি থেকে সামনে এসে করেন ৪তলা বিলাসবহুল বাড়ি। প্রধান সড়ক দিয়ে তার গ্রামে ঢুকতে ডান পাশে মার্কেটসহ আছে আরো জমি। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পদত্যাগ করার পর গা-ঢাকা দেন তিনি।
২০০৮ সালে গিয়াস উদ্দিন ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় যোগদান করেন। যোগদানের পরই তিনি এই পৌরসভায় নিয়োগকৃত ক্যাশিয়ারকে বদলি করান এবং তৎকালীন মেয়রের মাধ্যমে তিনি ক্যাশিয়ার (অঃদাঃ/ভারপ্রাপ্ত)-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অদ্যাবধি তিনি উক্ত পদে বহাল আছেন। তিনি নিজেকে সকল ক্ষেত্রে ক্যাশিয়ার পরিচয় দিলেও তিনি একজন ছায়া মেয়রের মত জনসাধারণ ও সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে আচরণ করেন।
পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসন সহ সকল প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় এবং সকল কার্যক্রম অনলাইন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হলেও ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় তা হয় না। অত্র পৌরসভায় সকল ব্যয়ের চেক বাহক চেকের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোনো চেক একাউন্টপেয়ী হয় না। এ সকল কিছুর পেছনে কারসাজি ভারপ্রাপ্ত ক্যাশিয়ারের। তিনি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিম্মি করে রাখেন। যে কর্মচারী তার কথা শুনবে না তার বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে উল্টাপাল্টা নালিশ দিয়ে শোকজ, সাময়িক বরখাস্ত এমনকি বেতন বন্ধের ব্যবস্থা করেন।
২০২১ সালে নতুন পৌর পরিষদ গঠন হওয়ার পর সরকারি নির্দেশ মোতাবেক মাস্টাররোলের কর্মচারী ছাঁটাই করেন। এদের বেশির ভাগের ১০-২০ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। বর্তমান পরিষদের কয়েকজন মাস্টাররোল কর্মচারীকে ছাঁটাই করেন। তাদের ৩-৬ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। সে টাকাও দেন না তিনি। এমনকি চৌকিদার মৃত আবুল কাশেমের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা মেয়রের নির্দেশ অমান্য করে ৬ বছরেও দেন নি। অফিস সূত্রে জানা যায়, কিছু টাকা বাজার খরচের মত দেন ক্যাশিয়ার। এখনো ৪ লাখ টাকা পরিবার পাবে, দেই-দিচ্ছি এমন করে ঘোরাচ্ছেন ক্যাশিয়ার।
২০২১-২২ সালে অর্থ বছরের শেষ সময়ে সরকারি অনুদানকৃত আটাশ লাখ টাকা উত্তোলন করে কর্মচারীদের আনুতোষিক ও ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও তিনি তা করেন নি। সরকারি বিধির তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট ভুয়া বিল-ভাউচার (পঁচিশ হাজার টাকার প্রজেক্ট) করে তিনি পৌরসভার অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে জানা যায়। নগর উন্নয়ন প্রকল্পের পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা গরমিলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সকল ক্ষেত্রে তার কমিশন বাণিজ্য আছে। পৌরসভা থেকে পাওনা বিল আনতে গেলে মানুষ তার কাছে ভিক্ষুকের মতো বসে থাকতে হয়। পৌরসভার ব্যাংক একাউন্ট ক'টি জানতে দেন না কাউকে। এমনকি একাউন্টে সকালে টাকা জমা দিলে বিকেলে থাকে না। সব সময় একাউন্ট খালি থাকে। বিভিন্ন সময় প্রকল্পের টাকার চেক দিলে ব্যাংকে গেলে বাহকরা দেখেন একাউন্টে কোনো টাকা নেই।
আবুল কাশেম, লুৎফুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল খালেক, আব্দুল মান্নান, হাবিব উল্ল্যা ও আফসার উদ্দিন মোল্লা নামের কর্মকর্তাদের নামে রাজস্ব তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা করে গোপনে লোন নেন ক্যাশিয়ার। এই কর্মকর্তারা লোনের ব্যাপারে জানেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। পরবর্তীতে এই কর্মকর্তারা নিজেদের প্রয়োজনে রাজস্ব থেকে লোন চাইলে এগুলো প্রকাশ পায়।
মাস্টার রোলের চাকরি ছেড়ে দেওয়া রোজিনা আক্তার জানান, গত বছর জুলাই মাসের ২৪ তারিখে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, ৬ মাসের বেতন পাবো। ক্যাশিয়ার বেতন দেন না। দেবো দেবো বলে আর খবর থাকে না। পিংকি নামে আরেক মাস্টার রোলের কর্মচারী ২ মাস ও আছমা আক্তার ৮ মাসের বেতন পাবেন, তারা পাচ্ছেন না তাদের বেতন।
আবু তাহের নামে আরেকজন মাস্টার রোলের কর্মচারী (ড্রাইভার) বলেন, আমি ১১ মাসের বেতন পাবো, ক্যাশিয়ার বেতন দিচ্ছেন না।
পৌরসভার প্রশিক্ষিত দুই উদ্যোক্তা ফখরুল আলম ও ফারজানা আক্তারকে চাকরিচ্যুত করেন ষড়যন্ত্র করে এই ক্যাশিয়ারসহ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় ৩০ মে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দলীয় প্রোগ্রামে গিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন গিয়াস উদ্দিন--এটা নিয়ে এনটিভিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হয়।
ক্যাশিয়ারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আজিজ নামে এক যুবক অভিযোগ করলেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ছাড় পেয়ে যান ক্যাশিয়ার। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে গত ১৮ বছরের সকল কিছু খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান ছাঁটাইকৃত কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ।
এদিকে ক্যাশিয়ার গিয়াস উদ্দিন ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে পালিয়ে রয়েছেন। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায় নি। সেজন্যে তার বক্তব্য জানা যায় নি।