সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ একটি অবিস্মরণীয় দিন

বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সালাহ্ উদ্দীন

অনলাইন ডেস্ক
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ একটি অবিস্মরণীয় দিন

আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা এস. এম. সালাহ্ উদ্দীন, পিতা মরহুম সিকদার আব্দুছ ছামাদ, মাতা মরহুমা বেগম ফিরোজা সামাদ, সিকদার বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা চত্বর, গ্রাম ও ডাকঘর-পশ্চিম চর কৃষ্ণপুর, সিকদার আব্দুছ ছামাদ সড়ক, উপজেলা-হাইমচর, জেলা-চাঁদপুর। চাঁদপুরের বাড়ি : সামাদ ভিলা, বাড়ি নং-০২, রহমতপুর আ/এ, নতুন বাজার, জেলা-চাঁদপুর, ৩৬০০। আমরা চার ভাই, চার বোন। আমি আমার বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। আমরা তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল মালেক ভূঞা আমাদের বাড়িতে অবস্থান করেন। আমার বাবা সহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক এলাকার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবকদের সংগ্রহ করে স্লিপ দিয়ে ট্রেনিং নেয়ার জন্যে ভারত পাঠাতে শুরু করেন। অন্যদিকে হাইমচর এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে বিডিআর, আর্মি, পুলিশ সদস্যদের দিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। এলাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। ফলে এলাকার শান্তি বজায় থাকে। এরই মধ্যে বৈশার হাট মেঘনা নদী থেকে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তিযোদ্ধাগণ একটি গম বোঝাই জাহাজ উদ্ধার করে নয়াহাট এলাকায় নিয়ে আসেন। এই খবর পেয়ে আবদুল মালেক ভূঞা, সিকদার আবদুছ ছামাদ মাস্টার, ইদ্রিস মিয়া বিএ, আহসান, আব্দুল্লা পাটোয়ারী, অলী উল্যা শেখ ফাজিল আখন, কাদির মাল, আমিনুল হক সিকদার, মুনসুর আখন, বারেক তপাদার, হাবিব উল্লা শেখ, রফিক পাটওয়ারী, রফিক ভূঞা, ডাঃ আঃ সালাম, যুগেশ চন্দ্র মাঝি, এম. এ. জব্বার, এস. এম. শাহজাহান, এস. এম. মেজবাহ উদ্দীন, আঃ ছাত্তার, এনায়েত উল্যা মিজি, মোঃ আলী পাটোয়ারী, বশির উল্যা কন্ট্রাক্টর, জিতু হাওলাদারসহ আমরা সাইকেল দিয়ে ও লোক মারফত চতুর্দিকে খবর পাঠিয়ে দেই। যাতে লোকজন এসে জাহাজের গমগুলো নিয়ে যায়। আমরা চটের বস্তা, চাদর ও লুঙ্গি মুড়িয়ে গমের বস্তা মানুষের মাথায় উঠিয়ে দিয়েছি। মানুষ দলে দলে এসে রাতের মধ্যেই গমগুলো নিয়ে জাহাজ খালি করে ফেলে।

আমার বাবা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। আমাদের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাগণ ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতেন। আমাদের কাটাখালী বাজারে এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাগণ কাজী সাহেব নামে একজন দালাল ও চাঁদপুর লোহার পুলের কালু সহ ৫ দুষ্কৃতকারীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে লাশ খালের মধ্যে ফেলে রাখে। এই অপারেশনের পর পাকহানাদার ও রাজাকাররা আক্রমণ করতে পারে এমন আশঙ্কায় গন্ডামারা এলাকায় একটি শক্ত ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে কাটাখালীর দালালরা, নয়াহাট এলাকার ঘৃণিত রাজাকার ভ্রাতৃদ্বয় ও হাইমচর এলাকার দালালচক্র পাকহানাদার বাহিনীকে নিয়ে আসে। কাটাখালী বাজারে মুকবুল হোসেন পাটোয়ারীকে গুলি করে হত্যা করে এবং জননেতা আবদুল্যা সরকারের বাড়ি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চাঁদপুর থানা কমান্ডার সৈয়দ আবেদ মুনসুর সাহেব চরভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই ক্যাম্প থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য অপারেশন করি। এই ক্যাম্প থেকে দুর্গাদীতে একটি ক্যাম্প করা হয়। দুর্গাদী ক্যাম্প থেকে বাঘড়া ও টুবগি যুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করি। বালিয়ার চেয়ারম্যান আঃ মান্নান খান ও আঃ রব তপাদার সাহেবগণ ক্যাম্পের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এরই মধ্যে পুরাণবাজার মধুসূদন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের কর্নারে দালাল মোঃ আলীকে তার দোকানে তাহের হোসেন রুস্তম ভাই গুলি করে হত্যা করে ক্যাম্পে ফিরে আসা ছিলো এক বিরাট সফলতা। যতই দিন যাচ্ছিল, পাকহানাদার ও রাজাকাররা হতাশ হয়ে পড়ে।

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাকুল হায়দার সিমু খানদের বাড়িতে অবস্থান নেই। এক পর্যায়ে চাঁদপুর মুক্ত করার সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারি। ইচলী, ঢালিরঘাট, পুরাণবাজার এলাকা দিয়ে চাঁদপুর আক্রমণের পরিকল্পনা হয়। বিকেলে কমান্ডার তাহের হোসেন রুস্তম ভাইয়ের নেতৃত্বে ৭০-৮০ জনের বাহিনী রওয়ানা হই। রাত ৯টার পূর্বে ইচলী ঢালির ঘাট এলকায় আসি এবং অ্যাম্বুশ করি। গভীর রাত পর্যন্ত কিছু গোলাগুলির শব্দ শুনি।

শীতের রাত যেন শেষ হয় না। তখন রাত ৩টা। রাজাকার দালালরা নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে পালাতে গিয়ে আমাদের হাতে ধরা পড়ে। তারা হাত উঁচু করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, পাকিস্তান আর্মিরা পালিয়েছে। আমাদের বাঁচান স্যার। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ ছিলো। চতুর্দিকে ফরসা হয়ে উঠছে। কমান্ডার তাহের হোসেন রুস্তম আমাদেরকে ফলোআপ করালেন এবং প্রস্তুত হয়ে নৌকায় উঠতে বললেন। আমরা নদী পার হয়ে ইচলী থেকে কোল্ড স্টোর হয়ে বি.আই.ডব্লিউ.টি.এ’র লন্ডনঘাট দিয়ে নতুন বাজার, ছায়াবাণী, চিত্রলেখা হয়ে হোটেল আকবরীতে উঠি। পথিমধ্যে রাস্তার দুপাশে মানুষের মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পরিবেশকে মুখরিত করে। কেউ কেউ পড়ে থাকা অস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যাচ্ছিলো। সকালের নাস্তা বেশ ভালোভাবেই খেলাম। আমাদের চাঁদপুর থানা কমান্ডার সৈয়দ আবেদ মুনসুর সাহেব এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ৫নং ঘাট দিয়ে নতুন বাজারে প্রবেশ করেন এবং হোটেল আকবরীতে উঠেন। এক পর্যায়ে আমাদেরকে মার্চ করতে বলেন। আমরা কুমিল্লা রোড দিয়ে কালীবাড়ি মোড় হয়ে এসডিও’র বাংলায় যাই। বাংলোতে ঢুকেই খুনি ইয়াহিয়ার টাঙ্গানো ছবিটি ব্রাশ ফায়ার করেন তাহের হোসেন রুস্তম। এসডিও মোঃ আলী লাফিয়ে উঠে হতভম্ভ হয়ে পড়েন। চতুর্দিকে চিৎকার পড়ে যায়।

আমরা পাকিস্তানী পতাকা জ্বালিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে চাঁদপুরকে মুক্ত ঘোষণা করি। সেই দিনটি ছিল ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সেই বিজয় বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ হলেন : চাঁদপুর থানা কমান্ডার সৈয়দ আবেদ মুনসুর, সোলায়মান খান বাদল, তাহের হোসেন রুস্তম, আবুল হোসেন ঢালী, দীন মোঃ বকাউল, সফিকুর রহমান মন্টু, নজরুল ইসলাম বাবলু, রাজ্জাকুল হায়দার খান, মোঃ হোসেন, মোঃ হাসান, মহিউদ্দীন পাটোয়ারী, এমদাদ হোসেন, আবু নঈম দুলাল পাটোয়ারী, ছানা উল্যা খান, দেলোয়ার হোসেন নান্নু পাটওয়ারী, মাওলানা ইদ্রিস, দেলোয়ার হোসেন পাটওয়ারী, এস. এম. শাহজাহান, এস. এম. মেজবাহ উদ্দীন, আবু তাহের টেলু, খালেক গাজী, সৈয়দ আহম্মদ বেগ, আবুল কালাম আযাদ, সরোয়ার হোসেন, মোঃ আলী পাটওয়ারী, আঃ রাজ্জাক, সুনিল দাস, ডাঃ আঃ খালেক, আঃ বাতেন, তবারক, গোলাম রাব্বানী সহ আরো অনেকে। এই বিজয় বাহিনীর একজন হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।

দুপুরের খাওয়ার জন্যে আমরা হোটেল সফিনা যাই এবং খাওয়া শেষ করে গল্প করি। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনি। কিছুটা বিব্রত হই। হোটেলের জানালা দিয়ে নদীর ঘাটে তাকিয়ে দেখি দালাল ইয়াসিনের রক্তাক্ত শরীর কাতরাচ্ছে। আর কমান্ডার মমিন খান মাখন দৌড়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে হোটেলে ঢুকতেছে। এই দৃশ্য দেখে আমরা চুপ হয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ডার হলো হোটেল আকবরী ক্যাম্পে চলে যাওয়ার জন্যে। আমরা ক্যাম্পে চলে গেলাম। ইতোমধ্যে অন্যান্য বাহিনীর কমান্ডারগণ নিজ নিজ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করি। শুরু হয়ে গেল রাজাকার, দালাল ধরা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। আমরা তা যথাযথভাবে পালন করেছি। যতই সময় যাচ্ছিল ততই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছিলো। আমিরাবাদ লজ, হাকিম ভিলা, মীর মহল ও পুরাণবাজার মান্না টোবাকোর বাড়ি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করি। ঔষধের গোডাউন ছিল হোটেল মেরিনা।

আমাদের চাঁদপুর থানা কমান্ডার সৈয়দ আবেদন মুনসুর একজন আদর্শবান কমান্ডার ছিলেন। তাঁর দৃঢ়তা ও সাহস তখন খুবই উপযোগী ছিল। আমি তাঁর নেক হায়াৎ ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। ইদানিংকালে কোনো কোনো লেখক ঐতিহাসিক ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত দিবস নিয়ে বিতর্ক করেন। তাতে আমরা খুবই কষ্ট পাই। আমি প্রথমত তা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করছি। আমার বক্তব্য হচ্ছে ‘৮ ডিসেম্বর ১৯৭১’ কে কোথায় ছিলেন তা স্বীকার করে নিয়ে নিলে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ চাঁদপুর মুক্ত দিবস এ সত্যটি প্রমাণিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ মহান স্বাধীনতার স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে সপরিবারে হত্যা করে, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে জেলাখানায় হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছিল দুষ্কৃতকারীরা। ভুল/ভুয়া ইতিহাস জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ঠকানো হবে।

আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার, জাতীয় ৪ নেতাসহ সকল শহিদের, ইতোমধ্যে কবরবাসী মুক্তিযোদ্ধাগণের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং জীবিত সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার নির্যাতিত মা-বোনদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে দেশবাসীকে চাঁদপুর মুক্ত দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

লেখক পরিচিতি : এস এম সালাহ্ উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, উপদেষ্টা, জেলা আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর।

ফোন : ০২৩৩৪৪৮৫২৬৪, ০১৮১৯-৮৪০০৮৫

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়