বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুরে রাজনৈতিক মামলায় আসামীদের আটক অভিযান অব্যাহত। যুবলীগ, কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ নেতা-কর্মী আটক
  •   ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল যুবকের
  •   চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
  •   রাজধানীতে কচুয়ার কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনা
  •   সম্প্রীতির চমৎকার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশ --------------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

কেনো এতো মৃত্যু, কেনো এতো লাশ? অনুসন্ধান-০৬

রাতের বেলা বহিরাগত লোক দিয়ে চলে করোনা ইউনিট , বন্ধ থাকে জরুরি বিভাগ

রাতের বেলা বহিরাগত লোক দিয়ে চলে করোনা ইউনিট , বন্ধ থাকে জরুরি বিভাগ
রাসেল হাসান ॥

৭ আগস্ট রাতে শাহরাস্তি উপজেলার মেহের দক্ষিণ ইউনিয়নের ভোলদিঘি গ্রামের পূর্ব পাড়ার দিকে হুঁইসেল বাজিয়ে একটি লাশের গাড়ি যায়। গাড়িটির পিছু নেয় চাঁদপুর কণ্ঠ টিম। গাড়িটি গিয়ে থামে ‘নতুন বাড়ি’র সামনে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে এক তরুণী কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখা যায়। চিৎকার করে বলছিলেন, ‘তুমি অক্সিজেনের লাইগা কত কষ্ট পাইছো গো আম্মু....’।

জানা যায়, অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হওয়া লাশের নাম হাসিনা বেগম। কান্না করা তরুণী তারই ছোট মেয়ে সামিয়া ফেরদৌস।

বেঁচে থাকাকালীন হাসিনা বেগম অক্সিজেনের জন্যে কিভাবে কষ্ট পেয়েছিলেন? কোথায় গিয়েছিলেন অক্সিজেনের জন্যে? কেনো তিনি পাননি অক্সিজেন সেবা? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে অনুসন্ধানে নামে চাঁদপুর কণ্ঠ টিম। ৭ দিন পর মিলেছে প্রশ্নের উত্তর। বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য। যা নিয়ে থাকছে আজকের অনুসন্ধান-০৬।

৭ দিনে মাকে হারানোর শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠলে ১৪ আগস্ট চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে কথা বলা হয় সামিয়া ফেরদৌসের সাথে। জানান, শ^াসকষ্ট বাড়ায় ১ আগস্ট হাসিনা বেগম (৪৪)কে নিয়ে যাওয়া হয় শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হাসিনা বেগমের ভাই তাকে ভর্তি করানোর জন্যে অনুরোধ করেন, কিন্তু জরুরি বিভাগ থেকে ডাক্তার তাকে ভর্তি করাননি। বলেছিলেন, রোগীর অবস্থা ভালো, তাকে বাড়িতে রেখে ট্রিটমেন্ট দেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো যাবে না।

বাড়ি ফিরে আসলে আগের চেয়ে আরও বেশি বেড়ে যায় হাসিনা বেগমের শ্বাসকষ্ট। পরদিন ২ আগস্ট আবারো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন ভর্তি করানো হলেও দেয়া হয়নি অক্সিজেন। হাসপাতালের দক্ষিণ পাশের আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় করোনা ইউনিটে বেড পান হাসিনা বেগম। তার মেয়ে বহুবার মূল ভবনের জরুরি বিভাগে এসে মায়ের জন্যে অক্সিজেন চাইলেও স্টক সীমিত বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো। রাত ১০টায় রোগীর অক্সিজেন পালস ৭৫-এর নিচে নেমে যাওয়ায় দেয়া হয়েছিলো একটি সিলিন্ডার। অক্সিজেন পেয়ে শ্বাসকষ্ট স্বাভাবিক হয় রোগীর। রাত ১টায় শেষ হয় সিলিন্ডারের অক্সিজেন। আবার বাড়তে থাকে হাসিনা বেগমের শ্বাসকষ্ট। করোনা ইউনিটে তখন শুধুই রোগী আর রোগীর স্বজন। কোথাও কোনো ডাক্তার বা নার্স নেই। নেই হাসপাতালে কর্মরত কোনো স্টাফ।

আধাঘণ্টা পর সামিয়া ফেরদৌসের চিৎকার শুনে ছুটে আসে এক যুবক। জানান তিনি করোনা ইউনিটের দায়িত্বে আছেন। কী সমস্যা তাকে বলতে। সামিয়া বলেছিলেন, তার মায়ের অবস্থা খারাপ, অক্সিজেন শেষ। আরেকটি সিলিন্ডার দিতে হবে। সামিয়ার কথায় কর্ণপাত করেননি করোনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা যুবক, বরং এতো রাতে চিৎকার দেয়া হলো কেনো তার জন্যে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন সামিয়া ফেরদৌসের সাথে।

সামিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি সরকারি চাকরি করেন। রাতে ডিউটি করাইতো আপনার দায়িত্ব। আমার আম্মু মারা যাচ্ছেন, আপনাদের কাউকে না পেলে চিৎকার করবো না? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি কোনো সরকারি চাকরি করি না। হাসপাতালের কোনো স্টাফও না। হাসপাতালে স্টাফের অভাব দেখে আমাকে রাতে নিয়ে আসে ডিউটি করার জন্যে। আমি জেগে আছি এটাই অনেক, আপনি আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে পারেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা এই যুবকের নাম জহিরুল ইসলাম। হাসপাতালের নৈশ প্রহরী নূরুল আমিন নূরুর ছেলে তিনি। জহির হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন। রাতে করোনা ইউনিটের রোগীদের দেখা ও অক্সিজেন সরবরাহের জন্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে দায়িত্ব দিয়ে থাকে।

রাত দেড়টায় দীর্ঘক্ষণ ঝগড়ার পর একটি সিলিন্ডার নিয়ে করোনা ইউনিটে আসেন জহির। হাসিনা বেগমের পালস মেপে দেখেন পালস ৬৫ থেকে ৬৮-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। পালস মাপার সময় হাসিনা বেগম হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলেন, তোর বাবা নুরু ভাই কতো ভালো মানুষ। তুই এতো বেয়াদব হলি কেন? তোর বাবাকে নিয়ে আয়। কেন এমন ব্যবহার করছিস আমাদের সাথে? রোগীর কথাগুলো পছন্দ হয়নি করোনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা জহিরুল ইসলামের। তাই জিদ দেখিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি রোগীর মুখে না লাগিয়ে ছুড়ে ফেলে চলে যান ইউনিট থেকে।

পুরো বিল্ডংয়ের কোথাও কোনো নার্স নেই, স্টাফ নেই। বহিরাগত যে যুবক দায়িত্বে ছিলো সেও চলে গেলো রাগ দেখিয়ে। এতো রাতে কে লাগাবে হাসিনা বেগমের মুখে অক্সিজেন? শ্বাসকষ্ট ক্রমেই বাড়তে থাকায় হাসিনা বেগমের ভাই ইউটিউব থেকে অক্সিজেন কীভাবে রোগীর মুখে লাগাতে হয় তা শিখে সেটিং করেন অক্সিজেন। রাত ২টায় অক্সিজেন পেয়ে আবারো শান্ত হলেন তিনি।

দু ঘণ্টাতেই ফুরিয়ে যায় সিলিন্ডারের অক্সিজেন। রাত ৪টায় আবারো শ্বাসকষ্ট বাড়ে হাসিনা বেগমের। অক্সিজেন পালস মেপে দেখেন ৬৫ থেকে ৭০-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে করোনা ইউনিটের বাইরে আসেন সামিয়া ফেরদৌস। ‘কেউ আছেন? কেউ আছেন?’ বলে গলা ফাটালেও সাড়া দেননি কেউ। বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টিতে ভিজে আবাসিক ভবনের ২য় তলার করোনা ইউনিট থেকে মাঠের অপর পাশের মূল ভবনে যান সামিয়া। ভবনের নিচতলায় জরুরি বিভাগ। সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার নিয়ম থাকলেও জরুরি বিভাগের রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিলো। বারবার দরজায় আঘাত করার পরও সাড়া মিলেনি ভেতর থেকে। এবার দৌড়ে যান মূল ভবনের ২য় তলায়। নার্সদের ডিউটি রুমে গিয়ে দেখেন সেই রুমের দরজাও আটকানো। অনেকক্ষণ দরজায় আঘাত করার পরও কোনো সাড়া মিলেনি। বুঝা গেলো দায়িত্বরত নার্সরা গভীর ঘুমে মগ্ন। সামিয়া ফেরদৌস বৃষ্টিতে ভিজে আবার ছুটে গেলেন আবাসিক বিল্ডিংয়ের ২য় তলায় করোনা ইউনিটে। গিয়ে দেখলেন তার মা বড় বড় দীর্ঘশ^াস ফেলছেন। সামিয়া তার মামাকে বলে দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে অক্সিজেনের জন্যে ফোন করালেন। একটি সংগঠন বলেছিলো গ্যাস শেষ, রিফিল করাতে হবে। অপরটি বলেছিলো, তারা হাসপাতালে অক্সিজেন সার্ভিস দেয় না, শুধু বাড়িতে দেয়।

এভাবে কেটে গেলো ১ ঘণ্টা। হাসিনা বেগমের শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ছেই। সামিয়া আবার ছুটে গেলেন মূল ভবনের জরুরি বিভাগে। ভাবলেন ভোর ৫টায় ফজর কেন্দ্রিক কেউ হয়তো জাগবেন ঘুম থেকে। এবারো দরজা বন্ধ। ‘ভেতরে কেউ আছেন? আমার আম্মু অসুস্থ, অক্সিজেন লাগবে। আছেন কেউ ভিতরে...’ কথাগুলো বলতে বলতে সামিয়া ফেরদৌস দরজায় একের পর এক আঘাত করে গেলেন। কোনো সাড়া নেই। এবার সামিয়া পাগলের মত আশেপাশে যেখানে দরজা পেয়েছেন সেখানেই আঘাত করেছেন। না নার্স, না স্টাফ কারো দেখা মিলেনি সে রাতে।

ভোর সোয়া ৫টার দিকে জরুরি বিভাগের বিপরীত পাশের রুম থেকে একজন স্টাফ চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে বললেন, ‘এত চিল্লাচ্ছেন কেন? কী সমস্যা?’ সামিয়া বলেছিলেন, অক্সিজেন দিন, আম্মু অসুস্থ। ছেলেটি পুরো বর্ণনা না শুনেই বললেন, হাসপাতালের স্টকে অক্সিজেন নেই, দেয়া যাবে না। সামিয়া ছেলেটির পায়ে ধরার বাকি ছিলো। হাত জোড় করে বলেছিলেন, দেন না ম্যানেজ করে। হাসপাতালের সেই স্টাফ বলেছিলেন, স্টকে আর মাত্র ২টা সিলিন্ডার আছে। গুরুতর অসুস্থ ভিআইপি কেউ চলে আসলে তাদেরকে দিতে হবে। সামিয়া শেষবারের মত বলেছিলেন, আমার আম্মুইতো গুরুতর অসুস্থ, উনাকে দিন না একটা সিলিন্ডার। সেই স্টাফ বলেছিলেন, আপনার আম্মার চেয়েও গুরুতর কেউ চলে আসলে তাকে কী দিমু?

সামিয়া ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন ডাক্তার-নার্স শূন্য আবাসিক ভবনের করোনা ইউনিটে। কাছে যেতেই হাসিনা বেগম বলেছিলেন, ‘তোরা কি আমাকে অক্সিজেন দিবি না? এভাবে মেরে ফেলবি? যেখান থেকে পারিস অক্সিজেন নিয়ে আয়। আমারে বাঁচা।’ চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে সকালে স্বেচ্ছায় নাম কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো হাসিনা বেগমকে। ফোন করা হলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সজাগ ফাউন্ডেশনকে। তারা টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অক্সিজেন সেবা দিলেন হাসিনা বেগমকে। এভাবে চললো দুদিন।

৫ আগস্ট হাসিনা বেগমের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে আর নেয়া হয়নি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এবার নিয়ে যাওয়া হলো কুমিল্লা সরকারি জেনারেল হাসপাতালে। পথেই দুর্বল হয়ে পড়েন হাসিনা বেগম। কুমিল্লা হাসপাতালে দুদিন অক্সিজেন সাপোর্টে থেকেও তার পালস ৬০-এর উপরে না উঠায় ৭ আগস্ট নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অক্সিজেন পালস নেমে গেছে ৫০-এর নিচে। ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে হাইফ্লো অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়েও পালস উঠাতে পারেননি চিকিৎসকরা। ৭ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টায় মারা যান হাসিনা বেগম।

সামিয়া ফেরদৌস চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, উপজেলা হাসপাতালেই যদি আমার আম্মু প্রোপার ট্রিটমেন্ট পেতেন তাহলে আর মূমুর্ষূ অবস্থায় ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হতো না। আমার আম্মুর মত আর যেনো কোনো মা এভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত না হয়। করোনা ইউনিটের বহিরাহত ছেলেটির বাজে আচরণ আমার আম্মু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলেননি, ভুলবো না আমরাও।

কথা বলা হয় করোনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা জহিরুল ইসলামের সাথে। ২ আগস্ট রাতে রোগীর সাথে কথা কাটাকাটি ও রাত দেড়টায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেলে চলে আসার কথা স্বীকার করেন তিনি। বলেন, রোগী আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলায় আমার জিদ উঠে গিয়েছিলো। তাই চলে এসেছি। কারণ আমি হাসপাতালের বেতনভুক্ত কর্মচারী নই যে, কারো ধমক শুনবো। তবে ফিরে এসে ডিউটি নার্স যিনি ছিলেন তাকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, রোগীর অক্সিজেন রেখে চলে এসেছি। আমি আর ওই ইউনিটে যাবো না। আপনি কি গিয়ে দেখবেন? আমাকে মাসি (নার্স) বলেছিলেন, ‘তোর এত জ্বলে কেন রোগীর জন্য, মাত্র না রাগারাগি করে আসলি? বসে থাক চুপচাপ।’

জহিরুল ইসলামের কথার সূত্র ধরে কথা বলা হয় ২ আগস্ট রাতে হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা নার্সের সাথে। ডিউটি রোস্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, সে রাতে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিউলী রাণী সরকার। তিনি বলেন, জহিরুল আমাকে রাতে সিলিন্ডার ফেলে আসার কথাটি জানিয়েছে সত্যি, কিন্তু ‘তোর এতো জ্বলে কেন? চুপচাপ বসে থাক’ এ ধরণের কোনো কথা আমি বলিনি।

রাত ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত যে মূল ভবনের ২য় তলার ডিউটি নার্সদের রুম বন্ধ ছিলো তাও স্বীকার করেছেন তিনি। জানান, আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় পাশের রুমে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ‘যেহেতু আপনি নাইট ডিউটিতে ছিলেন। রাতে করোনা ইউনিটের দায়িত্বও আপনারই ছিলো। হাসিনা বেগমকে প্রথম অক্সিজেন দেয়ার পর রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা এই ৭ ঘণ্টায় আপনি একবারের জন্যও করোনা ইউনিটে গিয়েছিলেন?’ -এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না যাইনি। আমি এদিকে ব্যস্ত ছিলাম। আমরা তিনজন মানুষ কত দিকে সামলামু? তবে জহির অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেলে আসা ও তার সাথে রোগীর কথা কাটাকাটির ঘটনাটি আমি জরুরি বিভাগের ডিউটি ডাক্তার শাকিল স্যারকে জানিয়েছি।

জরুরি বিভাগের ডিউটি ডাক্তারকে নার্স ঘটনাটি জানানোর পরও কেন তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি তা জানতে কথা বলা হয় ডাঃ শাকিলের সাথে। তিনি জানান, এ ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। ডিউটি চলাকালীন সে রাতে তিনি কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে ডাক্তার শাকিল বলেন, আমার বাসা কাছেই, হয়তো বাসায় ছিলাম। জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা বসে থাকা বাধ্যতামূলক নয়। আপনার কিছু বলার থাকলে ইউএইচও স্যারকে বলুন।

হাসপাতালে কর্মরত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ নাসির উদ্দিন চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, গত মাসে হাসপাতালে অক্সিজেন ঘটতি থাকলেও চলতি মাসে হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। বর্তমানে হাসপাতালে ৪৭টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ২টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে। করোনা বেড রয়েছে ২৪টি। ২ আগস্ট রাতে হাসপাতালে অক্সিজেন ঘাটতি ছিলো না বলেও নিশ্চিত করেছেন তিনি। সে রাতে হাসিনা বেগমের সাথে যা ঘটেছিলো তা খুলে বলার পর তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাকে কেউ কমপ্লেইন করেননি। আমি দেখছি কী করা যায়।

হাসপাতালে বহিরাগতদের দিয়ে করোনা ইউনিট পরিচালনার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি। বলেন, জহির হাসপাতালের নৈশপ্রহরী নূরুর ছেলে। আমাদের হাসপাতালের বেতনভুক্ত কোনো কর্মচারী নয়। সে ওয়ার্ডে ডিউটি করে কাজ শিখছে। রাতের বেলা ডিউটি নার্স ও জরুরি বিভাগের কক্ষ ভিতর থেকে বন্ধ থাকা, রাতে স্টকে অক্সিজেন নেই বলে ভুল তথ্য দেয়া ও ভোরে অক্সিজেন থাকার পরও রোগী সেবা না পাওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

বিষয়টি চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহকে জানালে তিনি বলেন, এ ধরণের ঘটনা আমার আগে জানা ছিলো না। বিষয়টি আমি আমলে নিলাম। সবগুলো বিষয় আমি নিজস্বভাবে খবর নিবো। ভবিষ্যতে যেনো কোনো রোগী এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয় তার সব রকম ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।

একটি লাশের গাড়ি আর গাড়ি থেকে বের হওয়া তরুণীর কান্নার একটি লাইনের সূত্র ধরে বেরিয়ে এলো উপজেলার একটি সরকারি হাসপাতালের রাতের বেলার চিত্র। একজন হাসিনা বেগমের মৃত্যুর পেছনের হৃদয়বিদারক কাহিনী সামনে আনা হলো। আরো কত হাসিনা বেগম রাতের বেলা এমন চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬ জন। সেই ৬ জনের মৃত্যুর পেছনে এমন কোনো ঘটনা লুকিয়ে নেইতো?

করোনা ইউনিটে যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন রোগী। বাড়তে পারে শ^াসকষ্ট, লাগতে পারে অক্সিজেন সেবা। অথচ সেই ইউনিট চালানো হচ্ছে বহিরাগত এক শিক্ষানবিশ যুবককে দিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটটি একটি পৃথক ভবনে রেখে আরেক ভবনে ডাক্তার নার্সদের দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর ঘটনাটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এড়িয়ে গেলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যাবেন কি-না তা সময়ই বলে দিবে। জেলায় করোনা ও উপসর্গে ‘কেনো এতো মৃত্যু, কেনো এতো লাশ?’ -এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে চাঁদপুর কণ্ঠ। উত্তরে যা বেরিয়ে এলো, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তার সমাধান করতে না পারলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে। (সমাপ্ত)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়