প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে রোগীর চাপ অব্যাহত
অক্সিজেনের সকল ব্যবস্থা সচল থাকার পরও সামাল দেয়া যাচ্ছে না
২৪ ঘণ্টায় রোগী সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়েছে ৭৬, মারা গেছে ৮, এরপরও ভর্তিকৃত রোগী ১৬৮
আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে এখনো প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকছে ২শ’র উপরে। অথচ শয্যা আছে ১২০। ফ্লোর, বারান্দা, ওয়ার্ডের ভেতরে মাঝখানে হাঁটাচলার পথ সব জায়গায়ই রোগী। আর এ সব রোগী হচ্ছে কোভিড ও সাসপেক্টেড তথা করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে বেশিরভাগ রোগীই খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসে। হাসপাতালের এখন বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এমন-দিনের একবেলা রোগীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও পরের বেলা আবার বেড়ে যায়। দিনের প্রথমভাগে সুস্থ হয়ে যে পরিমাণ রোগী বিদায় নেয়, পরের বেলা আবার সে পরিমাণ রোগী ভর্তি হয়ে যায়। কোনো কোনোদিন ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর চেয়েও নতুন ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি হয়। এটাই এখন আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের বর্তমান হাল। আর সে জন্যই অক্সিজেনের সকল ব্যবস্থা সচল থাকার পরও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ সকল রোগীকে চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া যাচ্ছে না। যার কারণে খুব খারাপ অবস্থায় আসা রোগীরা তাৎক্ষণিক অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
|আরো খবর
চারতলা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালটিকে আড়াইশ’ শয্যার বলা হলেও বাস্তবে এর অবকাঠামো হচ্ছে ২শ’ শয্যার। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটি এখানে ২৫০ শয্যা স্থাপন করেছে এবং ২৫০ শয্যা হিসেবেই হাসপাতালটি চলছে। এই ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির চতুর্থ তলার পেইং ব্লক এবং কেবিন অংশ হচ্ছে মেডিকেল কলেজের জন্যে। বাকি অংশের ১২০ শয্যাই এখন করোনা ওয়ার্ডের জন্যে নির্ধারিত। আর এই ১২০ শয্যা হাসপাতালের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলাজুড়ে।
ঈদুল আজহার পর চাঁদপুরে করোনার অবস্থা এতোটাই খারাপ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, ১২০ শয্যায়ও রোগী সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ওয়ার্ডের সামনে খোলা জায়গায় যেখানে ডাক্তাররা বসতেন, সেখানেও সিট বসানো হয়েছে। দুই তলায় এমন খালি জায়গায় পাঁচটি করে দশটি সিট বসানোর পরও স্বস্তি নেই। ওয়ার্ডের ভেতরে মাঝখানে ফ্লোরে এবং দুই পাশের মাঝখানে হাঁটাচলার পথেও রোগী। বলতে গেলে রোগীতে ঠাঁসা। সিভিল সার্জনের তথ্য মতে রোববার এই হাসপাতালে স্থায়ীভাবে রোগী ভর্তি ছিলো ২শ’ ২২ জন।
হাসপাতালের আরএমও ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেলের সাথে গতকাল সন্ধ্যায় কথা হলে তিনি জানান, এদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৮ জনের মৃত্যুজনিত বিদায় এবং ৭৬ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাওয়াসহ মোট ৮৪ জন রোগী বিদায়ের পরও হাসপাতালে তখনো রোগী ভর্তি ছিলো ১৬৮ জন। ২টার পর থেকে রাত পর্যন্ত তো রোগী আরো ভর্তি হয়েছে। এসব হিসেব কষে বলা যায় এখনো প্রতিদিন হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে রোগী ভর্তি থাকে ২শ’ কি এর উপরে। এতো সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসক ও নার্সরা বলতে গেলে নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার এই চিকিৎসক এবং নার্সদের মধ্যেও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তারাই রোগী হয়ে যাচ্ছেন।
আরএমও আরো জানান, হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে যে সব রোগী ভর্তি হয় তাদের ৯৫ ভাগেরই অক্সিজেন সাপোর্ট লাগে। আর এর ৮০ ভাগ রোগীর লাগে হাই ফ্লোর সাপোর্ট। যার কারণে এই হাসপাতালে অক্সিজেনের সকল ব্যবস্থা চালু এবং সচল থাকার পরও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেনের সংকট থেকেই যাচ্ছে। আর সংকট বলতে তিনি রোগীর অবস্থা বুঝে তাৎক্ষণিক চাহিদা মতো অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে না পারাকে বুঝিয়েছেন। তিনি জানান, এই হাসপাতালে সম্প্রতি চালু হওয়া (শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির উদ্বোধনকৃত) লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট থেকে আইসোলেশন ইউনিটে লাইন দেয়া আছে (২য় ও ৩য় তলাসহ) ৬০টি। ষাটটির সব কটিই বর্তমানে চালু আছে। এছাড়া আবুল খায়ের গ্রুপের সিলিন্ডার অক্সিজেন এবং গত বছরে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সহযোগিতায় চালু হওয়া সিলিন্ডার অক্সিজেন সেন্টার থেকেও বোতল অক্সিজেন সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। এমন সিলিন্ডার (বোতল) অক্সিজেন বর্তমানে চালু অবস্থায় আছে ১৩০টি। এই ১৩০টি সিলিন্ডার দিয়েই হাই ফ্লো লাইনের বাইরে থাকা রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা এতো বেশি যে, এগুলো রিফিল করে কুলিয়ে উঠছে না।
তিনি আরো জানান, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্টের ষাটটি সংযোগ যে সব বেডে আছে, সে সব বেড এক মুহূর্তের জন্যও খালি থাকছে না। আর যাদের হাই ফ্লো অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন হয়, তাদেরকেই ওইসব বেডে দেয়া হয়। কিন্তু হাই ফ্লোর চাহিদা রোগীর সংখ্যাই বেশি। যার কারণে ওই ষাটটি বেডের বাইরে যে সব রোগী আছে, তাদেরকে সিলিন্ডার অক্সিজেনে কাভার দেয়া যাচ্ছে না। আর তাতেই অক্সিজেনের সংকট এখনো রয়ে গেছে বলতে হবে। তবে অক্সিজেন প্লান্টের ষাটটি সংযোগ ২৪ ঘণ্টা চালু থাকায় আগের চেয়ে সংকট অনেক কমেছে। এখন আগের মতো হাহাকার নাই। আগে দিনের মধ্যে অক্সিজেনের জন্য ফোন পেতাম এক শ'র মতো। আর এখন ৮/১০টা ফোন পাই।
এদিকে গতকাল সোমবার হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিট ঘুরে দেখা গেলো ডাক্তার এবং সেবিকারা বিরামবিহীনভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। দুপুর ১২টার সময় দ্বিতীয় তলায় দেখা গেলো হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ মোঃ নোমান হোসেন সব রোগীর কাছে কাছে গিয়ে রোগীর অবস্থা জানছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাঁর সাথে ছিলেন ডাঃ হাসিন মেহবুব এবং কয়েকজন নার্স। এ সময় ডাঃ নোমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বেশিরভাগই খারাপ রোগী আসছে। তাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশান খুবই কম থাকে। আর সে জন্যই বলতে গেলে সবারই হাই ফ্লো অক্সিজেনের সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা তো সম্ভব না।
এদিকে হাসপাতালের নিচতলায় আবুল খায়ের গ্রুপের সিলিন্ডার অক্সিজেন রিফিল করার রুমের সামনে এখনো অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্যে রোগীর স্বজনদের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। কোনো সময় ভিড় লেগে যায়। তবে আগের চেয়ে ভিড় অনেক কম।
সবশেষে চিকিৎসকসহ সকলের বক্তব্য একটাই- অক্সিজেন প্লান্ট আরো কয়েকটা বসিয়েও কাজ হবে না যদি রোগীর চাপ না কমে। আর রোগীর চাপ কমানোটা প্রত্যেকের নিজের উপর। আর সেটা হলো- করোনাকে নিয়ে খামখেয়ালি না করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।