প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আগস্ট দিয়েছে মুজিবের ঘরে এক অপার্থিব চাঁদের কণাকে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। আগস্টে জন্ম আগস্টেই মৃত্যু। বাঙালির জন্যে এ বড় হৃদয়বিদারক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল আগাগোড়াই সত্যিকার অর্থে একজন আদর্শ বাঙালি যুবক, যার চরিত্র মাধুর্যে সকল সদ্গুণাবলির সমন্বয় ঘটেছে। কিন্তু তৎকালীন সর্বহারা ও জাসদীয় রাজনীতির অপপ্রচারে তাকে খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরার অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তাঁকে ব্যক্তি শেখ কামাল হিসেবে পরিস্ফুটিত করার চেয়ে মুজিব-তনয় হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অধিক, যাতে তার বিরূদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাঁর পিতা মুজিবকে সহজে ঘায়েল করা যায়। ব্যাংক ডাকাতির অপবাদ কিংবা মেজর ডালিমের পত্নীকে লাঞ্ছিত করার যে অপপ্রচার তারা শেখ কামালের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছিল আজ কালের আবর্তে তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কারণ মিথ্যে কখনও দীর্ঘজীবী হয় না। সত্যের আলোয় একদিন ব্যক্তির জয় হবেই। মেধাবী ছাত্র শেখ কামাল ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হন। কিন্তু যে বিষয়টি তাঁর ব্যক্তিত্বকে মহৎ করে তুলেছে, তা হলো তাঁর ভদ্রতাজ্ঞান এবং প্রগতিশীলতা। তিনি সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বিভাগের কৃতী শিক্ষার্থী সমগ্র পাকিস্তানে সেতার বাদন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে নিজের প্রতিভাকে ফুটিয়ে তোলেন সবার সামনে। অসুস্থতা নিয়ে অনার্সে পরীক্ষা দিয়েও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঞ্চম হন। চৌদ্দ আগস্ট, নিহত হওয়ার আগের দিন তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের চূড়ান্ত ভাইভা দিয়ে পাঠ সমাপ্ত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ছিয়াত্তর সালে ফল বের হলে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন, যদিও তাঁর শিক্ষকরা এতে অসন্তুষ্ট হন। কেননা তাঁদের মতে কামাল আরো অধিক নম্বর পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু পরীক্ষকরা স্বৈরাচারের ভয়ে কামালকে কম নাম্বার দিয়েছে। ঠিক এ ঘটনাই ঘটে উপাচার্য আবুল ফজলের ক্ষেত্রে, যিনি সামরিক সরকারের উপদেষ্টা হয়েও শেখ কামালের প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে একদিন পরেই বরখাস্ত হয়েছিলেন।
শেখ কামালকে ঘিরে অপপ্রচারের জবাব পাই আমরা অভিনেত্রী ডলি জহুর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকা প্রবাসী আব্দুল হান্নানের বক্তব্যে। ডলি জহুর, যিনি এই সব দিনরাত্রির নীলু চরিত্রে অভিনয় করে দেশ মাতিয়ে তোলেন, তিনি ছিলেন শেখ রেহানার বান্ধবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক মঞ্চায়নের মহড়ায় রাত হয়ে গেলে রিকশা করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। সেসময় শেখ কামাল রিকশায় এতো কুঁকড়ে বসতেন যেন একটুখানি লাগলেই মহা অপরাধ হয়ে যাবে তাঁর। তিনি কখনো ডলি জহুরের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টি কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে বাক্য ব্যবহার করেননি, যাতে কারো মর্যাদা বা সম্মান হানি হতে পারে। ডলি জহুর নিজেই বলেছেন, তাঁর এই ভদ্র আচরণ বা ব্যবহারে কেউ কখনো বলতে পারবে না, তিনি নারীদের লাঞ্ছিত করতে পারেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আব্দুল হান্নান বলেন, শেখ কামালের মতো জেনুইন বন্ধু আর দ্বিতীয়টি তিনি দেখেননি, যিনি সর্বদা নিজেকে সুন্দর আচরণের প্রতি নিবিষ্ট রেখেছেন। কথিত ব্যাংক ডাকাতির বিষয়টি সিরাজ সিকদারের অপপ্রচার ছিল। মূলত সেদিন সিরাজ সিকদারের গাড়িকে পাকড়াও করতে গিয়েই শেখ কামাল ও তার নয়জন বন্ধুকে বহনকারী সাদা রঙের মাইক্রোবাস গুলিবর্ষণের শিকার হয়, যাতে শেখ কামাল নিজেই তাঁর কাঁধে চারটি গুলিবিদ্ধ হন। তিনটি গুলি পিজিতে এবং একটি গুলি রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে গিয়ে অপসারণ করানো হয়। সাবেক বিদ্যুৎ ও পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ইকবাল হাসন টুকুও সেদিন সেই মাইক্রোবাসে ছিলেন, যিনি নিজেও শেখ কামালের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
শেখ কামালের মতো মেধাবী দেশপ্রেমিক যুবনেতা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তবে বাংলাদেশ আরো অনেক আগেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতো। তাঁর বাহাত্তরতম জন্মবার্ষিকীতে আগামী প্রজন্ম তাঁকে আবিষ্কার করুক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, অপপ্রচারের কুয়াশা ভেদ করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল চির অক্ষয় হয়ে থাকুন।