প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
ফরিদগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নে পীরের কথায় প্রায় ৫০ বছর ধরে ভোট দিচ্ছেন না নারী ভোটাররা। ইউনিয়নটি হচ্ছে ১৬নং দক্ষিণ রূপসা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে মোট ভোটার ২৪ হাজার ৪শ’ ৫৪ জন। তাদের মধ্যে নারী ভোটার ১২ হাজার ১শ’ ১৪ জন। তারা সবাই ভোটার তালিকায় নাম উঠাতে ছবি তুলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রও নিয়েছেন। ভোট না দিলেও নিত্যদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যান। কিন্তু ভোটের দিন সবাই থাকেন ঘরের ভেতরে। আগামী ৫ জানুয়ারি উক্ত ইউনিয়নে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে নারী ভোটারগণকে ভোট দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন ইউএনও শিউলী হরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া বাজার এলাকার মাওলানা মোহাম্মদ হাছান মওদুদ নামে জৈনপুরের পীর নারীদের ভোট না দেয়ার ফতোয়া জারি করেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই সময় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী লায়ন হারুনুর রশিদের সহধর্মিণী চেষ্টায় ইউনিয়নের কাউনিয়া গ্রামের ১টি ভোটকেন্দ্রে কিছু সংখ্যক নারী ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। জাতীয় সংসদের সেই নির্বাচনে লায়ন হারুনুর রশিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
স্থানীয়রা বলেছেন, ওই ইউনিয়নের সকল প্রার্থী মনে-প্রাণে চাইলে এই ইউনিয়নের নারী ভোটারগণ ভোট দিতে পারে। প্রার্থীদের সদিচ্ছার অভাবে কোনো নারী ভোট দিতে যায় না। এমন কি প্রার্থীরা তাদের পরিবারের নারী সদস্যদেরকেও ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করে না।
কথিত আছে, প্রায় ৫০ বছর আগে ওই এলাকায় কলেরার প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর ওই এলাকায় তৎকালীন সময় জৌনপুর হুজুর নারীদের ভোট দিতে নিষেধ করেন। পীরের এমন কথার কোনো তথ্য কিংবা প্রমাণ কেউ না দেখাতে পারলেও সেই সময় থেকেই এই ইউনিয়নের কোনো নারী আর ভোট দেয় না।
জানা যায়, জৈনপুরের পীর মাওলানা মোহাম্মদ হাছান মওদুদ ১৯৮১ সালে ভারতে মৃত্যুবরণ করেন।
একই গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আব্দুর রব বলেন, ‘পীর কইছে এজন্যে মহিলারা ভোট দেয় না। আমরা কইলেও হেতিরা যায় না। এডা চলি আইতেছে যুগকে যুগ ধরি। কী কইতাম মাইয়া ও বৌরা সব কামই করে। ঘরের বাইরে, শুধু ভোট আইলে হেতিগো হুজুরের কথা মন অয়।’
ওই ইউনিয়নে গৃদকালিন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এই ইউনিয়নে ভোটের সময় শুধু প্রার্থী ও পুরুষেরা আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে নারীরা ভোট দিতে পারে।
রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোঃ শরীফ হোসেন খান বলেন, শুনেছি হুজুর বলেছিলেন নারীদের পর্দাশীল হওয়ার জন্যে। ভোটাধিকার প্রয়োগ না করার কথা বলেননি তিনি। এখন নারীরা বাজার করা থেকে শুরু করে সকল কাজই করেন। আশাকরি এই ইউপি নির্বাচনে তারা তাদের ভোটের অধিকারও প্রয়োগ করবেন। আমরাও তাদেরকে ভোট দিতে উৎসাহী করতে কাজ করে যাচ্ছি।
রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের বর্তমান প্যানেল চেয়ারম্যান ও (৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড) সংরক্ষিত নারী সদস্য প্রার্থী মনোয়ারা বেগম বলেন, আমি নিজে একজন নারী, কিন্তু নির্বাচিত হই পুরুষের ভোটে। এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ১৩টিতেই নারীরা ভোটকেন্দ্রে যায় এবং ভোট দেয়। কিন্তু আমরা তাদের কাছে যাই, তাদের হাতে পায়ে ধরে বোঝাই। ভোটকেন্দ্রে নারী এজেন্টও থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না, তারা ভোট দিতে আসেন না।
এ নিয়ে ফরিদগঞ্জের একটি মাদ্রাসার সহকারী অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা আনোয়ার মোল্লা এ প্রতিনিধিকে বলেন, ইসলামে নারী ভোটারদের পর্দার মাঝে থেকে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে। উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নারীদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে নারীদেরকে যুক্তি দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলী হরি বলেন, এটা তাঁদের বিশ^াসের বিষয়। তাঁদের বিশ^াস যেন ফেরানো যায়, এজন্য আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবো। তিনি যদি আমাকে নারীদের ভোট প্রদানের জন্য কোনো সভা করে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে বলেন তা হলে আমি কাজ করবো।
এ বিষয়ে সচেতন সকলে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের কাছে সচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানান।