বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত ৩ : এলাকায় আতঙ্ক
  •   শিক্ষা খাতে নজিরবিহীন রদবদল: একযোগে চার বোর্ড চেয়ারম্যানকে ওএসডি
  •   মধ্যরাতের আতঙ্ক
  •   চীনা সেনাদের ভারতের অরুণাচলে অনুপ্রবেশ: বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে
  •   আপনার টাকা কোথায় গেল?

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

‘গ্রামে করোনা নাই’ এই হেয়ালিপনার খেসারত

করোনা উপসর্গে দ্রুততম সময়ে মৃত্যু : গ্রামগঞ্জে মৃত্যুর মিছিল

অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে আসলো

করোনা উপসর্গে দ্রুততম সময়ে মৃত্যু : গ্রামগঞ্জে মৃত্যুর মিছিল
এএইচএম আহসান উল্লাহ ॥

বাবুল, আঃ সোবহান, শরীফ ঢালী, হোসনেয়ারা, শাহিদা, সুফিয়া, মাকসুদা ও আঃ মজিদরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পরই মারা যাচ্ছেন। কেউ ত্রিশ মিনিট, কেউ বা এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। চাঁদপুরে এমন মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। হাসপাতালের রেকর্ডে যেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ আছে ‘করোনা সাসপেক্টেড’। বাহ্যত দেখতে একজন সুস্থ-সবল মানুষের কেনো এতো দ্রুততম সময়ে মারা যাওয়া? শুধু কি অক্সিজেনের অভাবেই এসব মৃত্যু? নাকি ‘চিকিৎসা না পেয়ে ওমুক মারা গেছেন’ হরহামেশা করে থাকা এমন অভিযোগই এসব মৃত্যুর একমাত্র কারণ। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা হলো। স্বজনদের কথা থেকেই বেরিয়ে আসলো কতোটা অবহেলা ও হেয়ালিপনা ছিলো তাদের এই গুপ্তঘাতক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে নিয়ে। ‘করোনা বলতে কিছু নেই, গ্রামে করোনা নেই, আরে ধুর! মাস্ক-টাস্ক দিয়ে কী হবে, হায়াত থাকলে বাঁচুম, না হয় মইরা যামু’ ইত্যাদি যতো ভ্রান্ত এবং মনগড়া মনোভাব পোষণ করে করোনাভাইরাসকে নিজেদেরই আশপাশে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে, শরীরের ভেতর বিনা বাধায় তার প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে পরিণতি যা হবার তা-ই হচ্ছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্য একজনের পর একজন মারা যাচ্ছে।

‘ভাইয়ের ১৫ দিন আগে জ্বর হয়েছিল। স্থানীয় দোকান থেকে কয়েকদিন ঔষধ খাওয়ার পর তখন জ্বর ভালো হয়ে গিয়েছিল। এরপর ২ আগস্ট সোমবার ভাইয়ের প্রথমে কাশ হয়। আস্তে আস্তে কাশ বাড়তে থাকে। রাতে অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ৩ আগস্ট দিনে শ্বাসকষ্ট খুব বেড়ে যায়, নিঃশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হতো এবং হা করে নিঃশ্বাস ছাড়ত। তখনই ভাইকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সন্ধ্যা ৬টায় তাকে হাসপাতালে আনার সাথে সাথেই তার অক্সিজেনের খুব দরকার হয়। কিন্তু তখন অক্সিজেনের সংকট থাকায় তাকে আর তৎক্ষণাৎ অক্সিজেন দেয়া যায় নি। এ অবস্থায়ই প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে ভাই মারা যান’। এভাবেই ফরিদগঞ্জের গাজীপুর গ্রামের বাবুল (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যুর বিবরণ তুলে ধরলেন তার বোন। হাসপাতালের রেকর্ডে বাবুল করোনা সাসপেক্টেড তথা করোনা উপসর্গে মারা গেছেন উল্লেখ রয়েছে।

মতলব উত্তর উপজেলার মান্দারতলী গ্রামের আঃ সোবহান (৯০) ২ আগস্ট সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি হন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে। দেড় ঘণ্টার মাথায় রাত ১০টায় তিনি মারা যান। আব্দুস সোবহানের ছেলের সাথে তার বাবার মৃত্যুর বিষয়ে কথা হয়। তিনি জানান, সোমবার দুপুরে তার বাবার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে সন্ধ্যায় তাঁকে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তখন তাঁর অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ছিল ৬০-৬৫। বাবাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে সাথে সাথে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়। কিন্তু তাঁর অক্সিজেনের লেভেল বেশি উঠানো যায় নি। এ অবস্থায় রাত ১০টা ৫ মিনিটে তার বাবা মারা যান। আঃ সোবহানের মৃত্যুও করোনা সাসপেক্টেড হিসেবে হাসপাতালের রেকর্ডে উল্লেখ করা।

একইভাবে কথা হয় করোনা উপসর্গে মারা যাওয়া মতলব দক্ষিণ উপজেলার মাছুয়াখাল গ্রামের শরীফ ঢালীর (৬৫) ছেলের সাথে। তিনি সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যান ২ আগস্ট সোমবার বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে। তাঁর ছেলে জানালেন, তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সোমবার বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। তাঁরও ৪/৫ দিন জ্বর ছিল, পরে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। তখন তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে তার বাবা মারা যান। তার মৃত্যুও হাসপাতালের রেকর্ডে করোনা সাসপেক্টেড।

এভাবে কথা হয় চাঁদপুর সদর উপজেলার ফরাক্কাবাদ গ্রামের হোসনেয়ারা বেগম (৫৫), বাঘড়া বাজার দক্ষিণ বাগাদী গ্রামের শাহিদা বেগম (৭০), শাহরাস্তির হোসেনপুর গ্রামের সুফিয়া (৮৫), মতলব দক্ষিণের আশ্বিনপুর গ্রামের মাকসুদা (৩৬) এবং হাজীগঞ্জের বাকিলা শ্রীপুর গ্রামের আঃ মজিদ (৯০)সহ করোনা উপসর্গে মারা যাওয়া আরো কয়েকজনের স্বজনদের সাথে। সবার কাছ থেকেই জানা গেলো, এরা হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান। এরা সবাই প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসেন।

হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা এবং সেবার দায়িত্বে থাকা ডাক্তার ও নার্সদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, যারা হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন তাদের অক্সিজেনের স্যাচুরেশন সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৭৫ এবং সর্বনিম্ন ৪৫ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এসব রোগীর জন্যে প্রয়োজন আইসিইউ। আমাদের হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা যা আছে তা দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু করোনাভাইরাস ফুসফুসে অ্যাটাক করে ফেললে সে রোগীকে এই হাসপাতালের বর্তমান ব্যবস্থা দ্বারা বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। তার জন্যে আইসিইউ ব্যবস্থাসহ সর্বোচ্চ ধরনের চিকিৎসা লাগে।

হাসপাতালের আরএমও ও করোনাবিষয়ক ফোকালপার্সন ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেলও একই কথা বললেন। তিনি জানান, এই হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে আমরা বেড সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে দেড় শ' পর্যন্ত বাড়িয়েছি। কিন্তু গত কয়েকদিন যাবত আইসোলেশন ইউনিটে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে গড়ে ২শ'র মতো। এসব রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেয়াটা খুবই কঠিন। আমাদের ডাক্তার এবং নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের মধ্যেও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যান। তখন তাদের আইসোলেশনে চলে যেতে হয়। ঈদের পর থেকেই চাঁদপুরে করোনা পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

‘এখন গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত এবং খুব দ্রুত মারা যাচ্ছে’ এ প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, আপনারা এক মাস আগের গ্রামের চিত্র যদি একটু খেয়াল করেন, এর উত্তর পেয়ে যাবেন। গ্রামের মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না। এমনকি এখনো তেমন একটা নেই।

সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বললেন, গ্রামের মানুষ বলতো, ‘গ্রামে করোনা নাই’। এমন মনগড়া এবং ভ্রান্ত মনোভাব থেকে তারা একেবারে ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা করতো। পুরো গ্রাম ঘুরলে বাজার, দোকান, মসজিদ কোথাও দু একজনের বেশি মাস্ক পরা দেখা যেতো না। মানুষের আনাগোনা, চলাফেরা, আচার-অনুষ্ঠান সব কিছুই স্বাভাবিক অবস্থার মতো ছিল। সেটারই খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।

‘গ্রামের মানুষ তো আগেও এভাবে চলাচল করতো, তখন তো এতো আক্রান্ত এবং মৃত্যু হতো না। কিছুদিন যাবত কেনো এতো মৃত্যু বেড়ে গেলো?’ এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, এখনকার করোনার ভেরিয়েন্ট হচ্ছে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। এটা খুব দ্রুত ছড়ায়। যেটা ভারতকে ম্যাচাকার করে দিয়েছে। এটা খুব দ্রুত ছড়ায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে ফুসফুসে অ্যাটাক করে ফেলে। যার কারণে বুঝে ওঠার আগেই রোগীর অবস্থা অবনতির দিকে চলে যায়।

ঈদুল আজহার পর থেকে চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং করোনা পজিটিভ ও উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। প্রতিদিন হাসপাতালে করোনার উপসর্গে মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে দশের উপরে থাকছে। সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তথ্য মতে, গত ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত এই পাঁচদিনে করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালেই মারা গেছে প্রায় ৫০ জন। এদের অধিকাংশই হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে আনার পথে একদিনেই সাতজন করোনা সাসপেক্টেড রোগী মারা গেছেন। এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে চাঁদপুর জেলাজুড়ে।

‘করোনা সাসপেক্টেড রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা কেনো এতো বাড়ছে এবং এসব মৃত্যুর ৯০ ভাগই গ্রামের কেনো? কেনোই বা একজন সুস্থ সবল মানুষ এতো অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাচ্ছে?’ এসবের উত্তর খুঁজতে এবং কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সাথে কথা বলে এ সব তথ্য বেরিয়ে আসলো। যার সারাংশ দাঁড়ায়‘গ্রামে করোনা নাই’ এই ভ্রান্ত এবং মনগড়া মনোভাব নিয়ে ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা করা। মূলত করোনার বিষয়ে চরম হেয়ালিপনার খেসারতই দিতে হচ্ছে এখন গ্রামগঞ্জের মানুষগুলোকে। যেখানে এই মহামারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধির কোনো বালাই ছিল না। আর জ্বর, সর্দি কাশি হলে গ্রাম্য চিকিৎসক বা ঔষধের দোকানে গিয়ে নিজের মন মতো ঔষধ খেতো সিজনাল জ্বর মনে করে। এভাবেই ৪/৫ দিন কি ৭/৮ দিন কাটিয়ে দিত। তখনও তার ভেতরে এই চিন্তা আসত না যে, তাকে করোনা অ্যাটাক করতে পারে। যখন এটা মনে হতো, ততক্ষণে তার অবস্থা শেষ পর্যায়ে। আর তখনই হাসপাতালে ছোটাছুটি, অক্সিজেন নিয়ে টানাটানি।

এখনো যদি মানুষ এ বিষয়ে গোঁড়ামি এবং হেয়ালিপনা বাদ দিয়ে সতর্ক না হয়, স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চলে, তাহলে ‘দ্রুততম সময়ে মৃত্যুর’ তালিকা কতটা দীর্ঘ হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়