প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৫, ২২:২৯
ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব মো. শাহজাহান তালুকদার সাহাকে ভুলতে বসেছে সবাই

এক সময় হাজীগঞ্জ, হাজীগঞ্জ ডিঙ্গিয়ে জেলা আর জেলা ডিঙ্গিয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলাতে ডাক পাওয়া ফুটবলার, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, আর ক্রীড়া সংগঠক হাজীগঞ্জের টোরাগড় গ্রামের বাসিন্দা মো. শাহজাহান তালুকদার সাহাকে ভুলতে বসেছে সবাই। বর্তমান প্রজন্ম তো খেলাতেই আগ্রহী নয়, শাহজাহান তালুকদারকে চিনবে তো দূরের কথা। সঠিক পরিচর্যা আর ট্রেইনার পেলে হাজীগঞ্জের মাটি থেকে এখনো প্রথম শ্রেণির ফুটবলার বা ক্রিকেটার উঠে আসা সম্ভব বলে আশাবাদী তিনি। এক সময় মাঠ দাপানো এই ফুটবলার বর্তমানে অনেকটাই নিভৃতচারী হয়ে গেছেন। দু সন্তানের জনক শাহজাহান তালুকদার সাহার ৫ ভাইয়ের সবাই ছিলেন খেলোয়াড়। তাদের বাবা কলকাতা মাঠে খেলতেন আর সে কারণে জেনেটিকভাবেই তারা ৫ ভাইয়ের সবাই খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন বলে পরিবারটিকে ক্রীড়া পরিবার হিসেবে সবাই বলে থাকে। তবে বয়স আর সংসারের টানে সবাই খেলা জগৎ থেকে দূরে রয়েছেন।
শাহজাহান তালুকদার সাহা আর স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার টোরাগড় তালুকদার বাড়ির মরহুম আলী আহম্মদ তালুকদার ষাটের দশকে কলকাতা টাটার হয়ে কলকাতা মাঠে খেলতেন। এরপরেই তিনি সপরিবারে হাজীগঞ্জের টোরাগড়ে চলে আসেন। এখানে আসার পরে ক্রীড়া জগতে বিচরণ করেছেন সমান তালে। ভালো ফুটবল খেলোয়াড় আর রেফারী হবার কারণে মরহুম আলী আহম্মদের ৯ সন্তানের মধ্যে পুত্র সন্তান ৫ জনের সবারই ক্রীড়াঙ্গনে ছিলো সমান বিচরণ। রুহুল আমিন তালুকদার, অধ্যাপক শাহজামাল তালুকদার, শাহজাহান তালুকদার সাহা, শাহনাজ তালুকদার ও মরহুম অধ্যপক শাহআলম তালুকদার। সবাই ক্রীড়ার সাথে জড়িত থাকার কারণে পরিবারটিকে ক্রীড়া পরিবার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে বয়সের কারণে আর সংসারের কারণে কেউ এখন খেলেন না।
শাহজাহান তালুকদার সাহা নামটি হাজীগঞ্জের ক্রীড়া জগতে এক পরিচিত নাম। উপজেলাতে দুজন খেলোয়াড়ের নাম শাহজাহান হওয়ার কারণে সহকর্মীরা তঁাকে সাহা নাম দেন, আর সেই সাহা নামেই পরিচিতি পান শাহজাহান তালুকদার। বাড়ির সামনে হাজীগঞ্জ সরকারি পাইলট হাই স্কুল এন্ড কলেজের সুবিশাল মাঠ থাকার কারণে
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই ফুটবল খেলায় হাতে খড়ি তার। ফুটবল খেলার পাশাপাশি পরে এসে নামকরা রেফারী হয়ে উঠেন তিনি। শেষে এসে একজন প্রশিক্ষক হয়ে যান নিজের শ্রম আর ঘামে। ফুটবলে ও অ্যাথলেটিক্সে জাতীয় পর্য়ায়ে ডাক পড়ে
শাহজাহান তালুকদারের। অসুস্থতার কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
ক্রীড়া জগতের সাথে ৫৫ বছর জড়িত থাকার পাশাপাশি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাথে জড়িত ছিলেন বহু বছর।
হাজীগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৬৪ সালে, যার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক এমপি এম এ মতিন। সেই মতিন স্যারের ডাকে ২০০২ সালে হাজীগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দাযিত্ব পান। যার দায়িত্ব পালন করেছেন টানা ২০২২ সাল পর্যন্ত। পরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে শাহজাহান তালুকদার সাহাকে সরিয়ে দেয়া হয়। মূলত তারপর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেন এ জগৎ থেকে।
বর্তমানে তিনি টোরাগড় স্বর্ণকলি কেজি স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য ও শতমূলী যুবকল্যাণ সংস্থা, হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য, প্রাক্তন খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থার সদস্য পদে থেকে সামাজিক কাজ করছেন।
এক প্রতিক্রিয়ায় শাহজাহান তালুকদার সাহা বলেন, আমার নিজের তৈরি করা অনেক খেলোয়াড় বিকেএসপি, সিলেট বিকেএসপি, সাভারে ভালো করেছে।
বর্তমান প্রজন্ম খেলাতে পিছপা হচ্ছে, যার মূল কারণ, ট্রেইনার না পাওয়া, খেলাতে নতুন প্রজন্ম আগ্রহী না। এখনো ক্রিকেটে ও ফুটবলে হাজীগঞ্জে ভালো খেলোয়াড় তৈরি হতো, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়ে ভালো ট্রেইনার রাখতে পারতো। জাতীয় মানের ট্রেইনার পেলে হাজীগঞ্জ থেকে ভালো প্লেয়ার তৈরি করা সম্ভব।
ছবি-১৭
গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ
মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ \ গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় খেলা হা-ডু-ডু, কানামাছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, বৌছি, ডাংগুলি, এক্কাদোক্কা, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচসহ নানা ঐতিহ্যবাহী খেলা আজ বিলুপ্ত প্রায়। এক সময় গ্রামের শিশু কিশোরেরা জনপ্রিয় এসব খেলায় মেতে উঠতো। বিকেল হলেই পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে খেলায় অংশগ্রহণ করতো। এসব খেলা কেবল বিনোদনের মাধ্যমই ছিলো না, বরং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় শহর থেকে গ্রামে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার প্রভাব খেলাধুলার মধ্যেও পড়েছে। ক্রীড়া কসরতের এই কর্মযজ্ঞ এখন শিল্প আর বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এটা এখন এক বিরাট বাণিজ্যও বটে। কর্পোরেট জগতের বাণিজ্যিক প্রভাবে নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব খেলাধুলার নাম ও খেলার পদ্ধতি।
তাছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে বাসস্থানের সমস্যা সমাধানের জন্যে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। শিল্প-কারখানা স্থাপন, হাট-বাজারের বিস্তৃতি সব কিছু মিলিয়ে উন্মুক্ত খেলার মাঠ এখন তেমন নেই বললেই চলে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী রবি শস্য এখন আর নেই। এক সময় আমন ফসল কাটার পর ফসলের পুরো মাঠ খেলার জন্যে উন্মুক্ত ছিলো। এখনকার ছেলেরা সে পরিবেশ পাচ্ছে না। বাড়ির পরিত্যক্ত আঙ্গিনায় বাড়ির মেয়েদের খেলার আসর বসতো। মেয়েলি সব খেলায় মেতে উঠতো সমবয়সীরা। আজকের সময়ে বাড়ির আঙ্গিনা তো দূরে থাক, এমনও বাড়ি রয়েছে, যেখান থেকে মৃত ব্যক্তির খাট বের করা কঠিন।
গ্রাম বাংলার এ সামান্য চিত্র থেকে বর্তমানে খেলাধুলার পরিবেশ কতোটা সংকুচিত তা অনুমান করা যায়। এক সময় খেলাধুলার জন্যে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা কম ছিলো, কিন্তু উন্মুক্তভাবে এর প্রসার অনেক ব্যাপক ছিলো। স্রেফ বিনোদন থেকে খেলাধুলা ছড়িয়ে যেতো এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে, এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায়, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায়। হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলার জমজমাট আসর বসতো ব্যক্তি উদ্যোগ বা কিশোরদের গঠন করা বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের মাধ্যমে। যার ফলে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কোনো ঘাটতি ছিলো না।
খেলাধুলার জন্যে এখন যে মাঠ অবশিষ্ট রয়েছে, তা কেবল বিদ্যালয়কেন্দ্রিক খেলার মাঠ। তাও আবার সকল বিদ্যালয়ে এ সুযোগ যথোপযুক্ত নয়। বিদ্যালয়ের মাঠ সব শিক্ষার্থীর বাড়ির কাছাকাছি না থাকায় এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত অনেকেই। সে জন্যে গ্রাম গঞ্জের প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠকে খেলার উপযোগী করে উন্মুক্ত করা উচিত। কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র জেলা পর্যায়ে স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়ে থাকে। জায়গা এবং আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের জন্যে উপজেলা পর্যায়ে স্টেডিয়াম নির্মাণ করার সামথর্য হয়তো বা নেই।
সুতরাং আমাদের উচিত গ্রামীণ এলাকায় খেলার মাঠ সংরক্ষণ ও নতুন মাঠ তৈরি করার প্রতি নজর দেয়া, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচার ও প্রচারণা বৃদ্ধি করা।
গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
তাই ক্রীড়ামোদীদের প্রত্যাশা, শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্যে খেলাধুলার সুযোগ অবারিত রাখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠসহ অন্যান্য খেলার মাঠ ক্রীড়াবান্ধব করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি দিবেন।