প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
উচ্চ রক্তচাপের ভীতি আর নয়
হরেক রকম চাপে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ জীবন। প্রকৃতির বাতাসের চাপ, সাংসারিক দৈনন্দিন চাপ, জীবনের প্রত্যাশার চাপ, হতাশার চাপ ইত্যাদি বিবিধ চাপে মানুষ যেনো জন্ম হতেই যাঁতাকলে পিষ্ট। সকল চাপের কারণে সর্বাগ্রে যা প্রভাবিত হয় তা হলো মানুষের রক্তচাপ। রক্ত হৃদপি-ের সংকোচন প্রসারণের কারণে রক্তনালীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্তনালীর গাত্রে যে চাপ প্রদান করে তাকেই রক্তচাপ বলে।
মানুষের স্বাভাবিক রক্ত চাপ
রক্তচাপ পরিমাপে দুটো রাশি আছে। একটি হলো সিস্টোলিক রক্তচাপ আর অন্যটি হলো ডায়াস্টলিক রক্তচাপ। হৃদপি- সংকোচনের মাধ্যমে বিভিন্ন রক্তনালীতে রক্তপ্রেরণকালে যে চাপ অনুভূত হয় তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ বলে। সাধারণভাবে মানুষের সিস্টোলিক রক্তচাপের মাত্রা ১১০ মিলিমিটার মার্কারী চাপ হতে ১৪০ মিলিমিটার মার্কারী চাপ পর্যন্ত সীমায় স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত।
হৃদপি- যখন প্রসারিত হয় তখন রক্তনালীর অভ্যন্তরে যে রক্তচাপ অনুভূত হয় তাকে ডায়াস্টলিক রক্তচাপ বলে। ডায়াস্টলিক রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা ৬০ মিলিমিটার মার্কারী চাপ হতে ৯০ মিলিমিটার মার্কারী চাপ পর্যন্ত সীমায় স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত। ডায়াস্টল বা হৃদপি-ের সম্প্রসারণের সময় হৃদপি-ের রক্তনালীগুলো রক্ত সরবরাহ লাভ করে বিধায় হৃদপি-ের জন্যে ডায়াস্টলিক রক্তচাপের গুরুত্ব বিশেষভাবে বিদ্যমান। ডায়াস্টলিক রক্তচাপ একটু বাড়তি হলেই দেহযন্ত্রে বিঘœ ঘটার সম্ভাবনা আছে। মানুষের জন্যে কাক্সিক্ষত রক্তচাপ হচ্ছে সিস্টোলিক/ডায়াস্টলিক ১২০/৮০ মি.মি. পারদ চাপের কম বা সমান।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
রোগ পর্যালোচনায় দেখা যায় উচ্চ রক্তচাপের বিবিধ কারণ। প্রাথমিক কারণ এবং সৃষ্ট কারণ। প্রাইমারি বা প্রাথমিক কারণ অনেক ক্ষেত্রে অ্যাসেনশিয়াল হাইপারটেনশান নামেও পরিচিত। উচ্চ রক্তচাপের শতকরা ৯৫% ভাগ রোগী অ্যাসেনশিয়াল হাইপারটেনশানে ভোগে। এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজ্ঞাত। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের শতকরা ৫% ভোগেন সেকেন্ডারি হাইপারটেনশানে বা সৃষ্ট কারণজনিত উচ্চ রক্তচাপে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো নি¤œরূপ :
সেকেন্ডারি উচ্চরক্তচাপের কারণ
কিডনীজনিত রোগ : সৃষ্ট কারণজনিত উচ্চ রক্তচাপের প্রায় ৭৫% কিডনীজনিত রোগে তৈরি। গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, পলিআর্টেরাইটিস নডোসা, পলিসিস্টিক কিডনী ডিজিজ, ক্রনিক পায়েলোনেফ্রাইট্রিস ইত্যাদি বিবিধ কারণে উচ্চরক্তচাপ সংঘটিত হয়।
হরমোন বা অনালগ্রন্থিজনিত কারণ : কুশিং সিনড্রোম, কনন্ সিনড্রোম, ফিওক্রোমোসাইটোমা, হাইপার প্যারাথাইরয়েডিজম ইত্যাদি বিভিন্ন হরমোন ঘটিত রোগে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়।
বিবিধ কারণ
* রক্তনালীর গাত্র দৃঢ় হয়ে যাওয়া
* গর্ভকালীন সময়
* স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন
* গর্ভনিরোধক হরমোনাল বড়ি সেবন ইত্যাদি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক ইতিহাস কিংবা বংশানুক্রমের উত্তরাধিকার ধারার কারণেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।
উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গ
কখনো কখনো উচ্চ রক্তচাপ উপসর্গবিহীন থাকে। চিকিৎসকের কাছে অন্য রোগের জন্যে শরণাপন্ন হলে ঘটনাচক্রে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় হয়। অনেক ক্ষেত্রে নি¤œলিখিত উপসর্গগুলো দেখা যায়-
* মাথা ও ঘাড়ে ব্যথা
* মস্তিষ্কে জ্বালা-পোড়া ভাব
* অনিদ্রা
* মাথা ঘুরানো
* বমি হওয়া
* চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া
* মাথা দিয়ে গরম ভাব বের হওয়া
* মাথা দোলানো (আপনাআপনি)
* হাত, বাহু ঝিন্ ঝিন্ করা ও বুকে ব্যথা অনুভব ইত্যাদি।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্যে দরকারী পরীক্ষা
* ইসিজি
* র্যান্ডম ব্লাড গ্লুকোজের মাত্রা নিরূপন
* ইউরিন ফর রুটিন এগ্জামিনেশন (অ্যালবুমিন, প্রোটিন প্রাপ্তি)
* ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইল
* বুকের এক্স-রে
* কিডনী ফাংশান টেস্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর ব্যবস্থাপনা
যে কোনো উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে নিয়মিত পাস করা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যে কতিপয় ঝুঁকি নিয়ামক চিহ্নিত করে তা হতে উত্তরণের পথ ব্যাখ্যা করবেন এবং উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জীবনাচরণের পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব দিবেন। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে ঔষধ এর ব্যবস্থা দিবেন।
উচ্চ রক্তচাপের ক্ষয়ক্ষতি
উচ্চ রক্তচাপের কারণে নি¤েœাক্ত ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে
* রক্তক্ষরণজনিত মস্তিষ্ক স্ট্রোক
* রক্তপ্রবাহ ঘাটতিজনিত মস্তিষ্ক স্ট্রোক
* মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান বা এম.আই. (হার্ট স্ট্রোক)
* হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি
* প্যাপিলোইডিমা ও অন্ধত্ব
* হাইড্রোনেফ্রোসিস ও রেনাল ফেইলিওর
* অঙ্গ-নিঃসাড়তা
* বাক্হীনতা ও চলৎশক্তিহীনতা
* অনিয়ন্ত্রিত মেজাজ
* মৃত্যু।
অভ্যাসে লাগাম জীবনের দামে
এই ধূলিধূসর ধরণীতে জন্মের পর হতেই স্ব-বৈরী আচরণে মানুষ শুরু করে তার পথচলা। একদিকে সে বলে ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ আর অন্যদিকে কু-অভ্যাস রপ্ত করে কমিয়ে চলেছে জীবনের আয়ু। জীবনের আয়ুকে দীর্ঘ ও সুস্বাস্থ্যময় করতে হলে চাই সু-অভ্যাসের নিয়মিত চর্চা ও প্রতিষ্ঠা। মানুষের জীবনাচরণের যে সকল দিক উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ সে সকল পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি নিয়ামকগুলো হচ্ছে :
ক. ধূমপান খ. অ্যালকোহল পান গ. অতিরিক্ত চর্বি-জাতীয় খাদ্য গ্রহণ ঘ. অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ঙ. দেহস্থুলতা চ. শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা উল্লেখযোগ্য।
ধূমপান : বলা হয় ধূমপানে বিষপান। বাস্তবিক এই কথাতে অতিরঞ্জন নেই একটুও। ধূমপান মানুষের দেহে ক্ষতি বৈ উপকার দিতে পারে না একটুও। ধূমপান মানুষের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। ধূমপান মানুষকে অকালে বুড়িয়ে দিয়ে এবং শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে হেন কিছু নেই যা করতে পারে না। এমনকি দীর্ঘদিনের ধূমপান মানুষের দেহে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের কর্কট ব্যাধির সংঘটন হতে শুরু করে মানুষকে বন্ধ্যা পর্যন্ত করে তোলে। ধূমপান বিবিধ হৃদরোগ সংঘটনে মূল নায়ক হতে পারে। এমনকি ধূমপান যক্ষ্মাকে উস্কে দেয় এবং মস্তিষ্কের স্ট্রোক সংঘটনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। উচ্চ রক্তচাপ সংঘটনের ক্ষেত্রে ধূমপান একটি ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ামক। দীর্ঘদিন ধূমপানের কারণে রক্তনালীর গাত্র অমসৃণ হতে শুরু করে এবং রক্তনালীর গাত্রে মেদকলার দলা জমে রক্তনালীর অভ্যন্তরীণ ছিদ্রকে কমিয়ে দেয়। ফলে পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই ধূমপান বর্জন করা অতি জরুরি। যারা ধূমপানে আসক্ত তাদের জন্যে ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। যারা ধূমপানকে নায়কোচিত ভাবেন তাদের উপলব্ধি করা উচিত গুণহীন ধূমপান খলনায়কের নামান্তর। পক্ষান্তরে জীবনের দাম ধূমপানের চেয়ে অমূল্য। তাই ধূমপানে টেনে জীবনকে যথাসম্ভব দীর্ঘ ও নীরোগ করে তুলুন। যারা শত চেষ্টা করেও ধূমপানে যতি টানতে পারছেন না তারা ঠধৎবহরপষরহব নামক ঔষধ চিকিৎকের পরামর্শক্রমে গ্রহণ করে দেখতে পারেন।
অ্যালকোহল পান : কোনোক্রমেই অ্যালকোহল মানুষের জীবনের জন্যে উপকারী নয়। অ্যালকোহল গ্রহণে স্বাভাবিক চেতনা নাশের পাশাপাশি বরং অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ্ হতে শুরু করে আরো অনেক ভয়ানক রোগের সূচনা ঘটে। দীর্ঘদিনের অ্যালকোহল সেবনে স্থুলভাবে রক্তনালীর গাত্রে অমসৃণতা তৈরি হয়ে মেদকলা জমে যেতে পারে, যা একদিকে রক্তনালীর ছিদ্রকে সরু করে এবং অন্যদিকে রক্ত¯্রােতে প্রবাহিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রক্তনালীকে আটকে দিতে পারে। ফলশ্রুতিতে তৎপরবর্তী স্থানে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পেয়ে মস্তিষ্কের কোষ-কলায় পচন ধরতে পারে। তাই অ্যালকোহল পানে যবনিকা টেনে উচ্চরক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি জরুরি।
অতিরিক্ত চর্বি-জাতীয় খাদ্যগ্রহণ : মানুষ যতোদিন যাচ্ছে ততোই বেছে বেছে এমন সব খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে যা আদতে অস্বাস্থ্যকর। বিভিন্ন রেসিপির নামে, বিভিন্ন ফুড-চেইন শপের নামে এমন সব খাবার-বিপণী গড়ে উঠেছে যাতে করে সব উচ্চ মাত্রার চর্বিসমৃদ্ধ খাবার লোভনীয় রূপে পরিবেশিত হয়। লাল মাংস, অতি তেলের ব্যবহার, মেদবহুল উপাদানে সমৃদ্ধ করে খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালীর কারণে মানুষ রসনার কাছে পরাজিত হয়ে ওইসব খাবার অবলীলায় গ্রহণ করে। এর ফলে দেহে কোলেস্টরল, ট্রাই-গ্লিসারাইড এবং কম ঘনত্ব ও অতি কম ঘনত্বের খারাপ চর্বির মাত্রা রক্তরসে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে রক্তনালীর প্রবহন-ক্ষমতা বিলোপ পেয়ে উচ্চরক্তচাপ সংঘটিত হয়। তাই উচ্চ রক্তচাপকে ঠেকাতে হলে চর্বি-জাতীয় খাবার মাত্রার বাইরে গ্রহণ বর্জনীয়। রসনায় লাগাম টেনে জীবনের পথকে দীর্ঘ করে তুলতে তাই অতিরিক্ত চর্বি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ : নুনের মতো ভালোবাসায় কনিষ্ঠা রাজকন্যার দুর্গতি হয়েছিলো রূপকথায়। তেমনি যারা অতিরিক্ত নুনকে ভালোবাসেন বা যারা ভাতের সাথে আলগা লবণে অভ্যস্ত তাদের জন্যেও জীবন হতে পারে জ্বালাময়। কেননা লবণে বিদ্যমান সোডিয়াম দেহের মধ্যে অতিরিক্ত জল ধরে রাখে, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে দেহের মধ্যে অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে ব্রেন, হার্ট ও কিডনীর মতো টার্গেট অর্গানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে জীবনকে করে তুলতে পারে বিকলাঙ্গ। অতএব, সময় থাকতেই আলগা নুনের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে কেবল রান্নার লবণে অভ্যস্ত হোন।
দেহস্থলতা : স্থুলদেহ সকল রোগের আকর। স্থুলদেহের অধিকারী ব্যক্তিমাত্রেই অসুখী এক ব্যক্তি। তাই জীবনে শান্তি আনতে হলে অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলুন। প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ, অলসতা পরিহার, শারীরিক পরিশ্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে দেহকে মেদমুক্ত করুন। অনেকের ভুল ধারণাÑঅনাহার চর্চায় কিংবা ডায়েটিংয়ের মাধ্যমে মেদস্থুলতা কমানো যায়। এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। অনাহার চর্চা বা ডায়েটিংয়ে শরীর দুর্বল হয়, মাংসপেশীর ভাগ কমে যায় এবং এতে অসুস্থতা বাড়ে। তাই কার্যকর পন্থায় মেদস্থূলতা কমাতে প্রচুর শাক-সবজি ও ফলমূল আহারের কোনো বিকল্প নেই। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে মেদবিহীন দেহ একটি অতি দরকারী অনুষঙ্গ।
দৈহিক পরিশ্রমে অনীহা : প্রাচীন প্রবাদে বলে, পরিশ্রমে সুখ আনে। বাস্তবিক এ কথায় শতভাগ সত্যতা মেলে। যে ব্যক্তি পরিমিত দৈহিক পরিশ্রম করেন নিয়মিত, তার দেহে অতিরিক্ত মেদ সঞ্চিত হতে পারে না। এমনকি পরিশ্রমের কারণে দেহের রক্তনালীর অভ্যন্তরে রক্ত সঞ্চালন স্বাস্থ্যকরভাবে বজায় থাকে। দেহে সঞ্চিত অতিরিক্ত ক্যালোরির দহন ঘটিয়ে পরিশ্রম দেহকে তনু-সুখে সুখী করে।
যতো দিন যাচ্ছে বাঙালি ততোই পরিশ্রমে বিমুখ হচ্ছে। অল্প দূরত্ব যেতে হলেই চাই রিকশা বা গাড়ি। নিজে কাজ না করে সকল কাজ ভৃত্যকে দিয়ে করানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে আজকাল। অথচ স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্যে দৈনিক নিয়মিত হাঁটা, নিয়মিত খেলাধুলা ও পরিমিত দৈহিক পরিশ্রম অতি জরুরি। তাই উচ্চচাপকে লাগাম টানতে হলে নিজের ঘাম ঝরান, দু পায়ে চলতে শিখুন আর নিজ কাজকে লজ্জা ভেবে দূরে ঠেলবেন না।
এতোক্ষণের আলোচনায় যে সকল পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি নিয়ামকের কথা বলা হলো তাছাড়াও আরো কিছু অভ্যাস আজকাল আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এসব অভ্যাস বা কু-অভ্যাস কিন্তু আমাদের উচ্চ রক্তচাপের পিছনে কম দায়ী নয়।
নিবারণযোগ্য কু-অভ্যাসসমূহ
* অতিরিক্ত মানসিক চাপ
* অনিদ্রা বা অধিক রাত্রি জাগরণ এবং রাত জেগে টিভি দেখা
* অত্যধিক সামাজিক নিমন্ত্রণ রক্ষা
* যখন-তখন ব্যথার ঔষধ গ্রহণ
* চিকিৎকের পরামর্শ ব্যতীত প্রেসারের ঔষধ বন্ধ করা
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
আধুনিক জীবনের প্রাপ্তি এই যে তা মানুষকে কাজ সহজ করার সামর্থ্য দিয়েছে। কিন্তু আধুনিক জীবনের বেদনা এইÑতা মানুষকে অত্যধিক মানসিক চাপের ভার চাপিয়ে অসুখী করেছে। সূর্যোদয় হতে গভীর রাত পর্যন্ত নানা চাহিদার টানা-পোড়েনে মানুষ অত্যধিক চাপগ্রস্ত। কাজেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মানসিক চাপ হ্রাস করার জন্যে নিজেকে নিজে বিনোদিত করার ব্যবস্থা করুন। কখনও গান শুনে, কখনো কাজের ফাঁকে গল্প করে কিংবা পর্যাপ্ত নিদ্রামগ্ন থেকে অথবা কর্ম-কোলাহল হতে ছুটি নিয়ে নৈঃশব্দে মেতে থেকে মানসিক চাপ কমান। এতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে।
অনিদ্রা বা অধিক রাত্রি জাগরণ
জীবনকে সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত সুনিদ্রা অপরিহার্য। কিন্তু আজকাল মিডিয়ার কল্যাণে কিংবা টিভি চ্যানেলের কল্যাণে গভীর রাত অব্দি টক-শো কিংবা সিরিয়াল কিংবা অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে রাত কেটে ভোর হয়। ঘুমের আর সময় থাকে না। ফলে সকালে উঠে মনে হয় এ কেমন সকাল হলো রাতের চেয়েও আঁধার। বাস্তবিক অর্থে অনিদ্রায় শারীরিক সুস্থতা বিঘিœত হয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। আর এই কারণেই প্রবচনে বলতো ঊধৎষু ঃড় নবফ, বধৎষু ঃড় ৎরংবÑএর কথা। যথাসময়ে নিদ্রা গমন এবং নিদ্রা উত্থান তাই উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক।
অত্যধিক সামাজিক নিমন্ত্রণ রক্ষা
মানুষ সামাজিক জীব বলেই মানুষকে আজকাল ঘন ঘন সামাজিক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়। মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বাড়ার কারণে ওই সকল নিমন্ত্রণে চর্বিসমৃদ্ধ খাবারের ছড়াছড়ি। ওইসব গুরুপাক খাবারে হু-হু করে বেড়ে যায় রক্তের কোলেস্টরল এবং খারাপ চর্বির মাত্রা। ফলে উচ্চ রক্তচাপ উস্কানি পায় অহরহ। তাই আজ ভেবে দেখার সময় এসেছেÑসকল সামাজিক নিমন্ত্রণ রক্ষা করা জরুরি কি না। প্রয়োজনে আমন্ত্রণ রক্ষা করে নিমন্ত্রণকে এড়ানো জরুরি। এতে উভয়কূল তথা সম্পর্ক ও রক্ষা হলো, স্বাস্থ্যও রক্ষা হলো।
যখন-তখন ব্যথার ঔষধ গ্রহণ
সকলের প্রতি সম্মান অটুট রেখেই বলি বাংলাদেশে এখন যত্রতত্র চিকিৎসকের ছড়াছড়ি। এই চিকিৎসকেরা আর কেউ নন, পাড়ার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠা ঔষধের দোকানদার যাদের না আছে কোনো ফার্মাসিস্ট সনদ, না আছে কোনো প্রশিক্ষণ। এলাকার রোগীরা তাদের কাছে গিয়ে দু-একটা বিষ-ব্যথার বড়ি চাইলেই তারা অকপটে দিয়ে দেন ডাই-ক্লোফেনাক সোডিয়াম, ন্যাপ্রোক্সেন সোডিয়াম, এসিক্লোফেনাক, কিটোরোলাক জাতীয় ব্যথার ঔষধ। ঘন ঘন এই সব ঔষধ খেয়ে খেয়ে রোগীদের কিডনী ও হার্টের ক্ষতি হয় এবং উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়। তাই নিজের স্বার্থেই নিজেকে সচেতন হতে হবে। পাড়ার দোকানদারের জ্ঞানশূন্য প্রেসক্রিপশনকে আজ উপেক্ষা করার সময় এসেছে। সচেতন হয়ে নিজের স্বাস্থ্য নিজেই রক্ষা করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত প্রেশারের ঔষধ বন্ধ করা
অনেক রোগী আছেন ক্রনিক কেয়ার এর ঔষধ নিয়মিত খান না। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধকেও তারা অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের মতো রেসকিউ থেরাপীর মতো করে ব্যবহার করেন। যখন উচ্চরক্তচাপের উপসর্গ বাড়ে তখন তারা ঔষধ খান, যখন ভালো থাকেন তখন ঔষধ বাদ দেন। এ কারণে অনেকের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে না এবং দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তাই কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। মনে রাখা উচিৎ, আপনার রক্তচাপ ঔষধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আছে। বন্ধ করলেই বেড়ে যাবে।
পরামর্শ
জন্ম আছে বলেই জ্বরা আছে, ব্যাধি আছে। মানুষের জীবন প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতির অধীন। অর্থাৎ কার্যকারণনির্ভর। ইহা করিলে উহা ঘটিবে-এই নীতির আওতায় মানুষের জীবন। তাই কার্যকর পরামর্শ মেনে চলা এবং স্বাস্থ্যকর চর্চার পরিচর্যা করা সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে জরুরি। উচ্চ রক্তচাপকে লাগামে রাখতে হলে :
* প্রচুর আঁশযুক্ত, চর্বিমুক্ত খাবার খান।
* শাক-সবজি, ফলমূল, বেশি করে খান।
* মানসিক চাপমুক্ত থেকে হাসি আনন্দে জীবন গড়–ন।
* রাত্রি অধিক জাগরণ না থেকে সময়মত নিদ্রার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
* শারীরিক শক্তি ব্যয় হয় এমন ব্যায়াম করুন যাতে দেহে অতিরিক্ত ওজন না জমে।
* ধূমপান, অ্যালকোহল সেবনের মতো কু-অভ্যাস মুক্ত থাকুন।
* সর্বদা সুষম খাবারে মনোযোগী হোন। খাবারে তেল-মশলার ব্যবহার কমান। আলগা লবণ বর্জন করুন।
* প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। চিকিৎসক আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে উপযুক্ত বন্ধু।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন পাঠান।
ই-মেইল : [email protected]