শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

রেলপথে নাশকতা রোধে নিরাপত্তা প্রযুক্তি

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
রেলপথে নাশকতা রোধে নিরাপত্তা প্রযুক্তি

পুরোপুরি সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত এ ধরনের মডেল বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংযোজন করার পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। এজন্য এখনই মেট্রোরেলের পাশাপাশি সমস্ত রেলপথের বিভিন্ন স্থানে গুগল ম্যাপের সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রাকিং ডিভাইস বসাতে হবে। দেশের বিভিন্ন মোবাইল টাওয়ারকে এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। অতঃপর সমস্ত রেলপথকে সফটওয়্যারের আওতায় এনে কম্পিউটারাইজড রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে

নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং যানজটমুক্ত ভ্রমণের জন্য সারাবিশ্বের মানুষের প্রথম পছন্দ রেলওয়ে। পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে ভ্রমণের কয়েক ঘণ্টা কিভাবে যে কেটে যায়, তা টেরই পাওয়া যায় না। উন্নত দেশে প্রত্যেকটি শহর এমনকি গ্রামের সঙ্গেও ট্রেনের যোগাযোগ খুবই সমৃদ্ধ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের জন্য থাকে বিশেষ সাশ্রয়ী টিকিট ব্যবস্থা। ইউরোপে সপ্তাহের শেষ দিনে সকলের জন্য আছে এক টিকিটে পাঁচজন ভ্রমণের ব্যবস্থা। হরেকরকম খেলাধুলা ও বিনোদনে ভরপুর সুইজারল্যান্ডের ট্রেনে শিশুদের জন্য আছে ‘কিন্ডার কম্পার্টমেন্ট’। শপিং মল, পোস্ট অফিস এবং স্টেশন কাউন্টার ও ছোট ছোট কিওস্কে (Kiosk) ২৪ ঘণ্টা টিকিট পাওয়া যায়।

আবার সাশ্রয়ী মূল্যে পুরো একদিন, এক সপ্তাহ, এক মাস, তিন মাস এবং ১২ মাস ভ্রমণ করা যায়- এমন টিকিটেরও ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রে বারোমাসি টিকিটে ৯ মাস এবং সাত দিনের টিকিটে ছয় দিনের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ট্রেনকে জনমুখী করার জন্য এ রকম আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এসব ছাড়াও সময়মতো ট্রেন ছাড়া এবং গন্তব্যে পৌঁছানো এ অঞ্চলের ট্রেনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ফলে, চাকরিজীবীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে ট্রেনে যাতায়াতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষিত চালক, আধুনিক প্রযুক্তি। সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্ক দ্বারা সমস্ত কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে, যে কোনো দুর্ঘটনা বা নাশকতা কখন কোথায় ঘটে, তা সহজেই অবলোকন করা যায়।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে। বর্তমানে রেললাইনের দৈর্ঘ্য মোট প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি। এসব পথের এখনো ৬০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ। আর ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এ কারণে প্রায়ই কিছু স্বাভাবিক দুর্ঘটনা ঘটে। পরিসংখ্যান মতে, রেল দুর্ঘটনার ৭২% মানব-ত্রুটিজনিত, ২৩% যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত এবং বাকি ৫% অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এবং যানবাহন চালক ও পথচারীদের অসতর্কতার সঙ্গে রেল ক্রসিং পারাপারের কারণে ঘটে।

মানব-ত্রুটিসমূহের মধ্যে রয়েছে লোকোমাস্টার, স্টেশনমাস্টার ও পরিচালকের ত্রুটি বা অবহেলা এবং বেপরোয়াভাবে ট্রেন চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে লোকোমোটিভের ত্রুটি, ত্রুটিযুক্ত ট্র্যাক ও সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে। ২০০৮-২০১৯ সালে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৩১০টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশে অন্তত ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ স্পট চিহ্নিত করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনা রোধে গত ১০ বছরে ৩৮১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ, ৩৪৭টি রেলসেতু নির্মিত হয়েছে। ক্রয় করা হয়েছে ১৪০টি ইঞ্জিন, প্রায় ৪০০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ। চালু হয়েছে ১৩৫টি নতুন ট্রেন। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার নতুন কর্মী। সম্প্রতি ৩০০ কিলোমিটার গতির ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা দরকার, সেটা রেলের নেই।

এছাড়া কয়টার ট্রেন কখন আসবে কিংবা ছাড়বে অনেক সময়ই কেউ বলতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের বসে থাকা রেলের একটি স্বাভাবিক বিষয়। সম্প্রতি ঢাকাবাসীর জন্য সংযুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল সার্ভিস। রেলের এসব উন্নয়নের অধিকাংশই হয়েছে এই সরকারের আমলে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ৪৪টি জেলায় রেলপথ নেটওয়ার্ক আছে। সম্প্রতি সরকার ৩০ বছর মেয়াদি যে রেল মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে, তাতে বাকি সব জেলায় রেলপথ যাবে।

রেলের উন্নয়নের বিপরীতে এর আর্থিক লোকসানের খবরটিও প্রায়ই পত্রিকায় আসে। রেলের উন্নয়নে গত ১০ বছরে খরচ হয়েছে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। আকাশছোঁয়া বিনিয়োগের পরও প্রতিষ্ঠানের লোকসান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের পরও ট্রেনের গতি তো বাড়েইনি, উল্টো কমেছে। নিত্যদিনের টিকেট কালোবাজারি, বিনামূল্যে ভ্রমণ, গরমে রেলের লাইন বাঁকা হয়ে যাওয়া, বগি লাইনচ্যুত হওয়া ইত্যাদি অস্বাভাবিক দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গভীর রাতে লাইন খুলে ফেলা, বগিতে আগুন দেওয়া, অক্সিঅ্যাসিটিলিন দিয়ে রেললাইন গলিয়ে ফেলা ইত্যাদি অপকর্ম ও নাশকতা।

প্রসঙ্গত, অক্সিজেন ও অ্যাসিটিলিন গ্যাসের মিশ্রণে গঠিত অক্সিঅ্যাসিটিলিন লোহা বা ধাতব পদার্থ গলাতে ব্যবহার করা হয়। এসব নাশকতায় গত দেড় মাসে রেলপথের ১২টি স্থানে এবং ৫টি ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে। তিনটি স্থানে রেললাইন কাটা এবং ফিশপ্লেটের ক্লিপ খুলে নেওয়া হয়েছে। ঘটনায় মা ও শিশুসহ অন্তত ৫ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ইঞ্জিন, কোচ ও রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রেলের প্রায় ৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। নাশকতা এখনো চলমান। ফলে যাত্রী এবং ট্রেনের নিরাপত্তার বিষয়টি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব নাশকতা রোধে জরুরি ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেগুলো হলো- পুরো রেল করিডর সিসিটিভির আওতায় আনা।

চলন্ত ট্রেনের প্রতিটি বগিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখা। স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা (এটিপিএস) চালুর ব্যবস্থা করা। রেললাইনের ওপর বাজার, মানুষ ও পশু বিচরণ বন্ধ করা, সংলগ্ন বস্তি না রাখা। ছাদে ভ্রমণ বন্ধ, টিকেটের কালোবাজারি রোধ, পর্যাপ্ত ই-টিকেটের ব্যবস্থা করা। চালকবিহীন এবং আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত ইলেকট্রনিক ট্রেন চালু ইত্যাদি।

ভ্রমণপিপাসুদের নিরাপদ, যানজটমুক্ত ভ্রমণের জন্য ‘উল্টো রেল’ বা ঝুলন্ত রেলপথ চালু করে জার্মানি ১৯০১ সাল থেকে। ১৯২৫ সাল নাগাদ এই রেলওয়ে ২০ মিলিয়ন যাত্রীকে বহন করে মাইলফলক তৈরি করে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে এই রেল দিয়ে। ঝুলন্ত রেলপথ বা সাসপেনশন রেলপথ হলো এলিভেটেড মনোরেলের একটি রূপ। যেখানে গাড়িটি একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাক থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে (এরিয়াল ট্রামওয়েতে ব্যবহৃত তারের বিপরীতে), যা রাস্তা, নৌপথ বা বিদ্যমান রেলপথের ওপরে নির্মিত হয়। ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ায় গণচীনেও এই মডেলটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

চলে জাপানেও। তবে চীনের উচ্চগতির ম্যাগলেভ (ম্যাগনেটিক লেভিটেশন) ট্রেন, যা ঘণ্টায় ৬২০ কিলোমিটার (৩৮৫ মাইল) গতিতে ছুটতে সক্ষম, বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে সাংহাইতে। এই প্রযুক্তির ট্রেনে দুই সেট চুম্বক ব্যবহার করা হয়। এক সেট চুম্বক ট্রেনটিকে ট্র্যাক বা লাইন থেকে সামান্য উঁচুতে শূন্যে ভাসিয়ে রাখে, দ্বিতীয় সেট চুম্বক ট্রেনটিকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে, সাধারণ ট্রেনের মতো এতে চাকা ও লাইনের মধ্যকার ঘর্ষণজনিত শক্তিক্ষয় থাকে না। এই মডেলটিকে আরও উন্নত করে ‘ইপারলুপ ট্রেন’ নামে বাজারে ছেড়েছে টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ২০১৩ সালে।

হাইপারলুপ ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১২শ’ ৩০ কিলোমিটার বা ৭৬০ মাইল। অর্থাৎ হাইপারলুপ ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। যুক্তরাষ্ট্রসহ বর্তমানে বেশ কয়েকটা দেশ হাইপারলুপ নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু করেছে। ভারতের চেন্নাই-ব্যাঙ্গালুরুর মধ্যে ৩৪৫ কিলোমিটার পথকে প্রস্তাবিত হাইপারলুপ ট্রেনের বিবেচনায় নিয়েছে ভারত সরকার। আবুধাবি থেকে দুবাই, হেলসিংকি থেকে স্টকহোমসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটা রুটে হাইপারলুপ নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।

পুরোপুরি সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত এ ধরনের মডেল বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংযোজন করার পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। এজন্য এখনই মেট্রোরেলের পাশাপাশি সমস্ত রেলপথের বিভিন্ন স্থানে গুগল ম্যাপের সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রাকিং ডিভাইস বসাতে হবে। দেশের বিভিন্ন মোবাইল টাওয়ারকে এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। অতঃপর সমস্ত রেলপথকে সফটওয়্যারের আওতায় এনে কম্পিউটারাইজড রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। প্রত্যেকটি স্টেশনে সার্ভার বসিয়ে পর্যবেক্ষণ করত কেন্দ্রীয় সার্ভারে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারলে নাশকতা প্রতিরোধে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞানের জন্য চীন, জাপান কিংবা জার্মানির বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই অভাবের তাড়না কিংবা টাকার লোভে এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত প্রমাণিত হয়েছে। তাই বরাবরের মতো সরকারি দল কর্তৃক বিরোধী দলকে কিংবা বিরোধী দল কর্তৃক সরকারি দলকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়