প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শোকাবহ আগস্ট। পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল গভীর অন্ধকারে। কিন্তু বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসীম ধৈর্য, সাহসিকতা, অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে অন্ধকার জাতিকে আজ আলোকিত করেছে বিশ্ব দরবারে। স্বাধীনতার পর একটি ক্ষতবিক্ষত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার বীজ বপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালেই। তখন চলছিল বিশ্বের তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের যুগ।
বঙ্গবন্ধু সেই শিল্প বিপ্লবের যুগে পিছিয়ে থাকতে চাননি। বঙ্গবন্ধু দেখলেন, তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার কোনো কোনো দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার এ বিপ্লবের গতি, প্রভাব ও ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করেছে। জাপান, চীন, কোরিয়াসহ এশিয়ার কিছু দেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব থেকে সৃষ্ট সুযোগকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। আর্থ-সামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয় তাঁরই নির্দেশে। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ-স্টেশনের উদ্বোধন করেন। স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপন প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ, সর্বোপরি ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ সুগম করে। ফলে, বাংলাদেশ সহজেই বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। একটি দেশের উন্নতিতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা যে অত্যাবশ্যকীয়, যা আমরা এখন বুঝতে পারছি, বঙ্গবন্ধু তা অনুধাবন করেছিলেন অনেক আগেই। এছাড়াও বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার মতো একজন বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন এবং শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল তাঁর অত্যন্ত সুচিন্তিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি, যা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বিপ্লবে অংশগ্রহণের পথ দেখায়।
এরপর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দার্শনিক প্রত্যয়টির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর ২০০৮। ‘রূপকল্প ২০২১’ এর চেতনায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বাংলাদেশ বর্তমান বিপ্লব সাধন করে চলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে গত ১৫ বছরের মধ্যে সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও সুপরামর্শে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি এবং মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির ওপরে। সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ ৫৬ হাজার ২৯৮ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ গিগাবাইট ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগণ ও সরকারি অফিসগুলোতে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ হচ্ছে। প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকায় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিয়ে সারাদেশে বৈষম্যহীন ‘এক দেশ- এক দর’ শুল্ক ব্যবস্থা চালু করার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ এএসওসিআইও-২০২২ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
সবার জন্য কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নমেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন- এই চারটি সুনির্দিষ্ট প্রধান স্তম্ভ নির্ধারণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হয়ে ইতোমধ্যেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে সারাবিশ্বকে। দেশব্যাপী ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জনগণ ৩০০-এর অধিক নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা পাচ্ছে। আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫ সালে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। টেকসই উন্নয়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণে অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৩২তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার ক্লাবে যোগদান করেছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে আজ পৌঁছেছে অনন্য উচ্চতায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম রূপকল্প-২০২১ আজ বাস্তবতা, যা অর্জন করে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জাতি। দ্বিতীয়, ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন; তৃতীয়, ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থ, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সালের মধ্যে রয়েছে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা।
চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল বাস্তবতা, উদ্দীপিত বাস্তবতা, রোবোটিকস অ্যান্ড বিগ-ডাটা সমন্বিত ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে বহুমুখী কার্যক্ষমতা সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পর তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করতে যাচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৩৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ক্ষমতা অর্জন করেছে। তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পর এটি ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএসে উন্নীত হবে। ইন্টারনেট গতির এই সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হবে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, যারা ঘরে বসে আয় করবে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার। ফলে, বাড়বে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগও। প্রতিষ্ঠিত হবে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ, যার চরিত্র হবে (১) স্মার্ট সিটিজেন; (২) স্মার্ট গভর্নমেন্ট; (৩) স্মার্ট ইকোনমি এবং (৪) স্মার্ট সোসাইটি।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।