প্রকাশ : ১১ মে ২০২৩, ০০:০০
প্রাণের শহর চাঁদপুর! প্রিয় চাঁদপুরকে নিয়ে লিখতে গেলেও নির্দিষ্ট পরিমাণ যোগ্যতা থাকা চাই। আর কিছু না হোক, কম করে হলেও প্রিয় শহরের প্রতি থাকা চাই ভীষণ রকম ভালোবাসা, মায়া ও মোহ! আমার ভেতরে এর কতটুকু বিদ্যমান তা জানা নেই। তবে হৃদয়ের ঘরে প্রিয় এই শহরের প্রতি যে টান অনুভব করি, শহর ছেড়ে দূরে গেলে ভেতরে ভেতরে যে মায়া বোধটা কাজ করে সেটাকে আমি চাঁদপুরের প্রতি আমার ভালোবাসা বলেই ধরে নেই।
আমি আমার এই জন্মস্থান, এই শহরের মোহে আচ্ছন্ন! যতবার এই শহরটাকে দেখি ততবারই অবাক হই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার শহরের যে চিত্র আমি লোকমুখে শুনি, ফেসবুক ওয়ালে এর ইতিহাস, ঐতিহ্যের যে প্রশংসা দেখি, তা মূলত আমারই প্রশংসার সমপরিমাণ। কারণ, আমি তো তার কোলে বেড়ে ওঠা এক শিশু, এক কিশোর, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বৃদ্ধ!
মায়ের মমতাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মমতা বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ খেয়াল করলে দেখা যায়, একাধিক সন্তানের দেখাশোনা করতে গিয়ে মা কখনো কখনো এক সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেন অধিক, আর অন্য সন্তানের প্রতি তুলনামূলক কিছুটা কম।
চাঁদপুরের মাটিকে আমি মা বলে সম্বোধন করলে তার তুলনামূলক কমস্নেহে বেড়ে ওঠা সন্তান হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করি। কারণ আমি তার কেন্দ্রভূমিতে জন্মাতে পারি নি। আমাকে জন্মাতে হয়েছে হাইমচরে।
এ-নিয়ে আমার দুঃখ হয় না।
অনেক ঘটনা প্রবাহরে প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুটি বিষয়, দুটি ব্যক্তিত্ব কিংবা দুটি বস্তুর মাঝে সাময়িকী দূরত্ব বজায় থাকার কারণে পরবর্তীতে তাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বেড়ে হয়ে গেছে অসীম!
আমার জন্মদায়িনী মা কখনো আমাকে শহরমুখী করতে চাইতেন না। শহরের পরিবেশ চিনে ফেললে, শহরের আলো-বাতাসের মোহে পড়ে গেলে ছেলে-মেয়েরা নাকি ঘরে থাকতে চায় না। বাবা-মায়ের উপর সামান্য মান অভিমান হলেই নাকি তারা শহরমুখি হয়ে পড়ে। শহরে ছুটে আসে। গৃহত্যাগী হয়ে যায়! এসবই বিশ্বাস করতেন আমার মা। এসব কথা আর এর উপর আমার মায়ের অটল বিশ্বাসের কারণে শৈশবে চাঁদপুর শহর দেখার এবং চাঁদপুর শহর সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি।
শহরে যাতায়াত তো একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিলো ! কিন্তু লক্ষ্মীপুরে মামাবাড়ি হওয়ার সুবাদে সেখানে যাতায়াতে কোনো প্রকার সমস্যা হয়নি। পড়াশোনার ফাঁকেফাঁকে স্কুল থেকে প্রাপ্ত ছুটি সমূহের অধিকাংশ কেটে যেত মামাবাড়ি। মামা বাড়ি যাওয়া-আসা নিয়ে মা কখনোই রাগ করতেন না, বরং আমি 'স্কুল বন্ধ দিয়েছে, বেড়াতে যাবো' বললে মা আমাকে সোজা মামা বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিতেন।এবং সেখানেই পাঠাতেন।
সে হিসেবে শৈশবে রায়পুর, লক্ষ্মীপুরকে কাছ থেকে দেখার দারুণ সুযোগ হয়েছিলো।
লক্ষ্মীপুর শহরের সেই সৌন্দর্য, সেই ঐতিহ্য আমাকে মুগ্ধ করতো। সেখাকার পরিবেশ পরিস্থিতি, শহরের নানাবিধ সুযোগসুবিধা, ঘুরে দেখার জন্য দীঘির পড়া, বিভিন্ন ধরণের পার্ক সবই আমাকে মুগ্ধ করতো। এসব দেখে প্রায়ই আনমনে ভাবতাম, 'আহ, আমার জন্ম যদি লক্ষীপুর হতো তাহলে কতইনা ভালো হতো! '
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মামাবাড়ির সাথে কেমন যেনো একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।
মামানীর পূর্বের সে আদর, মামাতো বোনদের স্নেহ সবই যেনো কর্পূরের মতো উড়ে যেতে লাগলো।
এভাবে আস্তে আস্তে লক্ষীপুরের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।
সময়ের বিরতিহীন চলনের প্রভাবে একসময় বড় হলাম। মা-ও আর আগের মতো আমাকে নিয়ে অতটা দুশ্চিন্তায় অস্থির হন না।
সময়, সুযোগ আর ইচ্ছের মিল হয়ে গেলো যেকোনো জায়গার যেকোনো শহরে গমনাগমন ছিলো হাতের নাগালে।
এভাবেই আস্তে আস্তে আমার আপন শহর 'চাঁদপুরে' বিচরণ শুরু হয়।ধীরে ধীরে চাঁদপুর প্রতি মনের মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে ভালোবাসা, আবেগ!
প্রথমপ্রথম চাঁদপুরের কিছুই চেনা ছিলো না। কালিবাড়ি স্টেশন থেকে কোনক্রমে চিত্রলেখার মোড় কিংবা স্টেডিয়াম রোড আসতে পারলে ঠিক কোন রাস্তা ধরে ফের কালিবাড়ি পৌঁছাবো তা খুঁজে পেতাম না। টাকার জোরে রিকশাওয়ালা মামা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় গন্তব্যে পৌঁছে দিলেও নিজ বুদ্ধি-বিবেচনায় সঠিক রাস্তা খুঁজে শহরের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছাতে পারার আনন্দই ছিলো আলাদা।
হাইমচর থেকে রওনা দিয়ে চাঁদপুর অভিমূখে ঠিক ব্রিজের ওপর ধীরগতি সম্পন্ন সিএনজি থেকে বড়স্টেশনকে দেখে একখানা ছোট্ট দ্বীপ বলে মনে হতো।
নিজ বুদ্ধি-বিবেচনায় রাস্তা খুঁজে শহরের অলিগলি সুন্দর জায়গাসমূহ দেখার জন্য প্রবল আত্নবিশ্বাসের বীজ নিজ মনের মধ্যে যেভাবে বপন করেছিলাম , সে হিসেবে ব্রিজ থেকে দেখা বড়স্টেশনকে আমি আমার মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলাম। সহজে সেখানে হেঁটে যাওয়া রাস্তা হিসেবে কল্পনা করতাম ব্রিজেট নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর অংশবিশেষে, তার পাড়!
এর কিনারা ধরে হেঁটে গেলে অবশ্যই আমি বড় স্টেশনে ঠিক ঠাক পৌঁছে যেতে পারবো এরকম ধারণা এখনো আমার মনের মধ্যে বদ্ধপরিকর। অথচ বড় স্টেশনের মনমুগ্ধকর হাওয়া খেতে যাওয়ার বেলায় প্রতিবারই আমি রিকশায় চড়ে বড় স্টেশনে গিয়েছি, এখনও যাই...
সেখানে গিয়ে উপভোগ করি মনমাতানো বাতাস, বড়বড় বৃক্ষ সমূহ এবং নদীর জলের কলকল ধ্বনি।
রাত্রিবেলা বড়স্টেশনে গেলে নদীর জলের উপরে প্রতিফলিত আকাশের তারা সমূহকে মনে হয় একযোগে পাতিহাসেরা যেনো ডুবেডুবে সাঁতার কেটে যাচ্ছে।
এছাড়াও আমার প্রাণের শহর চাঁদপুর তার আত্ম বিশেষত্বে মহীয়ান!
বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'ইলিশের বাড়ি কোথায়?'
প্রতিউত্তরে 'চাঁদপুর' নামটা মুখে নিতে কেউই কুণ্ঠাবোধ করবে না। চাঁদপুরের ইলিশের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া । এছাড়া চাঁদপুর শহরের ঐতিহ্য হিসেবে
ইলিশ চত্বর, মোলহেড (ত্রিনদীর সঙ্গমস্থল), অঙ্গীকার ভাষ্কর্য, রক্তধারা স্মৃতিসৌধ, শপথ চত্বর ইত্যাদির কথা দেশজুড়ে। যতবার এই স্থাপনাগুলোর মুখোমুখি হই কিংবা তার সম্মুখ পথে গন্তব্যের দিকে পৌঁছানোর চেষ্টা করি, ততবারই মনে হয় এই স্মৃতিস্তম্ভ গুলো আমায় কাছে ডাকে। কানেকানে বলতে চায়, সময়ে সময়ে সাক্ষী হওয়া ঘটনা সমূহ!
এছাড়াও চিকিৎসার দিক দিয়েও চাঁদপুর সমৃদ্ধ! আম্মুর কাছ থেকে প্রায়ই শুনতে পাই অসুখের কারণে মামা এবং তার পরিবারের সকলে চাঁদপুরেই চলে আসেন ডাক্তার দেখাতে। যে লক্ষীপুরকে একসময় নিজের জন্মস্থান হওয়ার আকাঙ্খায় এঁকে বসাতাম , সেই লক্ষীপুরের বাসিন্দারা যখন চিকিৎসার জন্য আমার প্রাণের শহর চাঁদপুরের দিকে ছুটে আসে তখন সত্যিই খুব ভালো লাগে, আনন্দ অনুভূত হয়।
আজও যখন ফেসবুকে মানুষ চাঁদপুরে না জন্মানোর আফসোস প্রকাশ করে তখন নিজের কাছে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় ।
চাঁদপুর শহরের অলিগলি, প্রশস্তরাস্তা, ল্যাম্পপোস্টে দীপ্তিমান আলোয় আঁকা সন্ধ্যার সৌন্দর্য, এই শহরে জন্মানো, শহরের বুকে বিচরণ করা প্রতিটা মানুষ নীরবে উপলব্ধি করে তৃপ্তিপায়।
এমন অনেকেই আছেন যারা চাঁদপুরে জন্মে এখানেই বেড়ে উঠেছেন এবং এখানে ত্যাগ করেছেন নিজেদের শেষনিঃশ্বাস। চাঁদপুরের সন্তান হিসেবে এর বুকে আমৃত্যু থেকে যাওয়ার ইচ্ছে রেখে আমারো দিন এগোয়!
একই আকাঙ্খা নিয়ে গতকালও জন্মেছে নতুন অস্তিত্ব, নতুন প্রাণ।
ভবিষ্যতেও জন্মাবে কালের ধারা অব্যাহত রাখার
উদ্দেশ্যে একই প্রাণ, উদ্দেশ্য জন্মস্থলে প্রয়াণ...