প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
আমার সাংবাদিকতা ও চাঁদপুর কণ্ঠ
‘চাঁদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে হয়েছ সবার কণ্ঠ, মমতায় রেখেছ ঘিরে প্রিয় চাঁদপুর কণ্ঠ।’ গরিবের ঘোড়া রোগের মতোই আমার খায়েশ জন্মেছিল সাংবাদিক হওয়ার। সেই আশির দশকের কথা। আমি যেই কালচারে শেখার ভোঁতা দা-টাকে শান দিয়েছি, তাতে আদর্শ মানুষ হওয়াটাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো। নীতিনৈতিকতাকে পর্বতসম দেখা হতো। অনিয়মের ছায়া মাড়ানোকেও মনে করা হতো মহাপাপ। আমার ওপর তখনও শেখার নেশাটা চরমভাবে ভর করেছিল। জ্ঞানরাজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার সম্মোহনখানি আমার চোখের তারায় জ্বলজ্বল করত। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’ পঙ্ক্তি ছিল আমার ধ্যানে-জ্ঞানে মাখা। বলতে গেলে দিব্য সাধনাও।
এ সময় আমার অনুভবের বারান্দায় আবছা আলোয় হাজির হয় সাংবাদিকতা। পরশ পাথরে সোনা পরখ করার মতো জানতে পারি- এটি এক মহান পেশা, এটি এক ভিন্ন জগৎ। এখানে সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলাটাই পুরোদস্তুর চর্চা হয়। সাদা-কালোর মাঝে যে হলুদণ্ডলাল-নীল বলে কিছু আছে, তা তখনও জানার দুর্ভাগ্য হয়নি। তাই আমার ইচ্ছেনদীতে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠে সাংবাদিক হওয়ার। সেই ঢেউয়ের মাঝেই ওঠানামা করে আমার স্বপ্নের খুদে ভেলা।
ইচ্ছেটাকে পরখ করতে শিশুর হামাগুড়ি দেওয়ার মতো টুকটাক লেখার নামে আঁকজোক শুরু করি। নব্বইয়ের দশকে আমার সাহসের ময়ূরটা পেখম মেলে। একটি জাতীয় সাপ্তাহিকের প্রতিনিধি হওয়ার আবেদন করি। যথারীতি আবেদন মঞ্জুর হয়। সম্পাদকের দস্তখত খচিত আইডি কার্ডও লাভ করি। আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাই। আমার কাঁচা হাতে প্রেরিত সংবাদ ছাপার হরফে দেখে মন তাধিন নাচে। একই সাথে চেষ্টা করি ছড়া-কবিতা লেখার। দুয়েকটি ছাপাও হয়। আমি চোখের তারায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করি। আমার ইচ্ছেনদীর তরতরিয়ে আসা জোয়ারের পানি মহাসাগরে গিয়ে মিলিত হয়। তবে মিঠাপানির মাছ নোনাজলে পড়ার মতো কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খাই। ফলে কিছুটা নোনতা ঠাওর হয় আমার স্বপ্নের সাংবাদিকতা। আমার মাথায় ব্যাপারটি ঘেঁটে দেখার ভূত চাপে। কিন্তু কার শিষ্যত্ব বরণ করবো? কার কাছে মেলে ধরবো আমার নয়া ছাত্রত্বের বাতায়ন?
এরই মাঝে জানতে পারি, এ পেশায় যেমন আছে সাদা মনের সাধক মানুষ, তেমনি আছে ভাঁওতাবাজ, ভেল্কিবাজ, ঠকবাজ, ফেরেববাজ, লোভী, নেশাখোর, লুটেরা, টাউট আর মাস্তানের পাল। পালের ভিড়ে এখানে সৎসাংবাদিকরা অসহায়, সংখ্যালঘু। তারপরও মনকে প্রবোধ দিই- শেয়াল, শকুন আর বাঁদর-ত্যাঁদরের মাঝে কি দুয়েকটি সুবোধ লজ্জাহরিণ থাকবে না?
সময়ের চাকা ঘুরে আসে নতুন শতাব্দী। আমি তখন শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত। লেখালেখিটাকেও সমান তালে চালাতে থাকি। এরই মাঝে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ দৈনিকের দুয়ার খোলে (সাপ্তাহিক থাকাকালেও চাঁদপুর কলেজের পূর্ব গেইটের জিলানী প্রেসের অফিসে আমার যাতায়াত ছিল। শাহাদাত ভাই তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)। আমি পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতের সাথে গুয়াখোলার নতুন অফিসে একান্তে সাক্ষাৎ করি। আমার খুদে রাডারে তাকে মার্জিত মানুষ বলেই মনে হলো। চাঁদপুরের সাংবাদিকতাকে যারা কুক্ষিগত করে রেখেছে, তাকে মনে হলো সেই দুর্বৃত্তায়নের বলয়মুক্ত ব্যতিক্রমী মানুষ। ধন, দল বা বল তার খুঁটির জোর নয়। মূর্খতা ঢাকতে ক্যামেরায় ক্লিক মেরে যারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামায়, চাপার অনৈতিক জোরে যারা নিজ অযোগ্যতাকে ধামাচাপা দেয়, শুধু শাক দিয়ে মাছ নয়, তামাম জগৎ ঢাকার নেশায় যেই ধান্ধাবাজরা বুঁদ, তাদের তুলনায় তাকে মনে হলো ব্যতিক্রম। সিদ্ধান্ত নিই, উদ্যমী এ পেশাদার মহৎপ্রাণ ব্যক্তিটির সামনে শেখার পেয়ালাটা পেশ করবো।
শিক্ষকতা পেশার সাথে তরতরিয়ে চলে আমার শখের লেখালেখির তরি। কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে কথা বলে আমি ‘তোতামিয়ার তিতাকতা’ শিরোনামে একটি সাপ্তাহিক রম্যলেখার অনুমতি নিই। দিন দিন পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে আমার ‘তিতাকতা’। আমার জানা ছিল না যে, এ রম্যকলামটি পাঠকের এতোটা নজর ও মন কাড়বে।
একদিনের কথা। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক মহোদয় (ফরিদগঞ্জ নিবাসী) কোনো এক অনুষ্ঠানে চাঁদপুরে আসেন। যেভাবেই হোক তার হাতে চাঁদপুর কণ্ঠ পৌঁছে। ‘তোতামিয়ার তিতাকতা’ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি আমাকে স্মরণ করেন। যথারীতি হাজির হই তার অনুষ্ঠানে। তিনি আমাকে একান্তে কাছে টেনে বললেন, ‘আপনি এখন থেকে আমার পত্রিকায় একই শিরোনামে লিখবেন।’ আমি যেন আকাশ হাতে পাই। তারপরও সাহসের টলটলায়মান ভেলায় পা টিপে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি- ‘আমাকে যে লেখার অনুমতি দিলেন, হজম করতে পারবেন তো?’ তিনি অভয় দিলেন। প্রায় তিন মাস ওই দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠার মাস্তুলের কোণায় একই লোগো ও একই শিরোনামে দুই কলাম বক্সে ‘তোতামিয়ার তিতাকতা’ প্রকাশ হয়। একদিন ফোনে সম্পাদক মহোদয় জানালেন, ‘ভাই! একটু প্রবলেম হচ্ছে, চাপে আছি।’ আমি তার প্রবলেম ও চাপ কমিয়ে দিলাম।
এরই মাঝে একদিন চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার আমাকে তলব করেন। সন্ধ্যায় হাজির হই তার কক্ষে। ইকবাল ভাই আমার লেখার খুব প্রশংসা করলেন। এতে ‘অল্প পানির মাছ তুত্তুরিয়া নাচে’র মতো আমি আনন্দোচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকি। আমার উৎসাহের পালে ঝড়োবাতাস বইতে থাকে। কোলা ব্যাঙের গলা ফোলার মতো আমার আশার বেলুনটিও ফুলতে থাকে। শখের পায়রা নাচে তাধিন ধিন। ইকবাল ভাই ‘তোতামিয়া’কে সপ্তাহে দুদিন পাঠকের আদালতে হাজির করার ফরমান শোনালেন। আমি সুবোধ বালকের মতো শুক্র ও সোমবার হাজির হতে লাগলাম। মজার ব্যাপার হলো, পাঠকের ভালোবাসা পূরণে এ দুদিন সার্কুলেশন সংখ্যা বাড়াতে হতো।
এরই মধ্যে আমার সাহসের ময়না পেখম মেলে। আমি ইকবাল ভাই ও কাজী শাহাদাত ভাইয়ের কাছে ফুলটাইম চাকরির দরখাস্ত করি। সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর হয়ে যায় আমার মৌখিক আবেদন। সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই নতুন কর্মে- সাংবাদিকতা পেশায়। শাহাদাত ভাইয়ের কাছে পুরোদস্তুর আয়ত্ত করার চেষ্টা করি সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার খুঁটিনাটি। তাই আমি অকপটে স্বীকার করি, আমার সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাইয়ের কাছে। তিনি এ জগতে আমার গুরুজি।
আমার ‘তিতাকতা’ আরও শানদার হয়, জোরদার হয়, টক-মিষ্টি-ঝালের রস পরিগ্রহ করে। অফিসে এমএমএ বাতেন, অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, মহিউদ্দিন সরকার, নূর আহমেদ, শহীদ পাটোয়ারী, গিয়াসউদ্দিন মিলন, মাহবুবুর রহমান সুমন, রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ, বিএম হান্নান, শাহাদাত হোসেন শান্ত, নাজমুস সাহাদাত মিরন, রহিম বাদশা, আলম পলাশ, রোকনুজ্জামান রোকন, গোলাম মোস্তফা, আবু সাঈদ কাউসার, সেলিম রেজা, আবদুল্লাহ আল মামুনদের কাছে আমি ‘তোতাভাই’ নামে নতুন পরিচয় লাভ করি।
সপ্তাহে তিন দিনের সম্পাদকীয় লেখা, প্রতিদিনের নিউজ এডিট করা, কখনও রি-রাইট করা, বিভাগীয় পাতার সম্পাদনা, প্রুফ দেখা চলে সমান্তরাল গতিতে। আবার রাতে থাকতো পেস্টিং টেবিলে শাহাদাত ভাইয়ের শিষ্যত্ববরণের পালা। এক সময় শখটা লাভ করে পেশার রূপ। পেশা থেকে হয় নেশা। বহুবার এমনও হয়েছে, পেস্টিং শেষ করতে করতে কানে ভেসে আসতো ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি।
শাহাদাত ভাই কারও ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন না। তাই তখন পর্যন্ত কোনো ছুটি কাটাতেন না। গুয়াখোলার অফিসকেই বানিয়ে নিয়েছেন নিজের আবাস-নিবাস। আমি মনে মনে তার বোঝা লাঘবের সিদ্ধান্ত নিই। এ ধৈর্য পরীক্ষায় আমি গোল্ডেন মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ হই। পর্যায়ক্রমে আমি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। এ সময়ই শাহাদাত ভাই বিয়ে করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেই ঐতিহাসিক বিয়েটি গভীর রাতে আমিই পড়াই। বিয়ের পর দিন থেকেই তাকে দীর্ঘ ছুটি ভোগ করার সুযোগ দিই।
একবার রমজান মাস দোরগোড়ায়। আমি সাহসের ভেলায় দাঁড়িয়ে ইকবাল ভাইয়ের সাথে একটি নয়া কনসেপ্ট শেয়ার করি। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে যার নজির মেলা সাদা কাকের ন্যায় বিরল। আমি প্রস্তাব করি--প্রতিদিন খতমে তারাবিহতে আল কোরআনের যে অংশটুকু তেলাওয়াত হয়, আমরা সে অংশটুকুর সরল বঙ্গানুবাদ এবং একই সাথে পঠিত অংশের চুম্বক মর্মার্থ প্রকাশ করবো। ইকবাল ভাই ও শাহাদাত ভাই এই দুঃসাহসিক অভিযানের অনুমতি প্রদান করেন। পুরো মাস অতিরিক্ত দুপৃষ্ঠায় নজিরবিহীন এ উদ্যোগ প্রকাশের আলোয় স্নাত হয়। পরে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের কপি জাতীয় জাদুঘরের আর্কাইভে জমা দেওয়া হয়। আজও ‘হেরার আলো’ শিরোনামে প্রতিদিন পবিত্র কোরআনের যে অংশবিশেষ প্রকাশ হয়, তার প্রবক্তা ও অনুবাদক হওয়ার সৌভাগ্য এ অধমই লাভ করে।
তখন আমরা চাঁদপুর কণ্ঠের সাংবাদিকতাকে দারুণভাবে এনজয় করতাম। এখন পুরানো অনেকেই সেই বন্দরে নেই। মনের অজান্তেই সুরের লহরিতে তরঙ্গ তুলি- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ নতুনদের জায়গা করে দিতেই বুঝি পুরানোরা স্ব স্ব প্লাটফর্ম খুঁজে নিয়েছে! নতুনের কেতন উড়িয়ে নবপ্রজন্ম নিয়ে নির্ভার চলছে চাঁদপুর কণ্ঠ।
আমি ‘পবিত্র’ সাংবাদিকতা পেশাটিকে দারুণ উপভোগ করতাম। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম এ পেশায়। একটি ‘ভব্যসভ্য’ পেশায় নিয়োজিত হতে পেরে তৃপ্তির ঢেঁকুরও গিলতাম। কিন্তু বিশ্বাসের ভেলাটা আমাকে নিয়ে বেশিদূর এগিয়ে গেলো না। আমি স্বচক্ষে অবলোকন করি এমন কিছু দৃশ্য, যা আমার আস্থার নরম দেয়ালে হ্যামারের প্রচণ্ড আঘাত হানে। তারপরও ‘তুমি অধম বলে আমি উত্তম হইবো না কেন’র মতো নিজেকে স্বমহিমায় থাকতে দিই। কিন্তু কচিমনের ধৈর্যধারণের যোগ্যতা যে সীমাবদ্ধ। মনে মনে ভাবলাম আর যাই হোক অন্তত দেখেও না দেখার ভান করার মতো জেগে ঘুমানোর অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। বলতে গেলে পাল তোলা নাও চালানোর আগেই ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে আমি আর বাইতে পারলাম না’ অবস্থা আমার।
আমি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার ভাইয়ের কাছে মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করি। তিনি আমাকে সিদ্ধান্ত ভেবে দেখার সময় দেন। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। অবশেষে ২০০৬ সালের ৩১ মার্চ শীতের সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে আমি বিদায় গ্রহণ করি প্রিয় চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে। চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে বিদায় নিয়েছি ঠিক, কিন্তু এখনও ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে মননে বয়ে চলেছি চাঁদপুর কণ্ঠের অস্তিত্ব। বয়ে চলবো আমৃত্যু।
লেখক : সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; সাবেক প্রধান সম্পাদক, দৈনিক ইল্শেপাড়; সাবেক সম্পাদক, আমার চাঁদপুর। তিনি ৮ এপ্রিল ২০২৪ সকাল ১০টায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান।