শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১০:২২

ঈদ হোক সকলের জন্য

মুহা. আবু বকর বিন ফারুক
ঈদ হোক সকলের জন্য

রক্তিম সূর্য উঠে এসেছে আকাশের কোণে। পাখিরা ডেকে উঠেছে নতুন দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে। এ শুধু একটি সকাল নয়, এ যেন আলোর জোয়ারে ভেসে আসা আত্মত্যাগ, প্রেম, সাম্য আর উদারতার প্রতীকÑঈদুল আযহার সকাল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো কেবল ঘটনার নয়, বরং প্রতীক হয়ে ওঠে মানুষের হৃদয়ে। ঈদুল আযহা তেমনই এক অনন্য প্রতীক। এটি কেবল একটি উৎসব নয়, বরং কুরবানির মাধ্যমে আত্মোৎসর্গের, আত্মশুদ্ধির, ও সামাজিক সমতার এক মহান আদর্শ।

কুরবানীর আদর্শ

ঈদুল আযহার ইতিহাসের শুরু সেই মহান মুহূর্তে, যখন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হন। পিতার হাতে বেঁধে চোখ বন্ধ করে সন্তান বলেছিলেন, “বাবা! আপনি যা আদেশ পেয়েছেন, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।” সেই মুহূর্ত ছিল কেবল ইতিহাস নয়Ñতা ছিল ঈমান, আত্মত্যাগ, বিশ্বাস ও প্রেমের সর্বোচ্চ পরীক্ষা।

আল্লাহ পাক সেই প্রেম ও আত্মোৎসর্গের পুরস্কারস্বরূপ ইসমাইল (আ.)-কে রক্ষা করে দিলেন, আর পাঠিয়ে দিলেন একটি দুম্বা। তখন থেকেই কুরবানি হয়ে উঠল আত্মত্যাগের চিরন্তন প্রতীক। এই দিন মানুষ শুধু পশু জবাই করে না, বরং জবাই করে নিজের ভেতরের হিংসা, অহংকার, লোভ, স্বার্থপরতা।

ঈদের সুর সবাইয়ের জন্য কিন্তু প্রশ্ন জাগেÑএই ঈদ কি সত্যিই সবার জন্য? আমাদের শহরের ধনী এলাকায় সকালবেলা নতুন কাপড় পরে, পারফিউম মেখে, চকচকে গাড়িতে চড়ে যে কিশোরটি ঈদগাহে যায়, তার পাশেই ফুটপাতে বসে থাকা শিশুটি কি জানে ঈদ কী? সে জানে শুধু অন্যদের মুখে হাসি দেখে, গায়ে নতুন জামা দেখে, আর মাঝে মাঝে কারো দয়া হলে একটুখানি মাংস পায়Ñতাও অনেক পরে।

ঈদ যদি হয় সাম্যের বার্তা, তবে কেন এত বৈষম্য? কেন কিছু মানুষের জন্য তা হয় আমোদ–প্রমোদের উৎসব, আর কারো জন্য হয় হাহাকারের স্মারক?

এই প্রশ্নই আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। ঈদ তো হওয়ার কথা ছিল শোষণহীন এক সমাজের প্রতীক, যেখানে সবাই মিলে ভাগ করে নেয় আনন্দ, যেখানে একে অপরের খোঁজ রাখে, ভালোবাসে।

কুরবানির মর্ম-ভোগ নয়, বণ্টন

আজ আমাদের সমাজে ঈদের রূপ অনেকটা বাহ্যিকতায় আটকে গেছে। পশুর সংখ্যা, দাম, ওজনÑএসবই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কুরআন স্পষ্ট বলছে : “আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের মাংস ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ Ñসূরা হজ্জ : ৩৭।

এই আয়াত যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়। আমাদের কুরবানি কি আল্লাহর উদ্দেশ্যে, নাকি লোক দেখানো প্রতিযোগিতা? আমরা কি কুরবানির মাধ্যমে সত্যিই আত্মত্যাগ করতে পারছি, না কি আরও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি?

এখানেই দরকার হৃদয়ের ঈমান। ঈদ যেন হয় দরিদ্রের জন্য খুশির বার্তা, পথশিশুর জন্য এক দিনের পূর্ণ পেট খাওয়া, বিধবা বা একাকী বৃদ্ধার মুখে একফোঁটা হাসি।

ঈদ হোক সকলের জন্য

ঈদকে সত্যিকার অর্থে ‘সকলের ঈদ’ বানাতে হলে আমাদের প্রয়োজনÑ

১. কুরবানির মাংস বন্টনে সুবিচার : কুরবানির মাংস বন্টনে সুবিচারÑআত্মীয় ও দরিদ্রের মাঝে প্রকৃত বণ্টন যেন হয়; লোকদেখানো না হয়ে বরং আন্তরিকতায় পূর্ণ হয়।

২. পথশিশু ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো : পথশিশু ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোÑঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে যদি একটি নতুন জামা, এক প্যাকেট খাবার, একটি হাসি দিতে পারি, তবে সেটিই হবে প্রকৃত কুরবানি।

৩. নিজের ভেতরের বদলে যাওয়া : নিজের ভেতরের বদলে যাওয়াÑঈদ হোক আত্মশুদ্ধির এক উপলক্ষ, যেখানে আমরা অহংকার, হিংসা, লোভকে কুরবানি দেই।

৪. সামাজিক বৈষম্য দূর করার প্রয়াস : সামাজিক বৈষম্য দূর করার প্রয়াসÑজাকাত, সদকা ও কুরবানির মাধ্যমে আমরা চাইলে এমন সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে ঈদ সত্যিই সবার হয়।

পরিশেষে বলবো, ঈদুল আযহা আমাদের শেখায়, ভালোবাসা শুধু অনুভবে নয়, কর্মেও প্রকাশ পেতে হয়। এটি এমন এক উৎসব, যেখানে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে মানুষ নিজের নিচু প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এবং যখন এই পরাজয় হয় হৃদয়ের গভীর থেকে, তখনই জন্ম নেয় একটি উদার সমাজ।

চলুন, আমরা এমন ঈদ গড়িÑযেখানে কেবল ধনীর আঙিনায় নয়, বরং দরিদ্রের ঘরেও হাসি ফোটে। যেখানে ঈদ শুধু সেজে বেড়ানোর উপলক্ষ নয়, বরং ভালোবাসা বিলানোর মুহূর্ত। এমন ঈদ, যা সত্যিই সকলের হয়।

ঈদ মোবারক

লেখক : সদস্য : সাহিত্য একাডেমি চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়