শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২১, ০০:০০

ভ্রুণ
অনলাইন ডেস্ক

পরপর বিশ থেকে পঁচিশটা কল করে সাড়া না পেয়ে নাবিলা কয়েকটা খুদেবার্তা পাঠায়।

‘প্লিজ রাকিব কল ধরো।’

‘প্লিজ রাকিব কল ধরো, জরুরি কথা আছে।’

রাকিব কলও ধরেনি, খুদেবার্তার জবাবও দেয়নি। গত মাসের ৯ তারিখে নাবিলার পিরিয়ড হয়, এর আগের মাসে ১১ তারিখে, তার আগের মাসে ১৪ তারিখে। এভাবে প্রতি মাসে দুদিন করে এগিয়ে আসে বিশেষ দিনটা। কখনও আবার তিনদিনও এগিয়ে আসে। কিন্তু আজ ১০ তারিখেও পিরিয়ড না হওয়ায় চিন্তায় পড়ে ও। আর সেজন্যেই কল করে যাচ্ছে রাকিবকে।

রাকিব রায়হান একসময় রঙিন পর্দার মানুষ ছিলো, এখন সে ব্যবসায়ী। মাঝে মাঝেই ব্যবসা লাটে উঠে, আবার সময় সময় জোয়ারে ভাসে। রাকিবকে দেখলেই বুঝা যায় কখন তার ব্যবসার কি অবস্থা। নাবিলার অফিসের একটা কাজে দুজনের পরিচয়। পরিচয়ের পর প্রেম-ভালোবাসা। দুই পরিবারের সবাই জানে ওদের সম্পর্কের কথা। রাকিবের পরিবারের একটা নিয়ম আছে। ছেলেদের অধিক বয়সে বিয়ে করানো। ওর বয়স ২৮ হলেও তার বড় দুই ভাই এখনো অবিবাহিত।

পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বড় দুজনের বিয়ে হলেই রাকিব বিয়ে করতে পারবে। একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে, অন্যজনের জন্যে দেখাশোনা চলছে। রাকিবের জন্মদিন ছিলো গত মাসের ২৪ তারিখে। কয়েকজন বন্ধু আর নাবিলাসহ জন্মদিন পালন করে। জন্মদিনের আনন্দ শেষে রাকিব নিজেই নাবিলাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্যে বের হয়, ঠিক তখনই মন এলোমেলো হয়ে যায়। পাশের এক আবাসিক হোটেলে চলে যায় দুজন। সারারাত সেখানে কাটিয়ে বাসায় আসে নাবিলা। এদিকে সারারাত নির্ঘুম কাটে ওর বিধবা মায়ের।

ছোটবেলায় ওদের দুই ভাই বোনকে আর ওর মাকে ছেড়ে বাবা নিরুদ্দেশ হয়। তখন ওদের বয়স মাত্র সাত আর পাঁচ। দুই সন্তান নিয়ে নাহার আক্তার গ্রামে চলে যান। সন্তানদের কথা ভেবেই আবার আসেন রাজশাহী শহরে। প্রায় পনর বছর পর ওরা বাবার সন্ধান পায়, কিন্তু কেউ কারো দায়িত্ব নিতে রাজি নয় বা পরিচয় দিতেও রাজি নয়। এভাবে পার হয়ে যায় বছর তিন। গত বছর নাবিলার বাবা মারা যায়। খবর শুনে ওর মা বিধবার পোষাক পরেন। নাকের ফুল খুলে ফেলেন। বলতেই হয়, হায়রে বাঙালি নারী, যে স্বামী সন্তান জন্ম দিয়েই নিরুদ্দেশ সেই স্বামী মরার পর নিজেকে বিধবা পরিচয় দিচ্ছো! নাবিলার ভাই বিয়ে করেছে, চাকরির কারণে বউকে নিয়ে অন্য শহরে থাকে। বিকেল বেলায় রাকিব অন্য নাম্বার দিয়ে কল দেয় নাবিলাকে।

-হ্যালো নাবিলা কেমন আছো?

নাবিলার মুখে কথা নেই, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ওপাশ থেকে রাকিব কিছুই বুঝতে পারছে না। বারবার জিজ্ঞেস করে-

-নাবিলা কি হয়েছে তোমার, তুমি এমন করছো কেনো?

জবাব না পেয়ে রাকিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নাবিলা কাঁদতেই থাকে প্রায় মিনিট তিন। আস্তে কান্না থেমে আসে।

-নাবিলা এবার বলো কি হয়েছে, খালাম্মার কোনো সমস্যা।

-না, আম্মা ভালো আছে। তুমি কই ছিলে, তোমার মোবাইল কোথায়? সকাল থেকে আমি কত কল দিয়েছি তুমি ধরোনি কেনো?

-আস্তে বলো। আমায় তো কিছু বলতে দিবে। সকাল ভোরে বের হয়েছিলাম ব্যবসার কাজে। ছিনতাইকারী আমার সব নিয়ে যায়। সেই থেকে আমি বাইরে, প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ হারাই, সেজন্যেই দৌড়াচ্ছি। মোবাইলের সিমগুলোও তোলা হয়নি। আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলো, এমন করে কি কেউ কাঁদে?

-রাকিব তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে প্লিজ কালকেই দেখা করো।

-তুমি বলো কি হয়েছে, কাল তো আমি সিমগুলো তুলতে যাবো। তুমি তো জানোই আমাদের কাস্টমার কেয়ারগুলোর যে অবস্থা। একটা সিম তুলতে দিনের অর্ধেক পার হয়ে যায়।

-রাকিব তোমার সিমের চেয়েও এই বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

-বলবে তো কি হয়েছে।

-রাকিব পিরিয়ডের তারিখ তিনদিন পার হয়ে গেছে, আমার পিরিয়ড হয়নি এখনো।

-পাগল তুমি, কি বলো এসব, হবে না কেনো? দেইখো আজ রাতেই হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি কি আমার নাম্বারে কোনো খুদেবার্তা দিয়েছো?

-দিয়েছি, আচ্ছা এখন যে নাম্বার দিয়ে কথা বলছো, এটা কার নাম্বার?

-এটা আম্মুর নাম্বার। তুমি আবার এই নাম্বারে কল দিও না।

-আচ্ছা তা না হয় দিবো না, কিন্তু আমি কি করবো।

-তুমি আরো দুদিন অপেক্ষা করো।

এভাবে কথা বলে দুজন বিদায় নিলো। একদিকে রাকিব ব্যস্ত নিজের ব্যবসার কাগজপত্রের খোঁজে, অন্যদিকে কঠিন দিন পার করছে নাবিলা। এমন এক বিষয়, কারো সাথেই শেয়ার করতে পারছে না। এক একটা ঘণ্টা যেনো এক একটা দিন পার হচ্ছে নাবিলার। কোথাও যাচ্ছে না, খাওয়া-দাওয়া করছে না। যে রাতে পিয়ালী বাইরে ছিলো সে থেকেই মা ওর সাথে অন্যরকম আচরণ করছে। দুদিন এভাবেই কাটিয়ে দেয়। অফিসেও যায়নি। দুদিন পর ঘণ্টাখানেকের জন্যে বের হয়। এলাকার বাইরে গিয়ে দোকার থেকে একটা স্টিক কিনে আনে। ১৩ তারিখ ভোরে টেস্ট করে। কিন্তু কোনো রেজাল্ট পায় না। রাকিবের সাথে কথা হয়েছে, তবে আগের মতো নয়। ওর একই কথা, ‘হয়ে যাবে হয়ে যাবে’।

১৩ তারিখে অফিস যায়, দুপুর বেলায় লাঞ্চ করতে গিয়ে হঠাৎ শরীর খারাপ হয়, কেমন জানি লাগছে। তবুও অফিসে থাকে। সন্ধার আগে আগে বাসায় আসে। রাকিবকে জানায়।

-নাবিলা তুমি দুদিন পর আবার টেস্ট করে দেখো।

দুদিন পরে নাবিলা ঘরে টেস্ট করে, রেজাল্ট পজিটিভ। রাকিবকে কল,

-ঘরের এমন রেজাল্ট ভুলও হতে পারে নাবিলা, তুমি হাসপাতালে পরীক্ষা করাও।

-রাকিব আমার কখনো ২/৪ দিন পিছিয়ে যায় না, বরং এগিয়ে আসে। তুমি বলছো আমি করাবো, তুমি আসবে?

-আমার আসাটা কি ঠিক হবে?

কথাটা নাবিলাকে কষ্ট দেয়। পরে ভেবে দেখে এই সময়ে ওর না আসাই ভালো। আশপাশের হাসপাতালে গেলে সমস্যা আছে। দূরে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।

হাসপাতালে পরীক্ষা করতে দিয়ে আসে নাবিলা। আজ রিপোর্ট দিবে, রাকিবকে আসতে বলেছে নাবিলা। ঠিক সময়ে রাকিব চলে আসে। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ওরা বসবে বলে ঠিক করা আছে। নাবিলা রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। দুজন মুখোমুখি বসা। রাকিব তাকিয়ে আছে নাবিলার মুখের দিকে, আর নাবিলা তাকিয়ে আছে নিজের হাতে থাকা হাসপাতালের খামের দিকে।

এটা এখন শুধু একটা খাম নয়, একটা ভ্রুণের আগমনের খবর। পৃথিবীর এক অনাগত নবজাতকের খবর। রাকিব কি কথা দিয়ে শুরু করবে আজ ভেবে পাচ্ছে না। নাবিলার চোখ থেকে টপ করে একফোঁটা পানি পড়ে খামের মাঝে। রাকিব দেখতে পেয়ে বলে উঠে-

-নাবিলা রেজাল্ট কি?

-পজিটিভ।

-কি করবে ভেবেছো?

-আমি একা কি ভাববো, আমি জানতাম এমনি কিছু হবে। সেজন্যেই তোমায় ডাকা। রাকিব আমি ঘরে থাকতে পাচ্ছি না, অফিস যেতে পারছি না। মায়ের মুখোমুখি হতে পারছি না। সেদিনের পর থেকে মা আমার সাথে ঠিকমতো কথাও বলছে না। তুমি বলো আমি এখন কি করবো।

-নাবিলা তুমি তো জানো এই মুহূর্তে বিয়ের কথা বাসায় বলা যাবে না। আর এমন খবর জানলে আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে। কোথায় গেলে এই কাজ করা যাবে খোঁজ নাও। প্রয়োজনে আমিও যাবো তোমার সাথে। যেভাবে হোক বেশিদিন পার হবার আগেই...

নাবিলা খামটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাকিব একবারও ভাবেনি নাবিলা এখন চলে যাবে। নাবিলা কিছুই বলছে না। সোজা বেরিয়ে আসে। রাকিব পেছন পেছন আসে, কিন্তু নাবিলা একবারও পেছনে তাকায়নি।

ভাবছে রাকিবের মাকে কল করে সব বলে দিবে, আগত সন্তানকে সমাজে পরিচয় দিবে। কিন্তু রাকিব যে এমন করছে। দুদিনে নাবিলা একবারও কল করেনি রাকিবকে। রাকিব অনেকবার কল করেছে, কল ধরেনি ও। অফিসের নাম্বারে কল করছে, অফিস থেকে জানিয়েছে নাবিলা অফিসে যায়নি। মা ওকে অনেক ধরনের প্রশ্ন করে, কোনো জবাব নেই ওর মুখে। ২০ তারিখে নাবিলা একটা হাসপাতালে যাবে, আগে হাসপাতালের নার্সের সাথে কথা হয়েছে। একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নার্স বলে দিয়েছে সব। রাতে নাবিলা কল করে রাকিবকে-

-কাল বেলা ১১টায় তুমি ওভারব্রিজের পাশে এসো, আমি তোমায় নিয়ে হাসপাতালে যাবো।

-কালকেই যেতে হবে নাবিলা, তোমায় কত কল করেছি, তুমি ধরোনি। আমি ব্যবসার জন্যে শহরের বাইরে। প্লিজ তুমি কালকে একাই যাও, আমি পরশু চলে আসছি, তখন যা করার আমি করবো।

নাবিলা কথা বাড়ায় না, কল কেটে দেয়। অফিসে যাবার সময়েই বাসা থেকে বের হয়, মাসের ৩ তারিখে বেতন পেয়েছিলো। বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে সব বকেয়া পরিশোধ করেছে। হাতে যে টাকা তা দিয়ে যাতায়াত খরচ আর টুকটাক সারতে হবে বেতন পাওয়া পর্যন্ত। এতো কিছু হিসাব করলে এখন হবে না। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই নার্সের সাথে আবার কথা হয়। ডাক্তার দেখানো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আজ আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেলো। ডাক্তার তারিখ দিয়েছে ২২ তারিখে এসে কাজ সারতে হবে। সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকা লাগবে। ২২ তারিখে করতে হলে আজই ওকে একটা ইনজেকশন দিতে হবে। সব মিলিয়ে সেদিন ঘণ্টা চার ওকে হাসপাতাল থাকতে হবে। নাবিলা ইনজেকশনটা দিয়ে সোজা পার্কে যায়। পাকা একটা বেঞ্চিতে বসে থাকে বিকেল পর্যন্ত। অফিস ছুটির সময় বাসায় ফেরে। আজ ওকে অন্যরকম লাগছে। চেহারায় কোনো উচ্ছ্বাস নেই, মলিন এক অন্য নাবিলা। ঘরে ঢুকতেই মা ওকে আগলে ধরে।

-তোর কি হয়েছে, আমায় বল।

কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে যায় নাবিলা। রাতে খাওয়ার সময় রুম থেকে বের হয়। টেবিলে খাবার রাখা, মা বারান্দায় গিয়ে বসে আছে। নাবিলা মায়ের কাছে যায়।

-মা মরিচ-পেঁয়াজ বেশি করে দিয়ে আমায় একটা ডিম ভেজে দিবে। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

মা ডিম ভেজে দেয়, নাবিলা আজ অনেকগুলো ভাত খেয়ে মায়ের পাশে ঘুমাতে যায়। মাঝে মাঝেই ওরা একসাথে ঘুমায়। নাবিলার একটা হাত মায়ের পেটের উপর দেয়া, অন্য হাত নিজের পেটে দেয়া। সারারাত কল্পনা করে কাটিয়ে দেয় ও।

সকালে অফিস যাবার আগে রাকিবকে কল দিয়ে সব জানায়। রাকিব সব শুনে চিন্তা করতে নিষেধ করে। টাকার কথা জানালেই রাকিব বলে,

-আপাতত তুমি কারো কাছ থেকে হাওলাত নাও, আমি পরে দিয়ে দিবো।

-আমি কোথায় পাবো টাকা, তুমি টাকাটাও দিতে পারবে না। রাকিব সব কি আমার দায়?

বলেই লাইন কেটে দেয়। মিনিট ১০ পরে ওর মোবাইলে খুদেবার্তা আসে, ‘আমি কাল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকবো। পুরোটা সময় তোমার পাশেই থাকবো।’

ঘর থেকে বের হবার আগে মায়ের কাছে যায় নাবিলা। নিজেই জানে মায়ের কাছে কোনো টাকা থাকে না। নাবিলার ছোটবেলার দুটি আংটি আর দুই জোড়া কানের দুল আছে মায়ের কাছে। শত অভাবে এই জিনিসটুকু আগলে রেখেছেন মা।

-মা আমায় একজোড়া কানের দুল দিবে। সময় হলে আমি আবার তোমায় দিয়ে দিবো।

মা কোনো কথা না বলে রুমে যায়, এক জোড়া দুল এনে মেয়েকে দেয়।

-এগুলো তোর, তোর জিনিস তোকে দিতে আমার কোনো আফসোস বা সংকোচ নেই। ভালো কাজে লাগাস, এটুকুই বলবো।

নাবিলার খুব ইচ্ছে করছিলো মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, ‘মা এর চেয়ে ভালো বা খারাপ কাজ পৃথিবীতে আছে কি না আমার জানা নেই।’

পাথরের মূর্তির মতো নাবিলা জিনিসটা নিয়ে বের হয়। অফিসে কল করে জানিয়ে দেয় আসতে একটু দেরি হবে। আগে যায় জিনিস বিক্রি করতে। বিক্রি করে সাড়ে এগারো হাজার টাকা পায়। এরপর অফিস যায়। বিকেলে অফিস থেকে সোজা বাসায় আসে। আজও ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খায়। আজ নাবিলা একা ঘুমায়। মাঝরাতে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে, স্বপ্নে দেখে ওরা মা মেয়ে হাত ধরে সাগরের পাড়ে হাঁটছে। বড় বড় ঢেউ আসে, ও মায়ের হাত শক্ত করে ধরে। জেগে গিয়ে নাবিলা ভাবনায় বসে, তার মানে ওর গর্ভের অনাগত সন্তান এক কন্যাশিশু। সাথে সাথে রাকিবকে খুদেবার্তা পাঠায়, ‘তুমি কি এই শহরে এসেছো। কাল দশটায় ওভারব্রিজের পাশে দাঁড়াবে, আমি তোমায় তুলে নিয়ে যাবো।’

মিনিটখানেকের মাথায় ফিরতি বার্তা আসে, ‘আমি এসেছি ঠিক সময়ে আমি থাকবো।’

নাবিলার খুব ইচ্ছে করছে রাকিবের পাশে যেতে, ওর কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে। মুহূর্তে ইচ্ছেটা মরে যায়, বুঝতে পারে না কি থেকে কি হতে যাচ্ছে। এই সময়ে নিজেকে শান্ত রাখতে হবে এটা বুঝতে পারছে।

সকাল সকাল উঠে রেডি হয়, মা নিজেই ডিম ভাজি করে নাবিলাকে গরম গরম ভাত দেয়। খেয়েদেয়ে বের হবার সময় মা বলেন,

-আজ এতো তাড়াতাড়ি বের হচ্ছিস্? আচ্ছা যা, ভালোভাবে ফিরে আসিস। আমি জানি তুই খারাপ কিছু করতে পারিস্ না। আমি আছি তোর সাথে সুখে-দুঃখে।

কিছু না বলে বের হয়ে যায় নাবিলা। ভাবে, কোন্টা ভালো আর কোন্টা মন্দ কাজ। মনে মনে বলে, ‘মা এই মুহূর্তে দোয়া ছাড়া আর কিছুই চাই না। ভালোবেসে এক মুহূর্তের আবেগকে আয়ত্বে রাখতে না পেরে আমি যে খারাপ কাজটি করেছি। তাকে মাটিচাপা দিতে পরিবার-সমাজ আর এই পৃথিবীর মাঝে নিজেকে ভালো মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে আর রাখতেই আজ আমি অজানার পথে পা বাড়াচ্ছি মা। যে সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় নেই সমাজে, যে সন্তানকে সমাজ অবৈধ বলে মা, সে সন্তানকে আমি রাখবো কি করে বলতে পারো মা। যাকে ভালোবেসে সব দিয়েছি সেও আজ অনেক দূরে, বুঝতে পারছি না এটা কি ওর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া নাকি সে পরিস্থিতির স্বীকার।’

ঠিক সময়ে রাকিব আসে। দুজন একসাথে যায় হাসপাতালে। যে পথটুকু একসাথে ছিলো, কেউ কারো সাথে কিছুই বলেনি। হাসপাতালে গিয়ে নার্সের সাথে রাকিবকে পরিচয় করিয়ে দেয়। রাকিব ওর স্বামী নাকি অন্যকিছু হয় তা বলেনি। কাজ খুব দ্রুত হচ্ছে। নার্স বলেছে দুই ঘণ্টা নাবিলাকে ভেতরে থাকতে হবে, রাকিব বাইরে অপেক্ষা করবে ততোক্ষণ। অতীত আর ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় নেই নাবিলার। নার্সের সাথে ভেতরে চলে যায়।

চোখ খুলে দেখতে পায় একটা এসি রুমে শুয়ে আছে নাবিলা। মনে পড়ে স্কুলজীবনের কথা, তখন ও গ্রামে থাকতো। উপরের ক্লাসের বিথীর পেট বড় দেখে অনেকে অনেক কথা বলেছে। এক পর্যায়ে দশ মাসের সন্তান প্রসব করার জন্যে বিথীর মা দূরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যায় বিথীকে। জীবিত হয়ে জন্ম নেয়া শিশুকে ওরা গলা টিপে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছে। ঘটনা দূরে হলেও পরে সবাই জেনে যায়।

মনে পড়ে পাশের বাড়ির ইয়াসমিনের কথা। দাম্পত্যজীবনে কলহ বলে ইয়াসমিন থাকতো নানার বাড়িতে। একরাতে ওর স্বামী বাবর এসে ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মিলিত হয়। হবার সময় প্রতিরোধক হিসেবে কনডম ব্যবহার করে। সেই মিলনে ইয়াসমিনের গর্ভে সন্তান আসে। গর্ভের সন্তান যখন আট মাস তখন সব জানাজানি হয়। বাবর সেদিনের ঘটনা অস্বীকার করে। সমাজ ইয়াসমিনকে চরিত্রহীন বলে, সে আঘাত সইতে না পেরে ইয়াসমিন আত্মহত্যা করে। ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর বাবর স্বীকার করে সে সন্তান তার নিজের ছিলো। সে রাতে বাবর ইয়াসমিনের সাথে মিলিত হয়েছে। ইয়াসমিন জানে ওরা কনডম ব্যবহার করেছে, আসলে বাবর কনডম ব্যবহার করলেও তা নিজে ফুটো করে নেয়।

একটা ঠাণ্ডা রুমে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে না রাকিবের মুখটা। নার্স আসে কিছু কথা বলে ওদের বিদায় দেয়। বের হয়েও রাকিবের সাথে কোনো কথা নেই নাবিলার। বাসায় আসে দুপুরের পর। দিনের বাকি সময় রুমেই থাকে নাবিলা। নিজের বর্তমানের হিসাব মিলায়, বিথীর মতো অবস্থায় তাকে পড়তে হয়নি। ইয়াসমিনের মতো অকালে নিজেকে শেষ করতে হয়নি। সমাজ কখনোই জানবে না আজ নাবিলা একটা ভ্রুণকে হত্যা করে এসেছে। এই পৃথিবীর আলো দেখার আগে, বাতাস অনুভব করার আগেই তাকে হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে। কোনো কুকুর নিশ্চই বুঝবে না এটা এক মানবসন্তানের ভ্রুণ ছিলো। কেউই জনতে পারবে না আজ এক কুমারী মা হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়