প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২১, ০০:০০
আসরের পর রুবির বাবা রফিক মিয়া বাজারে গিয়েছেন। এশারের আযান দিয়েছে, এখনো বাড়ি ফিরেননি। ছেলে-মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছে রোকেয়া। দরজার কড়া নড়তেই খুলে দেখলো, রুবির বাবা এসেছে। স্বামীকে ভাত বেড়ে দিয়ে রোকেয়া বললো, কাল তো কোরবানির ঈদ। প্রতিবছর ঈদে বাবা কিছুটা গোশত পাঠায়। এবার বাবা বলেছে, কোরবানি দিতে পারবে না। ভাইদের রোজগার একেবারে কমে গেছে। কাল ছেলে-মেয়ে গোশত খেতে চাইলে কি বলবো? তুমি না হয় চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে গোশত কাটায় সাহায্য করো, যদি ওরা কিছুটা দেয়। ভাতের লোকমা রেখে রফিক বললো, ষোল বছর পর তুমি এই কথাটা বলতে পারলে রোকেয়া?
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া করতে পারি না। তাই চাকরিও করতে পারি না। একসময় লেখাপড়া করে চাকরি করার অনেক শখ ছিলো আমার। সেসব কিছু হয় না বলেই আজ আমার এই অবস্থা। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিতে চাষ করে কোনো রকম দিন চলে যায়। কখনো কারো কাছে হাত পাতি না। তোমাকে বিয়ের পর থেকে ভালো কিছু দিতেও পারি না। আমি চাই রুবি লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করে ওর জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে। তাই তো কষ্ট হলেও ওর লেখাপড়ার দরকারি সবকিছু আমি আগে এনে দিই। ছেলেটা বড় হলেও তাই করবো। আমার জীবনের কষ্টগুলো আমি ওদের পেতে দিবো না। মেয়েটা এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। এই সময়ে যদি আমি অন্যের বাড়িতে গোশত কাটতে যাই, তাহলে আমার মেয়েটা তার স্কুলের বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে যাবে। তোর বাবা অন্যের বাড়িতে গোশত কাটতে গিয়েছিলো শুনলে, মেয়েটা কষ্ট পাবে। তাই আমি এই কাজটা করতে পারবো না রোকেয়া।
তুমি রুবিকে বুঝিয়ে বললে ও সব বুঝবে বলে রফিক মিয়া বাজার থেকে আনা ব্যাগটা বালিশের নিচে রেখে শুয়ে পড়লো।
হুট করে স্বামীকে কথাটা বলে অনুতপ্ত হয়ে স্বামীর কাছে ক্ষমা চেয়ে রোকেয়াও শুয়ে পড়লো।
আজ ঈদ। মসজিদের মাইকে নামাজের সময়ের ঘোষণা দেয়া হলো। নানার বাড়ি থেকে দেয়া গত বছরের ঈদের তুলে রাখা জামা বের করে ছোট ভাই ও নিজে পড়ে নিলো রুবি। রফিক মিয়া ছেলেকে নিয়ে ঈদগাহে নামাজ পড়তে গেলেন।
বাবা ঈদগাহে যাওয়ার পর প্রতি বছর এই সময়ে তুমি মশলা বেটে রাখো, আজ বাটবে না মা? মেয়েকে কি উত্তর দিবে ভেবে না পেয়ে, আজ বাটতে ভালো লাগছে না বলে রোকেয়া অন্য কাজে চলে গেলো। হয়তো, মায়ের শরীর খারাপ ভেবে রুবি নিজেই একটু আদা, কয়েকটা রসুন কেটে, ধুয়ে, পাটায় বেটে রসুইঘরে রেখে দিলো। মা, আমি মসলা বেটে রেখেছি, নানা গোশত নিয়ে এলে তুমি আলু দিয়ে ঝোল ঝোল করে রাঁধবে। আমরা সবাই মজা করে খাব।
ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে রুবির ভাই তার নানা আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। জোহরের পর রুবি আর তার ভাই মায়ের কাছে জানতে চাইলো, নানা আসে না কেন?
রুবিকে ডেকে নিয়ে নানার বাড়িতে কোরবানি না দেয়ার সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললো রোকেয়া। মায়ের কথা শুনে মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলো রুবি। রুবির ভাই বাড়ির সামনে বসে নানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। আসরের পর রুবি, ভাইকে ডাকতে বাড়ির সামনে গেলো।
সত্তর বছর বয়সী বিধবা, নিঃসন্তান সখিনা বেগম এক হাতে ছোট্ট একটা পুঁটলি, আর অন্য হাতে লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে রুবিদের বাড়ির সামনে আসলো। হাঁপিয়ে বললো , কইরে রুবি, পুঁটলিটা ধর, আর পারছি না তো হাঁটতে। আরে দাদি, তুমি এই সময়ে কোথা থেকে এলে?
রুবির কথা শুনে ওর বাবা, মা বাহিরে আসলো। আরে চাচী, তুমি এই সময়ে এলে যে, প্রতি বছর এই সময়ে তো তুমি রাস্তার মোড়ে গোশত নিয়ে বস। রোকেয়ার কথা শুনে সখিনা বেগম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, হ...রে মা, তাই তো করি প্রত্যেক বছর। আজ-কাল গায়ে জোর লাগে না। সারা গ্রাম হাঁটতে পারি না। ঐ চৌধুরী বাড়ি থেকে মজুমদার বাড়ি নাগাদ সাত বাড়ি হেঁটে সেরখানেক গোশত পাইছি। প্রত্যেক বছর কোরবানির কয়েক সের গোশত বেচে তা দিয়েই কয়েক দিনের সংসার খরচ চালাতাম। এবার তা হলো না। এখন আর বাঁচার জন্য ভাবি না। সখিনা বেগম পুঁটলিটা রুবিকে দিয়ে বললো, নে এবার গোশত কেটে , ধুয়ে মসলা মেখে চুলায় বসিয়ে দে। তারপর বললো, ঘরে তেল, মসলা নাই। তাই তোদের কাছে নিয়ে এলাম। রুবির মায়ের হাতের রান্না বড়ই স্বাদের। সময়ে অসময়ে তোর হাতের তরকারি কত খাইছি। আজ গোশত রেঁধে তোরা ও খাবি, আমারেও একটু দিবি।
ঠিক আছে চাচী, আগে তুমি বাড়িতে আস, তারপর সব কথা হবে বলে সখিনা বেগমকে ভিতরে নিয়ে বসালো রোকেয়া। বারান্দায় বসে ছেড়া শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছলো সখিনা বেগম। তা দেখেই রুবির বাবা গতকাল রাতে হাট থেকে নিয়ে আসা ব্যাগ থেকে একটা সুঁতি শাড়ি বের করে সখিনা বেগমের হাতে দিয়ে বললো, চাচী, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে সবসময় তুমিই আমাকে বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছিলে, কষ্টের সময় আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়েছিলে। অথচ, আমি নিজের অভাবের কারণে কখনো তোমাকে কিছু দিতে পারিনি। অনেক দিন ধরে সংসার খরচ থেকে একটু একটু করে পয়সা বাঁচিয়ে খুব সখ করে কাল তোমার জন্য এই শাড়িটা কিনেছি। তুমি পরলে আমার খুব ভালো লাগবে।
সখিনা বেগম শাড়িটা হাতে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে বললো, কত শখ ছিল, নিজের ছেলে একদিন আমায় শাড়ি কিনে দিয়ে এই কথাটাই বলবে। সে আর আমার কপালে হলো কই। তুই আজ আমার সেই আশাটাই পূরণ করলি, বাপ। বড় খুশি হইছি আমি বলে খুশিতে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। সাথে সাথে রোকেয়া আর রফিকের চোখে ও পানি চলে এলো। রুবি গোসতের পুঁটলি নিয়ে রসুইঘরে গেল। রুবির ছোট ভাই ও খুশিতে নাচতে নাচতে বোনের পিছু পিছু গেলো।