প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এই জনমে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ষোলো.
অবোধ সেন স্বাধীনতার সময় দালালি করে নারীদেরকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর কাছে তুলে দিতো। তার বিনিময়ে সে অনেক টাকা পেতো। তাছাড়া সে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিরও সন্ধান দিতো। তাই পাকবাহিনী তাকে ঘরবাড়ি থেকে লুটপাটের সুযোগ করে দিতো। এসব অর্থ নিয়ে স্বাধীনতার পর সে কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের আড়ত দিয়েছিলো। গত ত্রিশ বছরে সিন্ডিকেট করে সে দু-তিনটি বাড়ির মালিক হয়েছে। ব্যাংকে অঢেল সম্পদ হয়েছে। গভীর রাত। স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাসায় ঘুমাচ্ছিল অবোধ সেন। ধীরে ধীরে বাড়ির পাশের সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো রূপাালি। তার পরনে কালো বোরখা। শুধু চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে একটি কালো হাত অবোধ সেনের দিকেই বেয়ে বেয়ে আসছে। সেই হাতে একটা বিষাক্ত ছোরা। কাছে আসতে আসতে হঠাৎ করেই কোনো কিছু পড়ার আওয়াজে জেগে উঠলো অবোধ সেন। তারপর আলো-আঁধার কালো বোরখাওয়ালীর হাতে বিষাক্ত ছোরা দেখে চিৎকার করে উঠলো সে। এ সময় অবোধ সেনের স্ত্রী অনামিকা ও তার একমাত্র সন্তান রুহান জেগে উঠলো। কালো বোরখার আড়ালে কালো ছোরাটি দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো অবোধ সেন। ঠিক সেই সময়টাতে ছ্যাঁৎ করে ছোরাটি বিঁধে গেলো অবোধ সেনের বুকে। ব্যথার তীব্রতায় চিৎকার করে উঠলো অবোধ সেন। কিন্তু বোরখাওয়ালী রূপালি তার মুখ চেপে ধরলো। তারপর কানে কানে বললো, ‘তুই-ই আমাকে পাক-বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলি। আমার মতো শয়ে শয়ে নারীকে তুই-ই তাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলি। তারপর অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলি। এখন সময় হয়েছে মৃত্যুর। তুই এবার মর।’ অনামিকা দেখলো ছোরাটি অবোধ সেনের বুকে আরো তীব্রবেগে ঢুকিয়ে কয়েকটা মোচড় দিলো কালো বোরখাওয়ালী। অবোধ সেনের ফিনকি দিয়ে সমস্ত রক্ত বেরিয়ে আসছে ... পুরো খাট বন্যার জলের মতো ভেসে যাচ্ছে রক্তে ...। রূপালি হাওয়ার মতোই এসেছিল, ঠিক হাওয়ার মতোই বের হয়ে চলে গেলো।কিছু বোঝার আগেই অবোধ সেন ধপাস করে পড়ে গেলো বিছানায়। হতভম্ভের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অনামিকা। তারপরই তারস্বরে চিৎকার শুরু করলো সে।
ইমতিয়াজ ঘুমিয়েই ছিলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে তাদের সন্তান অপূর্ব ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্তু তার পাশে রূপালিকে না দেখে সে উঠে বসে। তারপর উঠে এক গ্লাস পানি পান করে। লক্ষ্য করে দরজাটা খোলা। সেই খোলা দরজা পেরিয়ে বেলকনিতে এসে বসে। একটা সিগারেট ধরায়। তার মনে মনে গুণগুনিয়ে গান গাইতে থাকে। এমন সময় লক্ষ্য করে নিচে গেটের কাছে এক কালো বোরখাওয়ালীর আগমন হয়েছে। সে ধীরে ধীরে গেটের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে। ইমতিয়াজ এসব দেখছে আর সিগারেট টানছে।কিছুক্ষণ পরই রূপালি বাসায় প্রবেশ করে খাটের উপর ইমতিয়াজকে না পেয়ে, ডাক দেয়-- ‘ইমতিয়াজ তুমি কোথায়?’ ইমতিয়াজ কোনো শব্দ করে না। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে রূপালি বুঝতে পারে ইমতিয়াজ কোথায়। সে বেলকনিতে চলে আসে। উদাস স্বরে ইমতিয়াজ প্রশ্ন করে, ‘কোথায় গিয়েছিলে রূপালি এই রাতে?’ কোনো রাখঢাকা নেই, সহজ উত্তর দেয় রূপালি--‘সেই নর্দমার কীটটাকে শেষ করে দিয়ে এলাম।’‘ কে অবোধ সেন?’‘হ্যাঁ। বড়ই নিষ্ঠুরভাবে মেরেছি তাকে। আমাকে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অপমান অপদস্থ আর তাদের ভোগের সামগ্রী বানিয়েছে, সবক’টাকে যদি এভাবে তিলে তিলে মারতে পারতাম!’‘ গুড। যাই হোক, তোমার অন্তত একটা শত্রু শেষ হলো। অভিনন্দন। এই লোকটা পুরো কারওয়ান বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো। তারপর সারাদেশে কাঁচামালের দাম আকাশছোঁয়া বাড়াতো। সাধারণ মানুষ দুই টাকার সবজি ৫০ টাকায়ও পেতো না। তাহলে অবোধ সেনের খেল খতম।’ ইমতিয়াজ যেনো খুশি হলো।‘হ্যাঁ, তবে এটাই শেষ নয়, এমন অবোধ সেন আরও অনেক আছে, একটার পর একটা হয়তো আসতে থাকবে, দেশের মানুষকে ধোঁকায় ফেলবে, প্রতারিত করবে, সম্পদ লুটবে, ব্যাংক থেকে পিকে হালদারের মতো লুটেরার জন্ম হবে। তারপরও শান্তি লাগছে অন্তত একটাকে তো খতম করতে পেরেছি।’ রূপালি নির্বিঘ্নে উত্তর দেয়। ইমতিয়াজ যোগ করলো, ‘তারপর মিলন সমাদ্দারের মতো মানবদরদীর জন্ম হবে। যারা মানবতার দোহাই দিয়ে লোক দেখানো কাজ করে, লোক ঠকানো শুরু করবে। ধান্দাবাজি করে ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা রেখে মানুষের হাত-পা কেটে রক্ত ঝরিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠবে। আবার এদের পক্ষেও একদল দালাল তাদের গুণকীর্তন করবে।’‘ তবুও আমাদেরকে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা যদি ভয় করি, তাহলে আমাদের প্রজন্ম ভীতুই থেকে যাবে। কাউকে না কাউকে সঠিক পথটা দেখিয়ে দিতে হবে। এক সাগর রক্ত ঢেলে যারা বাংলাকে হায়েনাদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে, তাদের বুকের জমিন পেরিয়ে আজ যারা দেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করছে, তাদেরকে দুনিয়াতেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাণ্ডনা হলে সমাজ অন্ধকার হয়ে যাবে, মানুষ সঠিক পথের দিশা পাবে না।’
রূপালি যেনো আকাশের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বললো। ইমতিয়াজ কোনো কথা বলছে না, সে রূপালির কথাগুলো শুনছে।রূপালি আবারও বলে উঠলো, ‘আমার জীবনটাই পাপে ভরা। আমাকে যারা ক্যাম্পে ছুঁয়েছে, আমাকে নিয়ে খেলেছে, আমার গর্ভে তাদের সন্তান দিয়ে গেছে, সেই সন্তানই হয়তো তাদের জন্যে কালসাপ হবে। এই সন্তানকে আমার সবই বলে যাবো।’ রূপালির মুখে হাত দিয়ে কথা থামিয়ে দিলো ইমতিয়াজ। তারপর বললো, ‘এই জনমে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি রূপালি। তারা তোমার দেহটি স্পর্শ করেছে। কিন্তু নিশ্চয়ই তোমার মনটা, ভালোবাসাটা আমার জন্যেই। আর তোমার গর্ভে যে সন্তান হয়েছে, সেটা আমাদেরই। অপূর্ব আমার সন্তান। আমিই তার বাবা। আজ এতকাল পরে কেনো তোমার মনে হলো, অপূর্ব আমাদের সন্তান নয়? অপূর্ব বাংলাদেশের সন্তান। সে বাংলার সন্তান। তোমাদের ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়েই বাঙালি স্বাধীনতা পেয়েছে, তোমাদের অপমানের মধ্য দিয়েই বাঙালি চির সম্মান পেয়েছে। তাই তো তোমার অপমান অপদস্থ ও ভোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে তোমাকে আমি চিরসঙ্গী করে নিয়েছি। তুমি তো আর ইচ্ছে করেই এসব করোনি, তাহলে নিজকে দোষ দিচ্ছো কেন? জনম জনম ধরে বাঙালি তোমাদের মতো বীরাঙ্গনাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। জনম জনম ধরে আমাদের সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঙালির মাথার উপরের ছাতা হয়ে এই দেশের সকল অভাবীর পাশে দাঁড়াবে নিশ্চয়ই।’
রূপালির মুখে হাসি ফুটলো। তারপর বললো, ‘তোমার জন্যে আমি আর মরতে পারলাম না। তবে সেই কীটটাকে মেরে আসলাম। ঠিক যেভাবে মেরেছিলাম রওনক হাসান নামের আর্মি অফিসারকে। অবোধ সেনও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে বাঙালির সাথে বেঈমানি করেছিলো, সেই বেঈমানটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলাম।’ আজ চাঁদের পরিপূর্ণ জোছনা নেমেছে। তুষার ঈশানবালার হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে ডাকাতিয়ার কিনারে। সাথে তাদের দুই সন্তান। অরণ্য ও তানজীম। তারা ডাকাতিয়ার কিনারায় চাঁদের আলোতে খেলাধুলা শুরু করেছে। বাতাসের শো শো আওয়াজে তুষারের মনে হচ্ছে কেউ যেনো শিষ দিয়ে গান গাইছে। বেশ ভালো লাগা একটা মুহূর্ত। এমন সময় কথা বলে উঠলো, ঈশানবালা। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে তুষারকে বললো, ‘আসলে মানুষ যা পায় তা সে চায় না, আর যা পায় তার গুরুত্ব দেয় না।’
হঠাৎ করে ইশানবালার এই কথায় চমকে উঠলো তুষার। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঈশানবালার দিকে। তারপর প্রশ্ন করলো, ‘এই কথা হঠাৎ করে?’ জানি না, কেনো বলেছি।’ উদাসভাবে উত্তর দেয় ঈশানবালা।‘ নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?’ তুষার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়।‘জানতে চাও?' তাহলে বলি, আমার জীবনের কালো অধ্যায়টা মাঝে মাঝে মস্তিষ্কের মাঝে হানা দেয়। আমি তখন দেখি আওরঙ্গজেব নামক একটা জানোয়ারকে। তার কাছ থেকে যে লাঞ্ছনা সয়েছি তা আমি চাইনি। অথচ তোমার মতো একজন হৃদয়বান মানুষ আমি কল্পনায়ও চাইনি, কিন্তু পেয়েছি। তবুও তোমার গুরুত্ব আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি।’ উত্তর দিলো ঈশানবালা। এসব কথা থাক। সংসার জীবন এমনই। সংসারে স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে এক অপরের আয়না, হয়তো মানুষ মাঝে মাঝে কেউ কারো গুরুত্ব বুঝে না। তবে একটা সময় সে উপলব্ধি করতে পারে। একে অন্যকে যখন গভীর যাতনায় প্রয়োজনে পাশে পায়, সুখে-দুঃখে একে অপরের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তখনই মানুষ হয়ে উঠে একে অপরের বন্ধু, কাছের মানুষ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও এমনই। এটা বুঝতে হলে সময় লাগে। তবে তোমাকে পেয়ে আমি অনেক সুখী। তোমার জীবনের কালো অধ্যায়টা এখনো আমি মুছে দিতে পারিনি বলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।’এ কথা বলে তুষার ঈশানবালা হাতে ধরলো। ঈশানবালা হঠাৎ করে সরে গিয়ে বললো, ‘এটা কী করছো তুষার! তুমি কেনো ক্ষমা চাইবে, তোমার তো কোনো দোষ নেই, আমার মস্তিষ্কের নিউরনে কী চলছে সেটা তো তুমি টের পাওয়ার কথা নয়।’‘এখানেই আমার দুঃখিত হওয়ার বিষয়। কারণ প্রিয় স্বামী হতে হলে স্ত্রীর মস্তিষ্কের নিউরনে কী চলছে তা টের পেতে হবে, স্ত্রীর মনের কথা বুঝতে হবে, তার সব কথার গুরুত্ব দিতে হবে। আমি সেটা পারিনি বলেই তো তোমার জীবনের কালো অধ্যায়টা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছ। এখানেই আমি স্বামী হিসেবে পরাজিত।’‘বাহ, বাহ, দারুণ জমছে তো?’হঠাৎ করে তিন-চারটি কণ্ঠস্বর আলো আঁধারির মাঝে কথাগুলো বলে উঠলো। চমকে উঠে ঈষানবালা ও তুষার পেছনে তাকালো। তারপর যা দেখলো তাতে বেশ অবাকই হয়ে গেলো। তারা যা কোনো কল্পনাই করেনি, সেটাই ঘটে গেলো নিমিষেই। (চলবে)