প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ০১:১০
ভাবান্তর

এ মহাবিশ্ব প্রপঞ্চে মানব সভ্যতার অস্ফুট ঊষাকালেও মানুষ প্রতিমুহূর্তেই কোনো না কোনো বিষয়-ভোগে পরিপূর্ণ নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই হয় মর্মে প্রশ্ন জেগেছিলো যে, ‘জগৎ’ কি সত্য? আবার জাগতিক ভোগোন্মত্ততায় মৃত্যঞ্জয়ী হওয়ার অপার্থিব আকাঙ্ক্ষা উন্মাদ হয়ে ভেবেছিল ‘জীবনটা অনিত্য কেন?’ যা অদৃষ্ট নির্ভর এবং ইন্দ্রিয়াতীত। বস্তু সত্তার অন্বেষণে আমাদের সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতায় প্রশ্ন জেগেছিলো ‘জীবনটা কি কেবলই ভাগ্যের অধীন?’ এসব জিজ্ঞাসার সদুত্তর দিয়েছিলেন বিশ্বের প্রাচীনতম জ্ঞানী সক্রেটিস-প্লেটো অ্যারিস্টটল, যেগুলো ছিলো-আছে এবং থাকবে : কহড় িঃযুংবষভ, ঊাবৎু বারষ পড়সবং ড়ঁঃ ড়ভ রমহড়ৎধহপব, কহড়ষিবফমব রং ধহ ধধিৎবহবংং ড়ভ ভধপঃং, ঞড় বৎৎ রং যঁসধহ ইত্যাদি।
এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর মানবসভ্যতার সূচনায় পারস্পরিক সমাজবদ্ধতার তাগিদে যে যে অবশ্য পালনীয় নিয়মের প্রচলন ঘটেছিলো তা-ই ‘ধর্ম’। মানব ভ্রূণ সৃষ্টিরহস্যে যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি মানব প্রকৃতিতে নিহিত রয়েছে মতান্তরের উন্মাদনায় সৃষ্ট মনান্তর। সনাতনীদের মধ্যে রয়েছে উদ্ভট ৪টি বর্ণ বিভক্তি। ইসলামের মধ্যে প্রধানত শিয়া-সুন্নি বিভাজন, শিয়া পন্থীদের তিন মাযহাব ও সুন্নি পন্থীদের চার মাযহাব। খ্রিস্টানদের বিভাজন হলো : রোমান ক্যাথলিক পূর্ব অর্থোডক্স এবং প্রোটেস্ট্যান্ট। বৌদ্ধধর্মের বিভাজন প্রধানত তিনটি, যেমন থেরবাদ-মহাযান, বজ্রযান ইত্যাদি। সর্বসাকুল্যে আনুমানিক দশ হাজারের অধিক সংখ্যক ধর্ম বিশ্বাসী রয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই অঞ্চল ভিত্তিক এবং মৌলিকত্বে মতান্তরের ফসল।
পক্ষান্তরে বিশ্ব মাতব্বরগণ নিজেদেরকে সমদর্শী সাজায়ে মতান্তরে বিভাজিত ধর্ম বিশ্বাসীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের যজ্ঞানলে ঘৃতাহুতি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বকে চির অনুন্নতার প্রকাষ্ঠে রেখে নিজেরা অধিকতর উন্নতির শিখরে উঠে যায়। এই হলো বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির হালচাল।
আমরা যে আড়ষ্টতায় প্রতিবন্ধী হয়ে দেয়ালে লেগেছি, তাতে সৃষ্টিশীল শিক্ষার মুখ দেখাতো দূরের কথা, মানবতার শিক্ষায়ও অনেক পিছিয়ে আছি। পক্ষান্তরে ইউরোপ-আমেরিকা ও চীন সমদর্শী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরম নিয়মানুবর্তী চালকের আসনে আসীন। এখানে বলতে হয়, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাটা সৃজনশীলমুখী করাটা অপরিহার্য। কারণ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ভিত শিক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার আবেশ এনে দেয়।
আদিকালের সেই স্রোত পরম্পরার ধারায় নেমে আসা অমলিন এবং শাশ্বত নীতি বাক্যগুলোকে সহজ বোধগম্যতার মধ্যে আনা হয়েছে প্রায় দশ হাজার গ্রন্থে। এই আলট্রাডিজিটাল যুগে রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনীতি শালীন ও মানবীয় আচরণ থেকে বহু যোজন দূরে সরে গিয়েছে। ক্ষমতার বয়ানে মনে হয় ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ রাখাটা হাড়ে হাড়ে যথার্থ।
হায়! আবহমানকালের চরম অবস্থার সোনার বাংলা কুশাঙ্কুর দ্বারা আজ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মারাত্মক হযবরল অবস্থার তুঙ্গে। যেখানে মব সন্ত্রাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিবেক বোধের অভূতপূর্ব পচনশীলতায় আগামী ২০২৬ সালটি ১৯৭৪ সালের মহামারি জনিত দুর্ভিক্ষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৩-০৬-২০২৫)। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিলো শতকরা সাড়ে ছয় শতাংশ আর আসন্ন ২০২৬ সালে তা হতে পারে শতকরা সাড়ে তিন ভাগ মাত্র। এটি নিশ্চয়ই অনাকাঙ্ক্ষিত। অস্তাচলের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত বিগত নিন্দিত ষোলোটি বছরের সার্বিক অপশাসনের তুলনায় নতুন উপদেষ্টা শাসিত মাত্র দেড় বছরের সরকার যেন নিন্দিত না হয়ে ইতিহাসে প্রশংসিত হয়Ñএটাই জনগণের কামনা। ভুল স্বীকার করার ঔদার্য অতি মহৎ গুণ। বেঈমান কখনো অনুতপ্ত হয় না, আবার স্বার্থপরেরা কখনো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। আজকের এই আধুনিক জগতে মানবতায় জড়তার যে ধস নেমেছে তাতে শান্তচিত্তে মানুষের পরস্পর সহাবস্থানের বাস্তবধর্মী চিন্তায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে এক রূঢ় মাইন্ড-সেট। যাতে মানব সভ্যতা তো বটেই, এর অনাগত ভবিষ্যৎও ঘনকালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। যেখানে সৃষ্টি বৈচিত্র্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না, থাকবে শুধুই অঁাধারের রূপ।
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ,