প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ২০:৩৮
ফরিদগঞ্জে ডা. নুসরাত জাহান বিস্তির ভুল চিকিৎসায় নারীর অকাল মৃত্যু।। ১৫ বার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেও রোগ নির্ণয় করতে পারেন নি
'লাইফ জেনারেল' নাকি 'ডেথ জেনারেল' হাসপাতাল?

২৩ বছর বয়সী গৃহবধূ ফারিয়া আক্তার। দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার স্বপ্ন নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফরিদগঞ্জের লাইফ জেনারেল হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডা. নুসরাত জাহান বিস্তির কাছে। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রায় নয় মাস ধরে ছিলেন ওই চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।
|আরো খবর
২০২৫ সালের ২০ জুলাই। সিজারিয়ান অপারেশনের জন্যে ফারিয়াকে নেয়া হয় এই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে । কিছুক্ষণ পর ফারিয়ার শ্বশুরকে ওটিতে ডেকে নিয়ে বলা হয় 'জরায়ুতে টিউমার পাওয়া গেছে, দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।' হতবাক পরিবার সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফারিয়াকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । সেখানে জরুরি অপারেশনে নবজাতক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও ২৩ জুলাই বিকেলে ফারিয়ার মৃত্যু হয়।
ঢাকা মেডিকেলের মৃত্যু সনদে বলা হয়, Placenta Increta জনিত জটিলতায় সেপটিক শক ও হাইপোভোলেমিক শকে মৃত্যু হয়েছে ফারিয়ার। গর্ভাবস্থায় ফারিয়া অন্তত ১৫-১৬ বার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করান। অথচ চিকিৎসক হিসেবে ডা. নুসরাত বুঝতে পারেননি রোগীর প্লাসেন্টা ইনক্রেটার মতো ভয়ংকর জটিলতা রয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, এটি এমন এক অবস্থা যেখানে গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) অস্বাভাবিকভাবে জরায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। এই রোগ সাধারণত ১৬-১৮ সপ্তাহেই আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়ার কথা।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম দ্বীন বলেন, আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে প্লাসেন্টার অবস্থান বোঝা যায়। রোগীকে সঠিক সময়ে রেফার করা হলে এমন মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল।
ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর ফারিয়ার পরপর তিনটি অপারেশন করতে হয়। প্রথমে নবজাতককে বের করা হয়, দ্বিতীয় অপারেশনে গর্ভফুল আলাদা করা হয়, তৃতীয় অপারেশনে জরায়ু কেটে ফেলা হয়। এরপরও রক্ষা করা যায়নি ফারিয়ার জীবন। ২৩ জুলাই বিকেলে মৃত্যু হয় এই তার ।
ফারিয়ার শ্বশুর মাহবুবুল আলম বলেন, তিন কক্ষ পেরিয়ে ওটিতে গেছি, সবখানে ছিলো রক্ত। ডাক্তার বললেন টিউমার, অথচ ঢাকায় গিয়ে জানলাম কিছুই ছিল না। দায় তো কেউ নিচ্ছে না! তিনি আরও জানান, ফারিয়া ওটি রুমে হেঁটে গিয়েছিলো। কয়েক মিনিট পরই বলা হয় তার পেটে টিউমার, দ্রুত ঢাকায় নিতে হবে। অথচ ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা জানান, টিউমার নয়, আপনারা ভাগ্যবান, শিশুটা বেঁচে গেছে।
এদিকে চিকিৎসকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ডা. নুসরাত জাহান বিস্তির প্রেসক্রিপশন ও চেম্বারের কার্ডে লেখা রয়েছে এফসিফিএস শেষ পর্ব (গাইনি ও অবস)। তবে জানা যায়, তিনি এখনও পরীক্ষার্থী। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এভাবে লেখায় সমস্যা নেই। পড়ালেখা চলাকালীন এমন লেখা যায়।
ফারিয়ার পরিবারের অভিযোগ, অপারেশন থিয়েটার ছিলো রক্তে ভেজা ও অপরিচ্ছন্ন। রোগীকে সময়মতো রেফার না করে ভুল তথ্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়।
লাইফ জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. পরেশ চন্দ্র বলেন, সবসময় আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ইনক্রেটা ধরা পড়ে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মন্তব্য দায়িত্ব এড়ানোর নামান্তর। ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, জরায়ুর বাইরে কখনোই গর্ভফুল থাকে না। প্লাসেন্টা দেখতে হলে জরায়ুর দেয়াল কেটেই দেখতে হয়। জরায়ু না কেটে প্লাসেন্টা দেখা--এ দাবি চিকিৎসা নীতির পরিপন্থী।
চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম দ্বীন বলেন, গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই হাসপাতালটি বয়কটের ডাক দিয়েছেন৷ চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন সাধারণ মানুষ।
ফারিয়ার স্বপ্ন ছিলো নতুন জীবনের, নতুন সন্তানের মুখ দেখার। সেই সন্তান বেঁচে আছে, কিন্তু মা নেই।
ফরিদগঞ্জের এই হাসপাতালে পূর্বেও ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগী মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। সংবাদপত্র এজেন্ট মাওলানা তাজুল ইসলামের পুত্রও এই হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে।