প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
শিক্ষার অনেকগুলো দিকের মধ্যে আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজজীবন, ব্যক্তিজীবনের কর্মফল আবর্তিত হয়।
কথা হচ্ছে, আমরা এই শিক্ষাটা কোথা থেকে পাবো? অনেকে বলবেন সমাজ থেকে, কেউ বলবেন বিদ্যালয় থেকে, আমি বলবো পরিবার থেকে। যারা সমাজ এবং বিদ্যালয় থেকে নৈতিক শিক্ষা বেশি পাওয়া যায় বলবেন আমি তাদের মতকেও অগ্রাহ্য করছি না। সমাজ এবং বিদ্যালয় থেকে নৈতিক শিক্ষার বেশি অংশ পাওয়া উচিত কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সমাজের নানামুখী বিরুদ্ধাচরণের ফলে এখন নৈতিকতার অকাল চোখে স্পষ্ট। বিদ্যালয়গুলোতেও পাঠ্যপুস্তক গলাধকরণই যেনো বিশেষ কার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যাই হোক, সে আলোচনায় বেশি দূর যাচ্ছি না। পরিবারই কেনো নৈতিক শিক্ষার আঁতুড়ঘর সে সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
ঘটনা ১. আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন বাবার সাথে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। সায়াদাবাদ বাস টার্মিনালে আসার পর বাবা একটা ব্যাগ কুড়িয়ে পেলেন। ব্যাগটা পেয়ে বাবাকে দেখলাম ভেতরে কি আছে সেটা খুলে দেখতে। ব্যাগটার ভেতর ছিলো পাঁচ লাখ টাকা এবং একটা পাসপোর্ট। বাবা এগুলো দেখে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন। ব্যাগটা কীভাবে ফেরত দিবেন সেটাই হয়ে উঠলো বাবার মূল লক্ষ্য। বাবা এতোটাই দিশেহারা হয়ে উঠলেন সেদিন আর বাড়ি ফিরেননি। লোকটাকে খুঁজতে থাকলেন, বিকেল তখন ঠিক ৫টা বেজে গেছে বাবা পাসপোর্টে থাকা ঠিকানা দেখে নিশ্চিত হলেন ব্যাগটি জয়দেবপুর এলাকার এক ব্যক্তির। বাবা আমাকে সাথে নিয়েই সেদিন জয়দেবপুর গেলেন এবং মহত্মের পরিচয় দিয়ে টাকাসহ ব্যাগটি ফিরিয়ে দিলেন। লোকটি বাবাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। খুশি হয়ে আমাকে জামা কিনে দিলেন। লোকটি আজও আমাদের পরিবারের বড় বন্ধু।
সেদিনই শিখেছি অন্যের জিনিস কীভাবে রক্ষা করে ফিরিয়ে দিতে হয়। কীভাবে লোভ ত্যাগ করতে হয়। সেদিনের স্মৃতি ও শিক্ষা আজও বুকে লালন করি।
ঘটনা ২. আমি খুবই সাধারণ একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই মফস্বলে বড় হওয়া। আমাদের পাশের বাড়ির মাথা মোটা নামে একটা লোক ছিলো। তিনি সারা বছরই বিলেতি ধনিয়ার চাষ করতেন। একদিন হলো কি, তিনি তার পুরো ধনিয়া খেত লুটে দিলেন, আমার সব সহপাঠীরা গেলো কুড়িয়ে আনতে। আমিও তাদের সাথে গেলাম। ছোট্ট একটা পলিথিনে করে ধনিয়া পাতাগুলো নিয়ে যখনই বাড়িতে আসলাম দেখলাম বাবা ঘরে। মায়ের হাতে দিলাম মা ঘরে রেখে দিচ্ছিলো। বাবা মায়ের হাত থেকে ধনিয়া পাতাগুলো নিয়ে আমাকে ডেকে বললেন কোথা থেকে এনেছো এসব? আমি বললাম লুটিয়ে দিয়েছিলো কুড়িয়ে এনেছি। বাবা বিশ্বাস করলেন না। বাবা খোঁজ নিতে চললেন সেই মাথা মোটা লোকটার বাড়ি, গিয়ে সত্যিটা জানলেন এবং দায়-দাবি ক্ষমা চেয়ে এসেছেন এবং নিশ্চিত হলেন এগুলো আমি অন্যায় করে আনিনি। সেই থেকে অন্যের জিনিস সামনে পড়ে থাকলেও আর ছুঁয়ে দেখিনি।
ঘটনা ৩. আমার চাচাতো ভাই একটার চুরি করার বদঅভ্যাশ ছিলো। অন্যদের জিনিসে যখন হাত দিতো সবাই ওরে মারতো, অনেক বকা দিতো। অবস্থা এমনই ছিলো ওর জ্বালায় সবাইর সতর্ক থাকতে হতো। কিন্তু আমার বাবাকে দেখেছি কখনো আমাদের কিছু চুরি করলে ওকে বকা দিতেন না। বরং বাবা ওকে নিজে ডেকে এনে পকেট খরচ দিতেন, প্রচণ্ড যত্ন করতেন। একটা পর্যায়ে আমাদের দোকানের দায়িত্ব ওর হাতে দিয়ে দেয়া হয়। সবাই যেখানে শাসন করে ঠিক করতে পারেনি, আমার বাবা তাকে ভালোবাসা দিয়ে ভালো করলেন। সেই থেকে শিখলাম ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সব জয় করা যায়।
এই ছোট ছোট শিক্ষাগুলোই নৈতিক শিক্ষা। এগুলো আমদের পরিবার থেকেই পেতে হবে। আপনার নৈতিক শিক্ষা কেমন তার ওপরই নির্ভর করবে আপনার আগামী। তাই প্রতিটি পরিবারই হোক নৈতিক বিদ্যালয়। পৃথিবী ভরে উঠুক আলোয় আলোয়।