প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
সাজিদ ও আদিব। নাম দুটি দিয়ে এলাকার সবাই ‘গলায় গলায় ভাব’ বোঝায়। অবশ্য কারণও আছে। আর তা হলো-এদের দুজনকে কেউ কখনো একা রাস্তায় হাঁটতে দেখেনি। এমনকি স্কুলেও তারা আসলে একই সাথে আসে আবার একজন না আসলে অন্যজনও আসবে না। স্কুলের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিযোগিতা কিংবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও তারা একই সাথে অংশ নেবে।
এত মিল থাকার পর হয়তো সবাই ভাববে যে তাদের শখ, মন-মানসিকতাও এক। কিন্তু অবাক করা হলেও সত্য যে তাদের শখ, মানসিকতাণ্ডদুটোই ভিন্ন। আর তাও বিপরীতমুখী। যেমন : আদিব বরাবরই প্রথম সারির ছাত্র হলেও সাজিদ শেষের দিকের। সাজিদের পছন্দ খেলাধূলা। একেবারে ফুটবল, ক্রিকেট সব। অন্যদিকে আদিব একেবারেই যাকে বলে ঘরকুনো। আবার সাজিদ যেখানে ক্লাসে চিল্লাতে চিল্লাতে মাথা ধরিয়ে ফেলে, সেখানে আদিব নাক ডেকে ঘুমোতে থাকে! তো এমনই বৈপরীত্যের পরও তাদের এত ভাব ও বন্ধুত্ব কিভাবে হলো, তাই আজ বলবো।
সেদিন ক্লাসে ঘোষণা হলো একটা সায়েন্স ফেয়ারের আয়োজন করা হবে, তাই যারা ইচ্ছুক তারা যেন আগামী পরশুর মধ্যে নাম জমা দেয়। যথারীতি সাজিদ তো প্রায় লাফিয়ে উঠল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আদিব তখন হাই তুলছিল খবরটা শুনে। মানে যাকে বলে নিরামিষ। তবুও কিভাবে যেন ঐদিনই আদিবের আম্মু খবরটা জানতে পারে। ওনার আবার এসব ব্যাপারে খুব আগ্রহ। কিন্তু কোনোভাবেই ছেলেকে এইসবে আগ্রহী করতে পারেননি। তবে এবার তিনি শক্ত হলেন। ঐদিনই বিকেলে আবার সাজিদ আদিবের বাসায় এলো একটা নোট খাতা দিতে। একটা কথা জানিয়ে রাখি, আদিব প্রথম দিকের ছাত্র হওয়ায় তার করা নোটগুলো অন্য ছাত্ররা নিয়ে নোট করে আবার ফিরিয়ে দেয়। তেমনি গতকাল সাজিদ একটি নোট নিয়েছিল।
সাজিদকে দেখে তো আদিবের আম্মু মহাখুশি। কারণ তিনি সাজিদের ব্যাপারে জানতেন। আর কিছুক্ষণ আগেই সায়েন্স ফেয়ারে আদিবের অংশ নেয়ার জন্য তিনি এমনি একজনের কথা ভাবছিলেন। তাই সাজিদকে দেখেই তাকে সামনের রুমের সোফায় বসিয়ে তিনি আদিবকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। আদিবকে নিয়ে তিনি সাজিদের সামনে বসলেন। এরপর তাঁর পরিকল্পনার কথা বললেন। মানে আদিবকে সাজিদের সাথে সায়েন্স ফেয়ারে অংশের বিষয়টি আরকি। তিনি সাজিদ শেষে বললেন, ‘বাবা, তুমি তো আদিবকে চেনোই। সে কেমন অলস। তার চিন্তায় আমি অস্থির। এখন আমি চাই সে যেন তোমার সাথেই সায়েন্স ফেয়ারে অংশ নেবে। এর জন্য সব রকম সহায়তা আমি করবো। শুধু তুমি তাকে তোমার সাথে রেখে কাজ করাবে। দয়া করে না বলো না।’
এতটুকু বলেই তিনি সাজিদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
আদিব তো মহাবিরক্ত। তার লজিক হলো-এমনিই সময় কত স্বল্প। প্রতিদিন মানুষ পায় ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট করে। বছরে যা দাঁড়ায় ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫০ দিন। সেখানে এমন ফালতু (তার মতে) কাজে কেন সময় অপচয় করবো।
যখনই সে তার লজিকটা তার আম্মুকে স্মরণ করাতে যাবে, তখনই তার আম্মু হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন। আম্মুর এমন আচরণে সে বেজায় অবাক। সাজিদ তখন আদিবের আম্মুর দৃঢ়তা দেখে কিছুটা ইতস্ত করে শেষমেষ রাজি হয়ে গেল। সে বলল যে, তার কাজের প্ল্যান প্রায় করে ফেলেছে।
পুরোপুরি শিওর হলে জানাবে। এই বলে সে চলে গেলো। পরদিন স্কুলে সাজিদ আদিবকে দেখে একেবারে হুলুস্থুল বাধিয়ে বসে। গতকালকের ঘটনাগুলো যেনো বিশ্বাসযোগ্যই নয়। সব যেনো রুপকথার কাল্পনিক ঘটনাবলী। এরপর যখন শান্ত হলো তখন ওর চোখগুলো চিকচিক করছিলো। আদিব অবশ্য নিরস চোখেই তাকিয়ে রইল তার দিকে। সাজিদ বলতে লাগলো,
-‘এবার আমি ভাবছিলাম কাকে সাথে নিবো। কারণ গতবারের সময় আলভি আর আরিকসহ যাদের সাথে করেছিলাম, তাদের জন্যই শেষে সব বিগড়ে যায়। এবার তোকে পাওয়ায় ভালোই হলো। তুই তো আর ওদের মতো এসবে একধাপ এগিয়ে ভাবিস না তাই আমি একটু স্বস্তির সাথেই কাজটা করতে পারবো। সব প্ল্যানই ঠিকঠাক আছে। আগেই ঠিক করা ছিল, শুধু তোর আম্মুর সাথে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছিল বলে আর তখন বলিনি। তোকে শুধু আমার প্ল্যানটাকেই গুছিয়ে দিতে হবে, যাতে দুজনের সমান অংশ হয় আর সুষ্ঠুভাবে কাজ হয়। তাহলে শোন....।’
সাজিদ অনর্গল বলে গেল আদিবকে তার প্ল্যান সম্পর্কে। আদিব তো একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কারণ সাজিদের এমন প্ল্যান আর বলার ধরণটা একেবারেই অন্যরকম ! আদিব ধীরেধীরে তার চোখগুলো বড় করতে লাগলো। যখন সাজিদ শেষ করল, তখন আদিবের অবস্থা একেবারে দেখবার মতো ছিল। যাহোক সাজিদের প্ল্যানের কিছু পয়েন্ট নোট করে সেদিনের মতো আদিবের সাথে সাজিদের আর কথা হয়নি।
আদিব বাসায় এসেই ধপাস করে বিছানায় পড়লো। শুয়ে থেকে ভাবতে লাগলো সাজিদের প্ল্যান নিয়ে। সে ক্লাসের টপারদের একজন হলেও তার মতো ভাবতে পারেনি কখনো। কিন্তু সাজিদ? আদিবের কাছে তার চেনা জগৎটা আচানক পাল্টে যাচ্ছে। ঠিক করে বললো, তার এতদিনের হাইপোথেসিসটা বদলে যাচ্ছে। আদিবের মাথার ভেতরকার চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে গেলো। তার চোখ দুটোর উপর কালো পর্দা নেমে এলো। ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো সে।
পরদিন খুব ভোরে উঠে ফজর নামাজ আদায় করে পড়ার টেবিলে বসলো আদিব। যদিও সে প্রায়দিনই আলো ফুটলে ঘুম থেকে উঠে কাযা আদায় করে। তবে আজ তার ব্যতিক্রম হলো। টেবিলে বসে কিছুক্ষণ ভাবল। সে এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই কি চলবে? উত্তর মিলে না কিছুতেই। তবু সে কেন যেন ধীরে ধীরে একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এরপর সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে একটি নোট খাতা নিয়ে টুকটাক কিছু লিখলো। আর সাজিদের থেকে নেয়া পয়েন্টগুলোতে একবার চোখ বুলালো। সে একটা কিছু করবার উদ্যমতা অনুভব করে।
দরজার ফাঁক দিয়ে ছেলের অবস্থা ও পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছিলেন আদিবের আম্মু।
তারপর প্রায় ছয়মাস হলো। আদিবদের প্রজেক্টটা তেমন কিছুই করতে পারেনি ঠিকই তবে আদিবের মনে আঁচড় কাটতে পেরেছে গভীরভাবে। আদিব আর সাজিদের সখ্যতা সেদিন থেকেই শুরু হয়। আদিব সাজিদের কাছ থেকে অন্যভাবে চিন্তা করতে শিখেছে বলেই তার এই পরিবর্তন। আদিবের এই পরিবর্তনে অবশ্য তার লেখাপড়াতে কোনো ঘাটতি তৈরি করতে পারেনি বরং উল্টোটা হয়েছে। অনেকেই তাই আদিবকে সন্দেহের চোখে দেখে। এমনকি তার মাও! তবে তা ক্ষণিকের জন্য।