প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫১
নির্মেঘ অপেক্ষা

গ্রামের নাম ছিল ধানছেঁায়া। সবুজে ঘেরা, ছোট্ট একটা গ্রাম। মাঠে মাঠে ধানের গন্ধ, বাতাসে কাকডাকা ভোর, আর সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকার সুর। সেখানে থাকত প্রিয়াÑএকটা শান্ত, নম্র, কল্পনাপ্রবণ মেয়ে। বয়স সতেরো, কলেজে পড়ে না, বাড়িতেই থাকে। তবে বই তার বন্ধু, আর প্রকৃতি তার আপনজন।
সেদিন ছিল বর্ষার শুরু। আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা, বাতাসে কেমন যেন এক বিষণ্নতা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই ঘন কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল আকাশ। দিগন্তজুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি। তারপর শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বাতাসে গাছের পাতা কঁাপছিল, ঘর কেঁপে উঠছিল মাঝে মাঝে। প্রিয়া জানালার পাশে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। ওর চোখে মুখে বিষণ্ন আনন্দ। ঝড়ের ভিতরেও সে খুঁজছিল সুর।
হঠাৎ করেই ঝড়টা তীব্র হয়ে উঠল। সামনের জামগাছের ডাল ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা কিছুর শব্দ হলোÑমিহি, কঁাপা একটা আর্তচিৎকার। প্রিয়া চোখ তুলে তাকাল। গাছের নিচে পড়ে আছে একটা ছোট পাখির ছানা। হয়তো ডিম থেকে সদ্য ফোটে, ডানা গজিয়েছে সামান্যই। তবুও ঝড়ে নিচে পড়ে গেছে।
প্রিয়া ছুটে গেল ভিজে গেছে ছানাটা, কঁাপছে সারা গা। প্রিয়া তাকে বুকের কাছে নিয়ে এল, গরম কাপড় মুড়ে রাখল। মা বলল, “নিয়ে এলি? মরবে না তো?”
প্রিয়া শুধু বলল, “ওকে ফেলে রাখতে পারতাম না মা।”
পাখিটার চোখ ছিল ছোট, গোল। ডানা কঁাপছিল হালকা। ও যেন জানত, এটা আশ্রয়Ñএ বাড়ি তার নিরাপদ ঘর।
প্রিয়া নাম দিলÑমেঘু। কারণ ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল মেঘলা এক দুপুরে।
মেঘু ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগল। প্রিয়া তাকে খাওয়াত দানা, মাঝে মাঝে পাকা আমের কুচি। মেঘুর চোখে ধরা পড়ত ভরসা আর মায়া। প্রিয়া আর মেঘু হয়ে গেল একে অপরের সঙ্গী।
দিন পেরোতে লাগল মেঘু বড় হচ্ছিল। ডানা শক্ত হচ্ছিল, সে মাঝে মাঝে উড়ার চেষ্টা করত। প্রথম প্রথম ব্যর্থ হতো, পড়ে যেত। প্রিয়া তখন পাশে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিত।
একদিন মেঘু নিজে থেকেই বিছানার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে উড়ে গেল। প্রিয়ার মুখে হাসি ফোটে, যেন নিজের সন্তানের প্রথম হঁাটতে দেখে।
মেঘু সকালে উঠে প্রিয়ার চুলে ঠেঁাট ছুঁয়ে দিত, দুপুরে জানালার রেলিংয়ে বসে থাকত। বিকেলে তারা একসাথে বসে থাকত ছাদে। পাখিটার চেনা ডাক ছিল, “চুঁই-চুঁই।” প্রিয়া মাঝে মাঝে হেসে বলত, “তুই আমার মন খারাপ হলে বুঝতে পারিস, না রে?”
প্রিয়া এমনকি তার নিজের বানানো কাগজের ডায়রিতে প্রতিদিন লিখতÑ“আজ মেঘু দুই ফুট উড়েছে।” “আজ সে আম খেয়েছে হাসিমুখে।”
তারা যেন এক অদ্ভুত, শব্দহীন বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিল।
মেঘু যখন পুরোপুরি সুস্থ ও বড় হয়ে গেল, তখন সে মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে উড়তে চাইত। প্রিয়া তাকে বাধা দিত না। সে জানত, পাখিকে আটকে রাখার নাম ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা মানে ওকে আকাশ দেখানো, ওকে শক্ত ডানা দিতে সাহায্য করা।
একদিন সকালে প্রিয়া তাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে বলল, “তুই উড়তে পারিস, কিন্তু ফিরতে ভুলিস না।”
মেঘু আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝল কথা। সে ডানা মেলল। অনেক চেষ্টার পর সে ছাদ ছাড়িয়ে উড়ল। একটু উপরেই ঘুরে আবার ফিরে এলো। প্রিয়া তার কপালে ঠেঁাট ছুঁয়ে বলল, “তুই আমার ভালোবাসা, তুই থাকিস মুক্ত।”
তারপর একদিন... মেঘু উড়ে গেল, আর ফিরে এলো না। সকাল থেকে প্রিয়া ছাদে দঁাড়িয়ে ছিল। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল, আকাশে তারা উঠল, কিন্তু মেঘু এল না।
প্রথম দিন প্রিয়া ভেবেছিলÑআজ না হয় কাল ফিরবে।
দ্বিতীয় দিন তার মুখে কিছু খাওয়া গেল না।
তৃতীয় দিন সে ডায়রিতে লিখলÑ“আজ তোর গন্ধটাও নেই।”
তারপর দিন যেতে লাগল। মাস পেরোল, তারপর বছর। কেউ বলল, পাখির তো মন নেই, ভুলে গেছে। কেউ বলল, হয়তো মারা গেছে।
কিন্তু প্রিয়া একটাও কথা বিশ্বাস করেনি। সে জানত, মেঘু ছিল অনুভব, সে ছিল ভালোবাসা।
প্রিয়া এখন প্রতিদিন ছাদে যায়। দঁাড়িয়ে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মেঘু ফিরবেÑএই বিশ্বাস নিয়ে।
তাকে দেখে সবাই ভাবে, হয়তো পাগল। কেউ কেউ মায়া করে বলে, “এখনও কি আশা আছে?”
প্রিয়া মৃদু হাসে। উত্তর দেয় না। তার চোখে এখনো সেই প্রথম দিনটির মতোই আকাশ ভালোবাসা অঁাকে।
ডায়েরির পাতায় সে প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখেÑ
“আজ বৃষ্টি পড়ছে, মেঘু ভালোবাসত।”
“আজ তোর মতো একটা পাখি দেখলাম, কিন্তু সেটা তুই না।”
“আমি ঠিক আছি, কিন্তু তোকে ছাড়া কিছুই ঠিক না।”
প্রিয়া কখনো অভিযোগ করে না। সে জানত, এই ভালোবাসা একতরফা হলেও সত্য। সে জানত, ভালোবাসা মানে ফিরে পাওয়া নয়Ñছাড়া, মুক্তি দেওয়া, আর কেবল অপেক্ষা করা।
প্রিয়া এখনো প্রতিদিন ছাদে যায়। বৃষ্টির দিনে, ঝড়ের রাতে, শীতের সকালে...সে জানে, একদিন হয়তো মেঘু ফিরবে। আর যদি না-ও ফেরে, তবুও সে অপেক্ষা করবে।
তার ভালোবাসা আটকে রাখেনি, কেবল উড়তে শিখিয়েছিল। শেষ পাতায় সে লেখেÑ“যে ভালোবাসে, সে বেঁধে রাখে না কেবল অপেক্ষা করে।”








