শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

আমাদের স্বাধীনতা : আমাদের প্রেরণা
অনলাইন ডেস্ক

‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা/ কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস/ ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’/ কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে/ ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।’ কবি হেলাল হাফিজ যে পতাকা ও স্বাধীনতার কথা বলেছেন, সেই স্বাধীন দেশের পতাকা, সেই স্বাধীনতা এসেছে এ বাংলায়। সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার ৫২ বছরে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হাজার বছরের পরাধীনতার শেকল ভেঙে বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। তাই এ দিনটি সমগ্রজাতির বহুকালের লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর।

পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার দীর্ঘ ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালে অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে এ উপমহাদেশের মানুষ পেয়েছিল পাকিস্তাান ও ভারত নামের দুটি দেশ। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আমরা হয়েছিলাম শোষিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত ও সব ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন আমাদেরকে নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই শতাব্দীর মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির মহা লক্ষ্যে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ছাপ্পান্নয়ের সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, আটান্নয়ের মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে সত্তরের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সবই বাঙালি জাতীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসনামলে দীর্ঘ বারো বছরের অধিক সময় ধরে কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা, কয়েকবার ফাঁসির কাষ্ঠের মুখোমুখি, অসংখ্যবার মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করার পরও এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিলেন জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব পরাধীন এ জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া তাঁর বক্তব্য আমাদেরকে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল।

আজ আমরা স্বাধীন, আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র ও পতাকা। আজকের এ দিনে জাতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর সন্তানদের। স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতীয় নেতা, নৃশংস গণহত্যার শিকার লাখো সাধারণ মানুষ এবং সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের। জাতি স্মরণ করে দেশের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য, স্বাধিকারের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা প্রতিটি মানুষকে। লাখ লাখ শহীদের রক্তে রাঙ্গানো আমাদের স্বাধীনতা এদেশের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় ও পবিত্রতম। এই দিনে আমরা আত্মপরিচয়ের গেীরবে উজ্জ্বল, ত্যাগ ও বেদনায় মহীয়ান হওয়ার প্রেরণা লাভ করি।

কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। স্বাধীনতা মানে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন নয়; স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসাবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি দেশের স্বাধীনতা সেদিনই সার্থক হয় যেদিন দেশের আপামর জনগণ প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ক্ষমতা অর্জন করে। কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’

তাই স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে আমাদের সময় এসেছে ফিরে দেখার। যে মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেদিন আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন পুণ্যভূমি, বীর শহীদেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, আমরা কি সে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছি? স্বাধীনতা অর্জনের বায়ান্ন বছর পর এখনও অসংখ্য মানুষ অশিক্ষিত ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। বেকারত্বের জ্বালায় আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয় ও সমাজ বিরোধী পথ। এখনও আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারিনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আজ আমাদের দায়িত্ব এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা। এক্ষেত্রে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতামতও প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই দেশ মাতৃকাকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মকে অস্ত্র ধরতে হবে না। তাদের কলম যুদ্ধ করতে হবে, মেধার যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধ হবে দেশের ভিতরে এবং বাইরে। আর সেই যুদ্ধের মাধ্যমে গৌরব ছিনিয়ে আনতে হবে।

আমাদেরকে আরো ভাবতে হবে, আমরা পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলেও এ জাতির ভাগ্য নির্ধারণে এখনও পরাশক্তি অন্যায় হস্তক্ষেপ করে বিভিন্নভাবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক শক্তি এবং দাতা গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। আমরা বিনা প্রতিবাদে তা মেনেও নিই। জাতীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত করতে পারিনি আমরা। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় আমরা কবে উত্তীর্ণ হতে পারবো, কে জানে? আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি নীতিহীন। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে দেশ-জাতির স্বার্থকে আমরা এখনও বড় করে দেখতে অভ্যস্ত নই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্থরূপ নেই, পরমত সহিষ্ণুতার বড়ই অভাব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনীতিবিদ সহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সদিচ্ছার অভাবে যে প্রশ্নটিকে সামনে আনে, সেটি হচ্ছে আমরা কি সত্যিই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবাসি? মাতৃভূমির জন্যে আমাদের দেশপ্রেম কি যথেষ্ট? আমাদের রাজনীতি যদি স্বাধীনতার পথে অগ্রসর না হয়, রাজনীতি যদি স্বাধীনতাকে আত্মীকরণ করতে না পারে, তবে সে রাজনীতি জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না, বরং এক্ষেত্রে জাতীয় সংকট তৈরি হয়; জাতিসত্তার সংকট তৈরি হয়। স্বাধীনতার অন্তর্গত শক্তি ও আবেদন যেনো আমাদের সবসময় উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা যেনো জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ হই। মুক্তিযুদ্ধ যেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রতীক হিসেবে কাজ করে। রাজনীতির নানা মত ও পথ, বিরোধ ও ঐক্য যেনো স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী না হয়। স্বাধীনতার চেতনা, ত্যাগ, আগুন ও অশ্রুপাত, ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যেনো আমাদের দেশ গড়ার কাজে এক এবং একাকার হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব যেনো কোনোভাবেই বিপন্ন না হয়। সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন যেনো আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, জাতীয় প্রেরণার অবিনাসী উৎস স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনা থেকে আমরা যেনো বিচ্যুত না হই।

অজস্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতে পথ না হারায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো কঠিন। আজ বিশ্বের দিকে দিকে উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে আমাদেরও সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়নের ধারা। তাই দেশ গড়ার কাজে আজ প্রয়োজন সমগ্র জাতির নতুন করে শপথ নেয়া।

তবে আশার কথা হলো, যে জাতি মৃত্যুর তুহিনস্তব্ধতা থেকে জেগে উঠতে পারে, সে জাতি কেন পথভ্রষ্ট হবে? বাংলার মাটি ও মানুষ পরাজিত হতে জানে না। বিশ্বায়নের এ যুগেও রক্তের পলিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ-এমন প্রত্যাশা জাতির। স্বাধীনতা এক সময় ছিলো স্বপ্ন, পরে হলো লক্ষ্যবস্তু-এক পর্যায়ে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল। এখন আমাদের লক্ষ্য নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক মুক্তি। এই মুক্তিকে অর্জন করতে হলে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর নিরন্তন প্রয়াস থাকলে দেশ গড়ার প্রত্যয়টি প্রবাহিত হবে ইতিবাচক খাতে। স্বাধীনতার শপথে, শক্তিতে একদিন আমরা জেগে উঠেছিলাম; এখনও আমরা জেগে উঠবো অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। স্বাধীনতা দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

লেখক : প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়