শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৯

ধারাবাহিক উপন্যাস-৯

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(৬)

হাসপাতাল থেকে ফেরার পর কেমন যেন আগের মতো শরীরটা সায় দিচ্ছে না কোনো কিছুতে। ছেলেগুলো এখন বোঝা মনে করে আমাকে কিন্তু কী করে তাদের বোঝাব যে আমার আর কোনো জায়গা নেই যাওয়ার। ওদের রোজগারে সংসার চলে আর আমি সে রোজগারকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছি। কথাটা বলেছিল মেজবউ তার আন্টিকে অথচ আড়ালে আমার কানে চলে আসে বাক্যটা। জীবন যে এমন একটা রূপে আমার সামনে দাঁড়াবে কখনো ভাবিনি। অল্প অল্প করে গড়ে তোলা পরিবারটা এভাবে কেমন করে পর হয়ে যায় বুঝা যায় না। ওদের ব্যবসা-বাণিজ্যে শুধু লস আর লস। কথাটা শুধু আমাকে শোনানোর জন্য নাকি সত্যিই লস হচ্ছে? যদি লসই হয় তাহলে সবার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কীভাবে? এই তো সেদিন জেনিফার তার মামাতো বোনের বিয়েতে গিফটে স্বর্ণের নেকলেস দিল। আয় রোজগার যদি না হতো তাহলে এতদাম দিয়ে নেকলেস কীভাবে দেয়? ওরা যা ইচ্ছে করুক আমার কোনো আফসোস নেই শুধু আমার চাহিদা ওষুধগুলো। বয়সটা শেষের দিকে তাই রোগগুলোও যেন আপনভেবে শরীরে ভর করে বসেছে। একটা মানুষকে বোঝানো যায় আমার উপার্জন সীমিত কিন্তু ডাক্তার বা ওষুধের দোকানদারকে কীভাবে বুঝাই আমি সামর্থ্যহীন। নাতি-নাতনিরা বাদে অন্যদের সকলেই যেন এড়িয়ে যেতে চায়, ইচ্ছে হলেও কথা বলা যায় না। নিজের সন্তানকে আজ কেমন যেন ভয় লাগে। না জানি বিরক্ত করে ফেলছি কী না, আমার কোনো কথায় আবার নারাজ হবে না তো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু পাপের ফল নাকি গড এ দুনিয়ায় দেখিয়ে দেয় হয়তো আমার বেলায় তেমনি কিছু একটা চলছে নতুবা জীবন এত অসহনীয় হবে কেন। মৃত্যুটা অস্বাভাবিক হলে নাকি পাপের বোঝা বাড়ে নতুবা আত্মহত্যা করা যেত। আবার অন্যভাবে ভাবি জীবন যুদ্ধের শেষটা কী পরাজিত সৈনিকের মতো তার দরবারে ফিরব? বিচারের সময় যখন আমাকে বলা হবে জীবন সংগ্রামে তুমি কতটুকু জয়ী তখনতো মুখ লুকিয়ে বলতে হবে আমি আপনার দেওয়া উপহার মহান এ জীবনকে নষ্ট করে এসেছি। এই দুনিয়ায় শেষটা নত হয়ে থাকছি ঐ দুনিয়াতেও তাহলে নত হতে হবে! কেন? প্রতিদিন প্রে করার সময় ঈশ্বরকে বলি হে বিধাতা আর নয় এবার ক্ষমা কর আমায়। আমাকে রেহাই দাও আমার পাপের শাস্তি থেকে, আর পারছি না নিজেকে গড়ে নিতে। হঠাৎ খাবার জন্য আমাকে ডেকে গেল ছোট নাতিন। আজ কেন এ তলব বুঝতে পারছি না। এতক্ষণ যে ভাবনাগুলো ছিল

বেদনাদায়ক সেগুলো কী ভুল ছিল! নাকি আমি এমনিতেই তাদের দোষারোপ করছি। যাই গিয়ে সকলের সাথে ডিনারটা সেরে নেই। ডাইনিং এ আসার পরপরই দেখি সকলে আশপাশে বসা এবং আমার জন্য শুরুর দিকে চেয়ারটা খালি করা আছে। অন্যদিন নাতি-নাতনি থাকে টেবিলে অথচ আজ নেই। বসে সকলের সাথে প্রে করলাম তারপর খাবার জন্য প্লেট তোলা হলো। আজ খাবার টেবিল একটা পরিবার মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবছি কিছু তো একটা আছে নতুবা যেখানে আমার কোনো খোঁজ করত না কেহই আজ সাথে নিয়ে ডিনার করছে। সমস্যা যেটাই হোক না কেন সমাধান আছে। আমার খেয়াল আছে যেদিন পেনশনের টাকাটা তুলে এনে ঘরে ফিরি সেদিনও আমার এমনি একটু খাতির-যত্ন হয়েছিল। বিষয়গুলো অতটা বুঝতাম না কারণ তিক্ততাগুলো তখনো পরিবারে শাখা গজায়নি। সেদিন খাবার পর বারান্দায় বসে আলোচনা হয় মন্টির সাথে। ওরা চাইছিল ব্যবসায় আমি ইনভেস্ট করি আর ওদের ব্যবসাটা দেখাশোনা করি। ছেলেরা ব্যবসা করবে নিজের মতো এখানে বাবা হয়ে আমি বেশি একটা কমফোর্ট ফিল করব না বরং ওরা চাইছে নিয়ে যাক, সন্তান তো আমারি। বাবার টাকায় ওদেরও অধিকার থাকে তাই বিষয়টাতে আর যাচাইয়ের সুযোগ না দিয়ে সিংহভাগ টাকা ওদের দিয়ে দেই। আমাকে বহুবার ব্যবসায় বসার জন্য বলেছিল তখন এতটা আবেগী না হয়ে বসলে হয়তো আমার টাকাগুলো এভাবে নষ্ট হতো না। আবার ভাবি আমি তো ব্যবসার কিছুই বুঝি না এতে আমার নাখ গলানোটা হবে বেমানান। সারাজীবন করেছি চাকরি এখন হুট করে ব্যবসার কী বুঝব তাই পিছিয়ে গিয়েছিলাম। আজ পুনরায় একই মুহূর্ত আমার সামনে উপস্থিত হয়েছে, দেখি কী হয়।

‘বাবা আপনি তো জানেন আমাদের ব্যবসা দিনের পর দিন লস দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায় লাভ লস থাকেই তাতে রি-ইনভেস্ট করতে হয় নতুবা আগানো যায় না। আপনার সাথে সে বিষয়েই কথা বলতে চাইছিলাম।’

‘কী আলোচনা করতে চাও, কীভাবে রিকভারি করবে সেটার বিষয়ে!’

‘না, রি-ইনভেস্টমেন্টের বিষয়ে।’

‘ও আচ্ছা...তা কীভাবে করতে চাইছ?’

‘দ্যাটস এ গুড পয়েন্ট। আমাদের ছোট্ট একটা দোকান আছে যেটা থেকে তেমন একটা কিছু আসে না। তাছাড়া দোকান বড় হলে ভাড়াটাও অনেক বেশি আসত। এখন এটা অযথাই পড়ে আছে। আমি বলতে চাইছিলাম সেটাকে যদি বিক্রি করে দেই তাহলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। টাকাগুলো দিয়ে ব্যবসাটাকে পুনরায় দাঁড় করানো যাবে।’

‘আর যদি না হয়?’

‘হবে না কেন। তুমি শুরুতেই নেগেটিভ ভাবলে তো পজেটিভলি আগাবে কীভাবে?’

‘বিষয়টা পজেটিভ বা নেগেটিভের নয়, বিষয়টা সম্পদের। এর আগেও তো বড় একটা অ্যামাউন্ট লস করেছ। এতবড় একটা ইনভেস্টমেন্ট দিয়েও ব্যবসা চাঙ্গা করতে পারলে না তো এখন এই সামান্য আমাউন্ট দিয়ে কীভাবে দাঁড় করাবে। এটা শুধুই স্বপ্ন দেখা যার বাস্তবতা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।’

‘বাবা তোমার সম্পদের প্রতি এতটা লোভ কেন? কী করবে এগুলো দিয়ে? এ পরিবারটা তোমার সম্পদ না?’

‘সবই ঠিক আছে কিন্তু তোমরা ব্যবসার জন্য গড়ে তোলা সম্পদগুলোকে লুটিয়ে দিবে দেখছি। মানুষ ব্যবসা করে সম্পদ গড়ে আর তোমরা সম্পদ নষ্ট করে ব্যবসা করবে এটা কেমন কথা?’

‘এসব ফিলসপি ঝেড়ে কোনো লাভ নেই। এই সংসারটা কীভাবে চলে বলতে পার? আমরা প্রতিদিন হিমসিম খাচ্ছি এটাকে চালাতে। টের পাও কিছু?’

‘বাবা আপনার পিছে কত খরচ হচ্ছে সেটা কী বুঝেন আপনি?’

‘প্লিজ জেনিফার আমি আমার সন্তানদের সাথে কথা বলছি, তুমি বউ তাতে নাক গলানো উচিত না।’

‘বউ হয়েছি তো কী হয়েছে আমি এ পরিবারের একজন, কথা বলার ফ্রিডম আমারও আছে।’

‘ও ঠিকই বলেছে বাবা তোমার ওষুধের পিছে কত টাকা যায় সেটা কী খেয়াল রাখ। তুমি খাবার খাও তিন বেলা আর ওষুধ খাও চার বেলা। নিজেদের খরচ সামলানো দায় যেখানে সেখানে তোমার এতসব দামি দামি ওষুধ আমাকেই তো চালাতে হয়। কী হলো কথা বলছ না কেন?’

‘কী বলব, তোমাদের আরগুমেন্টের কাছে আমার ভাষা হারিয়ে গেছে। আমার খাওয়া শেষ আমি উঠব। থ্যাংকস ফর এ লাভলি ডিনার।’

‘আমি জবাবটুকু পাইনি।’

‘কী মনে হয় তোমার আমাকে কী হ্যাঁ বলা উচিত?’

‘অবশ্যি। তোমার যা কিছু আছে সেটা তো আমাদেরই। দোকানটা বিক্রি করতে তোমার সাইন লাগবে তাই জিজ্ঞেস করা।’

‘আমার উত্তর না।’ [পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়