শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে কচুক্ষেত থেকে কিশোরের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সকাল থেকে মন বেশ উতলা হয়ে আছে। ছেলেটা অনেকদিন হয় ফোন করে কথা বলছে না। তার ব্যস্ততা অনেক তাই হয়তো সময় পায় না। বয়সে এখন সে নবীন তার জীবন মাত্র শুরু। চোখে মুখে নতুনত্ব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তৈরি করবে, অর্জন করবে সৃষ্টিশীল হয়ে, গড়ে উঠবে তার ভুবনে নিজের মতো করে। আমার আর কীÑপ্রবীণ জড়াজীর্ণ মানুষ একটা যার পৃথিবীতে নতুন বলতে কিছু নেই। যা ছিল সেগুলো এক এক করে প্রবীণ হতে হতে ক্ষয়ে গেছে। অর্জনগুলো পুরানো হয়ে গেছে বা বলা চলে জীবনের অভিজ্ঞতায় উপরের নতুন প্রলেপটা ফিকে হয়ে এখন বিবর্ণ। কেন যে ছেলেটার কথা এত বারবার মনে পড়ছে বুঝলাম না। মন বলছে আজ সে কল দিবে। যদি না দেয়? তাহলে বিকেলে আমি নিজে থেকেই তাকে কল দিয়ে কথা বলব। এতদিন হয়ে গেল এই বুড়ো বাপটার কথা কী একবারও মনে পড়ে না! সেদিন অনিমেষের সাথে তার সন্তানদের বিষয়ে কথা হয় তখন সে বলেÑজানেন দাদা আমার ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিন একবার নির্দিষ্ট একটা সময়ে কল করে কথা বলে। আমি যতই ব্যস্ত থাকি না কেন রাত নয়টা থেকে ছেলে-মেয়েদের জন্য অপেক্ষায় থাকি। কথাটা শুনে তখন বেশ অভিমান হয় পরক্ষণেই আবার সেই অভিমান মিলিয়ে যায়। ওদের সন্তানেরা থাকে এ দেশেরই বিভিন্ন জেলায় কিন্তু আমার ছেলে সে তো সুদূর পরবাসী। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়াররা সারাক্ষণই ব্যস্ততায় সময় কাটায়। আমরা দূর থেকে তাদের বিষয়গুলো যতই সহজভাবে ভাবি না কেন উন্নত বিশ্বের কর্মব্যস্ততা ও জীবনধারা অন্যরকম। আমার পৃথিবী এই নিকুঞ্জ নিকেতনের মতো জড়াজীর্ণ অবস্থায় টিকে রয়েছে। হ্যাঁ নতুন করে পাওয়া তিনটে মানুষ আছে যাদের অবস্থা আমারই মতো। হারানোর বয়সে তিনটে রত্ন পাওয়া অনেক ভাগ্যের বিষয়। এখানে আমরা প্রত্যেকে মনের দিক থেকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যদি বলি কেন তাহলে বলা যায়-নিজেদের প্রয়োজনে। যেখানে এক এক করে হারিয়ে যায় আপনজনেরা সেখানে নতুন করে আপনভাবে কাউকে গড়ে নেওয়া সত্যি একটা অর্জন। এ কী এই সময় কে কল দিল?

‘হ্যালো বাপি...’

‘রাজীব... এতদিন পর এই বুড়ো বাপের কথা মনে পড়ল?

‘তুমি কেমন আছ বাপি? তোমার শরীর ভালো তো?’

‘আমার কথা জিজ্ঞেস করে কী লাভ। তোমার নিজের কথা বল আমি আর বাঁচবই বা কয়দিন সময় তো এখন তোমাদের।’

‘তোমার অভিমানী কথাগুলো শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। তুমি কী বল আমি চলে আসি ওখানে? এখানকার সুবিধাদি ও মেধা যাচাইয়ের যে সুযোগ আছে সেটা কী আছে আমার দেশে? আমার দেশে সেরকম সুবিধাগুলো থাকলে কী আর কেহ এভাবে অন্য রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায় এটা কেন বুঝ না বাপি। প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্ব দুটোর ব্যবধান অনেক।’

‘তুমি তো তৃতীয় বিশ্বেরই মেধা যা প্রথম বিশ্বে গিয়ে এখন উন্নতর হয়েছ। কী হতো, সুবিধাদি কম থাকত তোমার। যারা এদেশে চাকরি বা ব্যবসা করছে তারা কী ভালো নেই? এই আমি তোমার বাবা সারাটা জীবন চাকরি করে কাটিয়ে দিয়েছি আমি কী ভালো নেই? পার্থিব বিষয়ের সুবিধাদির জন্য নিজের মাটি নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে পরবাসী হওয়াও বেশি লাভজনক বলে আমার মনে হয় না। একটা কথা মনে রেখ প্রথম বিশ্বটাও তৃতীয় ও দ্বিতীয় এর ধাপ পাড়ি দিয়ে প্রথম হয়েছে। হয়তো আমরা তাদের তুলনায় পিছিয়ে তবে আপনজনদের অনুভবে আমরা তাদের চেয়েও উন্নত বহুগুণ।’

‘বাপি তোমার সাথে যখনই কথা হয় একপ্রকার ঝগড়া হয়ে যায় না চাইতেও। বাড়িটার বিষয়ে কী ভাবলে?’

‘ভাবার কী আছে যেমন আছে তেমনই থাকবে। আচ্ছা তোমার এই জীর্ণ বাড়িটার দিকে ঝোঁক কেন। তুমি চাইলে এর চাইতে অনেক বেশি কিছু করতে পার।’

‘পারি তবে এটায় আমার শৈশব জড়ানো আর আমাদের একটা ভালো সময় কেটেছে। তাই চাইছিলাম পুরানোটাকে নতুন করে গড়ে নেই। তাছাড়া বাড়ি ভাড়া দিলে তোমার রোজগারের একটা পথও বের হয়ে আসবে তখন প্রতিমাসে আর পেনশন অথবা আমার পাঠানো অর্থের উপর ভরসা করা লাগবে না।’

‘দেখ বাবা এই বাড়িটা শুধু একটা বাড়িই না, আমার কাছে একটা সম্পদ। এখানে রয়েছে আমার পূর্ব পুরুষের স্মৃতি। বাড়ির প্রতিটি স্তরে যেন তোমার মায়ের একটা স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। আজ তুমি বহুদূর চাইলেই তোমাকে দেখতে পারি না, শুনতে পারি না কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় সেই ছোট্ট রাজীব এখনি দরজার ফাঁক দিয়ে এসে আমাকে ভয় দেখাবে। সিঁড়ির উপর এক ঝাপটায় দৌঁড়ে যাবে আমি তোমার পড়ে যাওয়ার ভয় পাব। এমন অনেকগুলো অনুভূতি রয়েছে যা আগলে আজও বেঁচে আছি। বাড়ি তো আর কিছু না একটা ইট পাথরের দেওয়ালে ঘেরা অবয়ব মাত্র কিন্তু এর মাঝে যুগ যুগের অনুভব, স্মৃতি আর পুরানো দিনের ছোঁয়াগুলোই বেঁচে থাকার উপকরণ। আমার কাছ থেকে এ স্মৃতিগুলো কেন ছিনিয়ে নিতে চাইছ। যতদিন বেঁচে আছি থাক না এটা আমার মতো। যেদিন থাকব না তখন না হয় গুড়িয়ে দিও তাতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন না হয় এগুলো আমার হয়ে থাকল মৃত্যুর পর তো আর একটা ধুলিকনাও সাথে নিয়ে যেতে পারব না। এ কী তুমি কাঁদছ মনে হয়?’

‘তোমার এমন কথা শুনলে কান্না কী আর না এসে পারে। কেন তুমি এভাবে বল বাপি আমার কী কষ্ট হয় না। তোমাকে ছাড়া আমার আর কে আছে আগলে রাখার।’

‘দেখ দেখি পাগল ছেলের কথা। আরে বোকা ছেলে যতই প্রথম বিশ্ব কর না কেন মনটা সেই তৃতীয় বিশ্বেই পড়ে আছে। বাস্তবিক হতে শিখিয়েছি তোমায় আর মানুষ এই পৃথিবীতে চিরস্থায়ী নয় একদিন চলে যেতেই হয়। দেখ না তোমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের জীবন কী থেমে গেছে? যায়নি। পৃথিবী বা তার নিয়ম কারো জন্য থেমে থাকবে না। একদিন আমিও চলে যাব তুমিও থেমে থাকবে না। গতিশীলতাই বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ।’

‘বাপি পরবর্তী ডিসেম্বরে আমার একটা ভেকেশন আছে। আমি তখন হয়তো দেশে আসব। তুমি কী আমার সাথে ফিরবে এখানে?’

‘কন্ডিশন দিচ্ছ?’

‘না কন্ডিশন নয়। এতদূরে থেকেও যেন মনটা স্থির করে থাকতে পারি না বাপি। সারাক্ষণ তোমার জন্য চিন্তা হয়। দেশে যখন ছিলাম তখন একে অপরে নিজেদের খেয়াল রাখতাম কিন্তু এখন তো আমরা বহুদূর।’

‘তোমার বাপি বাঁচতে জানে। তাই আমার জন্য দুশ্চিন্তা না করে নিজেকে গড়ে তোল। একটা কথা তোমাকে তো বলা হয়নি এখানে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটেছে।’

‘আরে বল কী! এই বয়সে বন্ধু বান্ধব। মানে উনারা কী সকলে তোমার বয়েসি?

‘হ্যাঁ, সব রিটায়ার পাবলিক’

‘বেশ...তোমাদের সময় তাহলে ভালোই কাটে।’

‘বলতে পার। সকাল সাতটায় জগিং, ডাব খাওয়া, হাসতে চেষ্টা করা তারপর নাশতা শেষে ক্যারাম বা দাবা খেলা ইত্যাদি সব আয়োজনে বয়ে যায় বেলা।’

‘যাক শুনে বেশ ভালো লাগছে। তোমার সময় কাটানোর মতো মানুষ এখন আছে।’

‘তোমার আসার খবরটা আমাকে প্রাণবন্ত করে দিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমায় একটাবার দেখি। সেই আগের মতো বাপ ছেলের হবে দাবায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। একসাথে ঘুরতে যাওয়া আর চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া। অনেক বেশি অনুভব করি সেই দিনগুলো।’

‘আর কয়েকমাস অপেক্ষা কর তারপর চলে আসছি কিছুদিনের জন্য। আমার একটা কাজে বের হতে হবে ফোনটা রাখব এখন। তুমি ভালো থাক বাপি। নিজের খেয়াল রেখ আর একটা কথা দূরে আছি এবং মাঝেমধ্যে কল দেই না বলে ভেব না ভুলে গেছি। তুমি আমার বাবা নও আমার অস্তিত্ব তাই তোমাকে ছাড়া আমার সবকিছুই শূন্য। কখনো এমন করে ভাববে না।’

‘তুমিও নিজের দিকে খেয়াল রেখ, খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে করবে। ভালো থেক।’

মনের একটা ব্যকুলতা ছিল তা এখন আর নেই। ছেলেটার সাথে কথা বলে যেন সকল দ্বিধাগুলো মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। সন্তানের প্রতি টান, মোহ একেই বলে আর থাকবে না কেন নিজেরই তো অংশ। একই ডিএনএ থেকে সৃষ্ট যাকে আমরা সন্তান বলি। অনেক হালকা লাগছে মনটা। বুঝতে পারি দূরত্ব যতই হোক তার বাপির প্রতি মোহ আজও কাটেনি। কাটবেই বা কীভাবে, ছোট্টবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। শুধু বাবা না থেকে বন্ধুর মতো একসাথে চলেছি, আদর আর আবদারের জায়গাটাকে নিজের কাছে রেখেছি। কয়েক মাস পর ছেলেটা আসবে শুনে কেমন যেন আলাদাই একটা অনুভূতি কাজ করছে। মনে হচ্ছে সেই দিনটা হবে একটা উৎসব।

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়