শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২৬

সামান্য অপরাধে শিশুদের প্রতি নির্যাতন চলে

রায়পুরে অনুমোদনবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি : কর্তৃপক্ষের নেই কোনো তদারকি

তাবারক হোসেন আজাদ, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর)
রায়পুরে অনুমোদনবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি : কর্তৃপক্ষের নেই কোনো তদারকি

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে যেখানে-সেখানে এবং বিভিন্ন ভবন ভাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কেজি স্কুল এবং মাদ্রাসা। বোর্ডের অনুমোদনবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে প্লে থেকে পঞ্চম, ৮ম, নবম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের (প্রায় ১০০টির মতো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসাগুলো) কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু তারা সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠ্যবইসহ অন্য সুবিধা নেন বলেও জানা যায়।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) শহরে রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের এক নারী শিক্ষক দ্বারা ৬ষ্ঠ শ্রেণীর দুই ছাত্রের চুল ছোট না করায় ব্লেড দিয়ে চুল কেটে দিতে গিয়ে মাথায় আঘাতের ঘটনা ঘটলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।।

এছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১০০-২০০ গজের মধ্যে ২০টি বেসরকারি স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি স্কুল থেকে কৌশলে শিক্ষার্থীদের ভাগিয়ে বেসরকারি স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে সচেতন অভিভাবকদের অভিযোগ, যা সম্পূর্ণ অনিয়ম।

জানা গেছে, উপজেলায় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৫টি এবং কেজি স্কুল ৯০টি। তার মধ্যে অনেকগুলোয় মাধ্যমিক শাখা চালু রয়েছে। হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসা রয়েছে ৪০০-এর মতো। রায়পুর শহরের অলিগলি বা পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। এছাড়াও এমপিও হওয়ার আশায় কয়েকজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায়ও মেঘনার চরাঞ্চলে বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠছে। একটি কক্ষ বা একটি খুপড়ি ঘরে চলছে ‘কেজি’ নামে কথিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দু-তিনটি কক্ষে ছোট ছোট খুপড়ি বানিয়ে চলছে এসব স্কুল। আবার কোথাও একটি কক্ষেই পরিচালিত হচ্ছে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। গাদাগাদি করে পাশাপাশি টেবিলে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির। আলো-বাতাসহীন ফ্ল্যাটে দিনের বেলায়ও আলো জ্বালিয়ে স্কুল চালানো হচ্ছে। এসব স্কুলে সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক নামে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন রয়েছে। কোনো ক্লাসেই ঠিকমতো পাঠদান হয় না বলে অভিযোগ উঠে। প্রতিবছর প্রায় ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা করে সেশন ফিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার নামে ইচ্ছামতো ফি আদায়, শিশুদের হাতে বইয়ের বোঝা দেওয়াসহ অযোগ্য শিক্ষক দিয়ে চলে এসব স্কুলের লেখাপড়া।

রায়পুর শহরে ১১তলা বিশিষ্ট গাজি কমপ্লেক্স ভবনে রেসিডেন্ডিয়াল নামে একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, অস্বস্তিকর পরিবেশ। যেখানে প্রতিটি কক্ষ বেহাল। বড়ো বড়ো গর্ত। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে (২৫ সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক ৬ষ্ঠ শ্রেণীর দুই ছাত্রের চুল ছোট না করায় ব্লেড দিয়ে চুল কেটে দিতে গিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে কিছু রক্তক্ষরণও হয়েছে। প্রতিটি কক্ষে ঘুরে দেখা যায়, স্কুল পর্যায়ের কার্যক্রমই চালানো কষ্টকর। তবে প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠিত আল আমিন একাডেমি নামের স্কুলটি বাদ দিয়ে রেসেডেন্সিয়াল স্কুলের নামেই পরিচালনা করছি কয়েকজন। প্রতিষ্ঠানের মালিক গাজি কামাল পরবর্তীতে অন্যত্র স্থানান্তর করবেন।

উপজেলার চরকাচিয়া ন্যাশনাল নামে একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, অস্বস্তিকর ও গিজগিজে পরিবেশ। যেখানে স্থান সংকটের কারণে স্কুল পর্যায়ের কার্যক্রমই চালানো কষ্টকর, সেখানে চালানো হচ্ছে কলেজও। তবে অধ্যক্ষ মো. সেলিম দাবি করেন, আপাতত এখানে তারা উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে অন্যত্র স্থানান্তর করবেন প্রতিষ্ঠান।

পৌর শহরের সরকারি স্কুলের ভেতরে গড়ে ওঠা মার্চ্চেন্টস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অপেক্ষারত অভিভাবক শারমিন আলম ও মাসুদ জামান জানান, বাসায় সারাদিন চার দেওয়ালে বন্দি থাকে তাদের সন্তানরা।

এ বিষয়ে রায়পুর উপজেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জিয়া উল্লাহ জানান, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে খেলার ছলে পড়ালেখা করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বর্তমানে এসব স্কুল মুরগির খামারে পরিণত হয়েছে। ইচ্ছেমতো সিলেবাস তৈরি, বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় প্রতিনিয়ত রায়পুরে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাদ্রাসার কথা না-ই বললাম। তাদের অবস্থা আরও করুন। যেন দেখার কেউ নাই।

রায়পুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মঈনুল ইসলাম বলেন, এসব বেসরকারি স্কুলের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। লক্ষ্মীপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্র মিত্র জানান, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ জেলায় রয়েছে প্রায় শতাধিক অনুমোদনহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারে প্রতি বছর ডিসেম্বরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। বেশ ক'টি দেউলিয়া হবার খবরও পাওয়া গেছে।

লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার জানান, জাতীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদনবিহীন কোনো স্কুল অথবা কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। জেলার টাস্কফোর্স কমিটি নিবন্ধনের জন্যে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়