শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ঢল

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৫, ০৯:২৯

স্মরণে মুস্তাফা জামান আব্বাসী

আবদুর রাজ্জাক
স্মরণে মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বাংলার গানের অঙ্গনে, সাহিত্যের আলোছায়ায়, গবেষণার গভীরতম প্রকোষ্ঠে যিনি আপন স্বাক্ষর রেখে গেছেন, সেই বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক, গবেষক, অধ্যাপক ও শিল্পী ড. মুস্তাফা জামান আব্বাসী ১০ মে ২০২৫, ঢাকার বনানীর একটি হাসপাতালে পরপারে পাড়ি জমালেন। তারই সাথে সাথে লোকসঙ্গীতের এক অবিনাশী দীপ্তি নিভে গেল।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন এক বিরল প্রতিভার অধিকারী। কিংবদন্তি লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের সন্তান হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলেÑযেখানে গান ছিল জীবন, আর গবেষণা ছিল সাধনার নামান্তর। তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর, কলকাতায়। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার ঢাকায় চলে আসে। এখানেই শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে তিনি একাধারে শিল্পী, পণ্ডিত ও চিন্তক হয়ে উঠেছিলেন।

শুধু কণ্ঠের শিল্পী ননÑতিনি ছিলেন এক অসাধারণ গবেষক, লেখক ও সাংস্কৃতিক দার্শনিক। তাঁর রচিত প্রায় অর্ধশত গ্রন্থে উঠে এসেছে বাংলা লোকসঙ্গীত, সুফিবাদ, নজরুল ও বাংলার সংস্কৃতির চিরায়ত সুরধারা। ভাওয়াইয়া বিষয়ক তাঁর দুই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে প্রায় ১২০০ গানÑযা উত্তর বাংলার মাটির ঘ্রাণ আর জীবনের যন্ত্রণার এক অপরিহার্য দলিল।

তাঁর কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো শুধু সংগীত নয়Ñছিল জীবন ও হৃদয়ের অনুবাদ। যেমনÑ

“আমি কোন্ ধারে যাই, গো মোর কলসি ফাটাইছে বাজান...”

“নিশি নাইরে ঘুম, গুন গুনায় মৌমাছি, ভাবনা করে মন”

“ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পিছে”

এই গানগুলো শুধু উচ্চারণ নয়, চেতনার গভীর স্তরকে নাড়া দেয়Ñআর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার লোকসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ।

তিনি সুফিবাদী কবি জালালউদ্দিন রুমি, নিফফারি ও সুলতান বাহুর কবিতা নিয়ে গবেষণা করেন অনুরাগ ও দর্শনচিন্তার আলোকে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে :

‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ : মানুষ ও শিল্পী’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম : ম্যান অ্যান্ড পোয়েট’, ‘সাগা অফ টাইম’, ‘পুড়িব একাকী’, ‘নজরুল : গানের মালা’ ইত্যাদি।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো ছিলেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীন আহমদ গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র’ থেকে লাভ করেন আজীবন সম্মাননা।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় প্রচারিত ‘আমার ঠিকানা’ ও ‘ভরা নদীর বাঁকে’ অনুষ্ঠান দুটি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছিল লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।

পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন এক অসামান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশের অংশ। পিতা আব্বাসউদ্দীন আহমদ, মাতা বেগম লুৎফুন্নেসা, বোন ফেরদৌসী রহমান ও ভাই মোস্তফা কামালÑএই পরিবার যেন নিজেই এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন বাংলার রেনেসাঁস মানব। একাধারে শিল্পী, চিন্তক, গবেষক ও এক জাতিগর্ব। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা হারালাম এক চিরজাগরুক চেতনার আলো।

মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

তিনি যেন তাঁর প্রিয় গানগুলোর সুরে, আত্মার আবেগেÑচিরজাগরুক থাকেন বাংলার হৃৎপিণ্ডে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়