সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৪

কবি নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা ও সাম্যবাদ

উজ্জ্বল হোসাইন
কবি নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা ও সাম্যবাদ

কাজী নজরুল ইসলাম--বাংলার বিদ্রোহী কবি, সাহিত্যিক এবং সংগীতজ্ঞ, বাংলা সাহিত্যে সাম্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম প্রধান প্রতীক। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের প্রতিটি স্তরে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে সাম্য, মানবতা এবং বিপ্লবের ধ্বনি। তাঁর কবিতা ও গানে সাম্যবাদের যে অনন্য প্রতিফলন দেখা যায়, তা তাঁকে সাম্যের কবি হিসেবে অভিধা দিয়েছে। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশব থেকেই তিনি দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বেড়ে উঠেন। এই কঠিন জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত করেছিলো। তিনি মক্তবের শিক্ষালাভের পাশাপাশি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন এবং পরে লেটো গানের দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন।

নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকে বিদ্রোহ ও সাম্যের চেতনা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়। তাঁর লেখনীতে বারবার উঠে এসেছে শোষিত, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কণ্ঠস্বর। ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা' বিদ্রোহী কাব্যের এক চমৎকার নিদর্শন, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

নজরুলের কাছে সাম্য মানে শুধু অর্থনৈতিক সাম্য নয়। এটি ছিলো মানুষের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি, এবং শ্রেণিভেদে সম্পূর্ণ সমান অধিকারের কথা। তিনি বিশ্বাস করতেন, শোষণমুক্ত এক পৃথিবী গড়ার জন্যে সাম্যের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর কাব্যে, প্রবন্ধে এবং গানে সাম্যের চেতনা বারবার দেখা যায় ।

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় তিনি ঘোষণা করেন,

আমি চির বিদ্রোহী বীর—

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!

এই কবিতায় তিনি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিদ্রোহের কথা বলেননি, বরং সমাজে শোষণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিলো শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে এবং নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তাঁর কবিতাগুলোতে সাম্যের বাণী স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। তাঁর কবিতা কখনো বিদ্রোহী, কখনো প্রেমময়, আবার কখনো করুণাভরা মানবিক অনুভূতির কথা বলে।

'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতায় তিনি জগৎ-সংসারের সকল অশান্তি, অশোভন ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। সেখানে তিনি আহ্বান জানান,

দুর্বল, ধ্বস্ত, ক্লান্ত, ক্ষান্ত, কাঁদিছে মানব-সন্তান,

হে কাণ্ডারী, জাগো এবার জাগো!

নজরুল ইসলামের গানগুলোতে সাম্যের চেতনা একইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত তাঁর ইসলামি সংগীত এবং শ্যামাসংগীতে ধর্ম-বর্ণের বিভাজনহীন একতার সুর শোনা যায়। তিনি লিখেছেন,

মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই

যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।

তাঁর ইসলামি গান যেমন মানুষের সাম্য ও একতার কথা বলে, তেমনি শ্যামাসংগীতও ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের দীক্ষা দেয়।

নজরুলের প্রবন্ধগুলোতেও সাম্যের ভাবনা গভীরভাবে নিহিত। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ 'ধর্ম ও মানবতা'তে তিনি ধর্মের নামে বিভেদের বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, ধর্মের আসল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন,

ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, ঘৃণা করতে নয়।

নজরুলের সাম্যবাদ ছিলো গভীরভাবে মানবিক এবং সর্বজনীন। তিনি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সমাজ বা সম্প্রদায়ের জন্যে সাম্যের কথা বলেননি, বরং সমগ্র মানবজাতির মুক্তি চেয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে বারবার উঠে এসেছে নারীর অধিকারের কথা, যা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই ব্যতিক্রমী ছিলো। তিনি লিখেছেন,

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

নজরুল এখানে নারী ও পুরুষের সমান অবদানের কথা বলেছেন, যা সমাজে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় অবস্থান।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের কবি হিসেবে অমর হয়ে আছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম মানুষকে দারিদ্র্য, শোষণ এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করে। নজরুলের রচনা শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, এটি একটি আন্দোলন, একটি বিপ্লব। তাঁর কাব্য, গান, প্রবন্ধে যে সাম্যের বাণী তিনি প্রচার করেছেন, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। নজরুল ইসলামের সাম্যবাদ কেবল রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না, এটি ছিল একটি দর্শন। তাঁর রচনাবলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবজাতির প্রকৃত মুক্তি কেবল সাম্যের মাধ্যমেই সম্ভব।

কাজী নজরুল ইসলাম আজও আমাদের মাঝে এক চিরজাগ্রত সাম্যের প্রতীক হয়ে আছেন। নজরুলের সাহিত্যকর্মে সাম্য ও বিদ্রোহের চেতনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি শাসনব্যবস্থা, সামাজিক অবিচার এবং ধর্মের নামে বিভেদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর লেখা বিদ্রোহী কবিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যা বিদ্রোহ ও সাম্যের এক অমোঘ বার্তা বহন করে--

আমি চির উন্নত শির

শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!

এই পংক্তিতে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। নজরুলের মতে, মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সাম্যের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব। তাঁর সাহিত্যে বারবার দেখা যায়, তিনি শাসকের দমননীতি এবং জাতি-ধর্মের বিভাজন নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ ধর্মের ক্ষেত্রেও এক নতুন পথ দেখায়। তিনি ইসলামের গান যেমন রচনা করেছেন, তেমনি হিন্দু শ্যামাসংগীতেও ছিলেন পারদর্শী। তাঁর জীবনী ও সাহিত্যকর্মে ধর্মীয় সাম্যের এই চিত্র স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন,

গাহি সাম্যের গান—

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

এই বার্তা ধর্মীয় সাম্যের চূড়ান্ত প্রতীক। তাঁর রচনায় আমরা দেখতে পাই, তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভেদ দূর করে এক মানবিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ধর্মকে তিনি মানুষের হৃদয়ের পূজা হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, যা ভেদাভেদ নয়, বরং ঐক্যের পথ দেখায়।

শোষণ ও শ্রেণি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে নজরুলের

কবিতা ও প্রবন্ধে শ্রেণি-সংগ্রামের চিত্র অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তিনি ছিলেন দারিদ্র্য ও শোষণের বিরুদ্ধে একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। তাঁর 'দুর্দিনের যাত্রী' কাব্যগ্রন্থ এবং 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতা এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

নজরুল শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে ধ্বংস করে একটি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নজরুলের সাম্যবাদ শুধু অর্থনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি নারীর অধিকার এবং মর্যাদার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। এক সময় যখন নারীর সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত নিচে ছিলো, তখন নজরুল নারীকে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

'গৃহিণী গৃহের শ্রী

গৃহের আলো, জীবনের আশা।'

এই পংক্তিতে নজরুল নারীকে ঘরের শোভা এবং মানব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

নজরুল দারিদ্র্যের যন্ত্রণা নিজে অনুভব করেছিলেন। তাই তাঁর সাহিত্যে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ দেখা যায়।

নজরুলের সাম্যবাদ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আধুনিক সমাজে যেখানে এখনও বৈষম্য, শোষণ এবং বিভেদ রয়ে গেছে, সেখানে তাঁর রচনাগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর সাহিত্য শুধু বাংলার নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যে এক মূল্যবান সম্পদ। নজরুল ইসলাম নিছক একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সাম্যবাদী, বিপ্লবী, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর বিদ্রোহী সুর, প্রেমময় দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক বোধ আমাদের আজও আলোড়িত করে। তাঁর জীবনের মাধ্যমে এবং সাহিত্যে সাম্যের যে চেতনা জাগ্রত করেছেন, তা চিরকাল অম্লান থাকবে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলা যায়, নজরুল কেবল বাংলার নয়, সারা বিশ্বের সাম্যের কবি। তথ্য ঋণ : উইকিপিডিয়া।

লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও সংগঠক, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়