মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৬

দ্যুতিময় মাইন্ড সেট

বিমল কান্তি দাশ
দ্যুতিময় মাইন্ড সেট

মানুষ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই কৌতূহলী। কৌতূহল থেকেই হয়েছে সমাজবদ্ধ জীব। এ থেকেই পেয়েছে সংবেদনশীলতা। এসবই মানব সভ্যতার অলংকার। যা অবশ্যই মানব জাতির অহংকারও বটে। ইউটিউবের বর্ণনানুযায়ী, আজ থেকে ২৪ লাখ বছর আগে সর্বপ্রথম ‘হোমো হাবিলিস’ নামক এক প্রকার হাতিয়ার সম্বলিত সোজাসুজি হাঁটার প্রাণী আফ্রিকায় প্রথম দেখা গিয়েছিলো। এরাই বিবর্তনে ‘হোমোইরেকটাস’ থেকে ‘হোমোসেপিয়েন্স’ হয়ে একক অবয়াবক মানুষ রূপে মেরু অঞ্চলের প্রচণ্ড হিমবাহ-মরু অঞ্চলের তাপদাহ সহনীয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হয়ে ভূমণ্ডলের প্রত্যেক স্পিয়ারে বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে প্রায় ৮০২ কোটি জনগোষ্ঠীতে আবর্তিত হচ্ছে।

বিশ্বের আদি দিগম্বর জনগোষ্ঠীর বাস্তব ধারণা ও উদ্ভাবনের শক্তিতে সৃষ্টির নীরব স্থাপত্যই আজকের ডিজিটাল যুগের ‘গরৎধপষব ড়ভ সড়ফবৎহ ধফাবহঃঁৎব’ বিশ্বকে দৃশ্যমান আধুনিক রূপে সজ্জিত করেছে। সামাজিক গতানুগতিক ধর্ম এবং নিখাদ মানবতাবাদী ধর্মই খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মানব সমাজে বহুল প্রচলিত ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে যখন মানুষ লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করলো, তখন থেকেই বর্তমান প্রচলিত ধর্মগুলো প্রাধান্য পেয়েছিলো এবং চলমান আছে। জগতের সকল প্রাণীজ শিশুই মাতৃ প্রেরণায় তার জীবন ধারণের শৈল্পিক ধরণগুলো অর্জন করে ফেলে। কিন্তু মানব শিশু মাতৃক্রোড়ে যে নৈতিকতাবহুল শিক্ষাটা খেলার ছলে অর্জন করে নেয়, তাতে তার মস্তিষ্কের উর্বরতার ভিত্তি স্থাপিত হয়। এ সময়ের ব্যর্থতাই অসম্পূর্ণ জীবনের হাতছানি মাত্র। তারাই বাল্যকালে নৈতিকতায় বিকর্ষিত হয়ে যায় এবং তারুণ্যের অনৈতিকতায় দৃঢ়ভাবে আকৃষ্ট হয়ে তারুণ্যসুলভ অপরাধে জড়িয়ে যায়। ফলে উদ্ভ্রান্ত মানব সমাজ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। স্রষ্টার সমতাবাদী মানব সমাজ অনাসৃষ্টির দুর্ভেদ্য কবলে পড়ে যায়। মানব জাতির সভ্যতার প্রধান প্রাচীনতম নিয়ামকগুলো হলো ‘ইনকা থেকে অ্যাজটেক’, যা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সূচিত হয়েছিলো। রোমান থেকে পারস্যে আগত সভ্যতা- মায়া থেকে পারস্য হয়ে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন। এসব সভ্যতা শুধুই মানুষের জীবনালেখ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং উন্নয়ন প্রযুক্তির বিকাশের এক অনন্য মানচিত্র। যেগুলো মানুষের জন্যে সমৃদ্ধ বাসস্থান-নিষ্কন্টক সমতাবাদিত্ব মানব সমাজ কাঠামোর সূত্রপাতকে নির্দেশ করে।

আজ থেকে সেই সুদূর অতীত ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অভিব্যক্তিগুলো শুধুই গল্প নয়, বরং মানব জাতির সৃজনশীলতার সম্যক অনুভূতি, সহনশীলতা এবং সংবেদনশীলতার নিশ্চিত মন্দা বার্তার জানান দেয়। যা আমাদের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন ধর্মানুভূতির আড়ালে লুকানো এক শ্রেণির দ্বি-চারী ধার্মিকের অপকীর্তির কালো হাতে আজ আমরা আক্রান্ত হচ্ছি বহু অপঘাতে। বর্তমানে সুপ্ত ‘বাস্তব শিক্ষা’ এবং মানবীয় অপসংস্কৃতির বৃত্তাতিক্রান্ততা যেন মুক্তভাবে বিকশিত হয় তা-ই কাম্য। মানবিক অবয়বে এই ধরাধামে আগে আগমন যার, বৈষম্যমুক্ত নাগরিকত্বের অধিকারও রয়েছে তার। একটা সার্থক মানব জীবনের মূল লক্ষ্যই হলো মনুষ্যত্ব অর্জন করা। মানুষের চরিত্রে যে দুটি প্রক্ষিপ্ত বিষয় রয়েছে তা হলো, আবেগ আর বিবেকের তাড়না। আবেগের বশে মানুষ অতৃপ্তির শীর্ষে আরোহন করে অজ্ঞতাপ্রসূত হেন কু-কর্ম নেই যা তারা করে না। আবার বিবেকের তাড়নায় স্বীয় সাধ্যানুযায়ী অসামাজিক অপকর্মকে রুখে দেয়।

আজ যারা মানব সমাজের শিষ্ঠাচারিতা-ক্ষমাশীলতাএবং মানবীয় কর্তব্যপরায়ণতাকে কটাক্ষ করেছে, তার প্রতিফলনে বাংলাদেশটি অদূর ভবিষ্যতে মনুষ্যত্বের নিদারুণ আকালে পতিত হতে পারে এবং যার বিক্ষেপণ সার্বিক মন্বন্তরকে হাতছানি দিতে পারে। চলমান গতানুগতিকতাকে পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারিতাবহুল কর্মকাণ্ডের নির্মম পরিণতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে যায়। তবে এজন্য দেশ-জাতি-এবং সমাজকে কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। পক্ষান্তরে দলকানা এবং বায়াসড্ সাংবাদিকতার অপতথ্য-প্রাচুর্য এদেশে নতুন নয়। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর অবশেষে চকচকে স্বর্ণটাই চিহ্নিত হয়েছে। জাতির অন্তরে পেপটিক আলচার হয়ে যাওয়া ক্ষত গুলো হলো : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর অভূতপূর্ব গণআন্দোলন, ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, ৭৫-এর কিলিং মিশন, ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর পাশব বিতাড়ন মিশন, ২০২৪ সালের স্বৈরাচার সরকারের পলায়নের পর পরিণতিতে নির্মম অবস্থায় নির্বাসিত হয়েছিলো।

হে মৃন্ময়ী সর্বংসহা দেশ মাতৃকা! ধন্য তোমার পরিমিতি বোধ আর সংযম মিশ্রিত দূরদর্শিতার বাতাবরণে গঠিত সুদৃঢ় মননশীলতা। যা তুমি অতিসযতনে অনাদিকাল থেকে লালন করে আসতেছ। যার অনিবার্য খেদোক্তি মধ্যযুগীয় কবি আব্দুল হাকিম রচিত পংক্তিগুলো “বঙ্গেতে জন্মে যে জন হিংসে বঙ্গ বাণী; সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” বিশ্ব কবির “সাড়ে সাত কোটি সন্তানেরে; হে মুগ্ধ জননী! রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি।” সমস্বরে বিপ্লবী কবির পংক্তিগুলো : “অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ।” আবার ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে মহাকবি আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন : “হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ”......... ইত্যাদি। আবার ভার্সাই নগরীতে বসে জন্মভূমি স্মৃতিতে আবেগাপ্লুত হয়ে কপোতাক্ষ নদকে অন্তর্দৃষ্টিতে দেখে রচিত পংক্তিগুলো : “সতত হে নদ! তুমি পড় মোর মনে; সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে, সতত যেমতি লোকে (নিশার স্বপনে) শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কল-কলে”--ইত্যাদি।

এ যুগের জল-স্থল-অন্তরীক্ষ প্রাকৃতিক নিয়মেই যেন খনিজ মৌলের মত আকরিক (অপদ্রব্য) দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিন্তু মানব হৃদয়ের নিখাদ দেশপ্রেমের নিরেট অভিব্যক্তি এবং নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটিয়ে দেয়, নেতৃত্বে দ্বি-চারিতা এবং বাক্ স্বাধীনতা হরণের অপপ্রয়াস। যা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে চির নিন্দিতই থাকবে। পক্ষান্তরে একজন সুশাসকের অধীনে শাসিতরা অবশ্যই সুনাগরিকত্ব বোধের অধিকারী হবে। কিন্তু আজ কেন যেন সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছায়াছবিটির কথা বার বার মনে পড়ছে, যাতে উপপাদ্য জিনিসটি মনে পড়ছে : যে রাজার সব অত্যাচার-অনাচার ভুলে গিয়ে মানুষ যেন তার গুণাগুণেই ব্যস্ত থাকে। আর সত্যবাদী-স্পষ্ট বক্তা যেন তার রাজ্যে না থাকে আর মানুষ যত বেশি জানবে, তত কম মানবে। আর এজন্যেই মুক্ত বাক্ স্বাধীনতা যুক্ত দেশই হলো নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র। তবে হীনমন্য শাসিতের জন্যেই দুরাচারী শাসক নিযুক্ত হওয়াই প্রাকৃতিক নিয়মের ধারাবাহিকতা। এ মুহূর্তে নিপাত যাক দেশের যত অলস মস্তিষ্কের কুপ্রভাব আর বিকশিত হোক দ্যুতিময় মাইন্ড সেট।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ (জেএন) উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়