প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৯:১২
শিক্ষকদের পেনশন তহবিল থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা লোপাট!
মানবেতর জীবন যাপন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেনশন তহবিল থেকে ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) এক বৈঠকে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এ ঘটনায় শিক্ষক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বহু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে পেনশনের টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের করুণ দশা: ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও পেনশন নেই
অসংখ্য শিক্ষক তিন বছর পেরিয়ে গেলেও পেনশনের টাকা পাননি। সরকারি আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও অর্থ না পাওয়ায় অনেকেই চরম দুঃস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার শরীরে তৃতীয়বারের মতো ক্যান্সার ধরা পড়েছে, কিন্তু পেনশনের টাকা না পাওয়ায় তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ঢাকা ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ-এর সম্পাদকীয় কলামে তার পেনশনের টাকা পাওয়ার বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। পাশাপাশি, জেলা প্রশাসনকেও এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য! কেউই তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি, আর সরকারও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সরকার জানলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই!
সোমবার (৩ মার্চ) রাজধানীর এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "শিক্ষকদের পেনশন তহবিল থেকে ৭-৮ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এত বড় দুর্নীতির ঘটনায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।"
শিক্ষাবিদদের মতে, এই ঘটনা সরকারের আর্থিক অব্যবস্থাপনারই নগ্ন চিত্র। একজন প্রবীণ শিক্ষক তার সারাজীবনের পরিশ্রমের বিনিময়ে যে অর্থ পাওয়ার কথা, তা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। অথচ সরকার নির্বিকার!
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বন্ধ, শিক্ষা খাতে বিপর্যয়
শিক্ষা উপদেষ্টা জানিয়েছেন, দুর্নীতির কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৯টি প্রকল্পে এক টাকাও খরচ হয়নি, আর ১২১টি প্রকল্পে এক শতাংশও কাজ হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৫০ শতাংশ এবং বিদেশি ঋণের বরাদ্দ কমেছে ৮১ হাজার কোটি টাকা।
এই অব্যবস্থাপনা শিক্ষাখাতে দীর্ঘমেয়াদী সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষকদের আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
এ ঘটনায় দেশের শিক্ষক সমাজে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। শিক্ষক নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, "যদি শিক্ষকদের পেনশনের অর্থ ফেরত না দেওয়া হয় এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে দেশব্যাপী বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যদি না খেয়ে কষ্ট করেন, তাহলে বর্তমান শিক্ষকরাও রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।"
বিশেষজ্ঞদের মতামত
শিক্ষাবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, "সরকারি তহবিলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা হলে এই ধরনের দুর্নীতি আরও বাড়বে। শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য দ্রুত তদন্ত ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করা জরুরি।"
সরকার কি করবে?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, নাকি শিক্ষকদের পেনশনের টাকা লুটপাটের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে? এ ঘটনায় এখনো কোনো উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
শিক্ষক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের দাবি—অবিলম্বে এই দুর্নীতির স্বচ্ছ তদন্ত হোক এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অন্যথায়, শিক্ষকদের পেনশন তহবিল লুটের দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।
ডিসিকে/এমজেডএইচ