শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২১, ০০:০০

আমাদের সহপাঠী নিমাই
অনলাইন ডেস্ক

নির্মলেন্দু বিশ্বাস। আমরা ওকে নিমাই বলে ডাকি। আমরা মানে সহপাঠীরা। সেই ৪২/৪৩ বছর আগে কোনো স্নিগ্ধ এক সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম এই নিমাইকে। মায়াবী চোখে তখনো ওর মুখের লজ্জার ঘোর কাটেনি। বাংলা বিভাগের করিডোরে সকলের মধ্যে নিমাই আলাদা।

চলাফেরা, ভাব-ভঙ্গি, আচার- ব্যবহারে নিমাই কখনোই সরব নয় নিরব-নিশ্চুপ। চোখের কোণে আর মুখের ভাষায় তার স্মিত সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখখানি প্রথম যেদিন যেভাবে আমার দেহমনে পল্লবিত ছিলো এখনো সেভাবেই তার রেশ আমার দেহমনে পল্লবিত হয়ে আছে।

ক্লাসে আসে ক্লাস শেষে চলে যায়। সবাই সরব হলেও নিমাই ক্লাসে সরব নয়। শব্দের ভেতর নিমাই শব্দহীন। গল্প আড্ডার অলংকার হলেও সে জমিয়ে গল্প করে না। সে শুনে। আড্ডা-আসরে সে

বক্তা নয় শ্রোতা। ঠাট্টা হাসির আসরে নিমাই মৃদু হাসে। হাসি দিয়েই নিমাই জয় করতো বন্ধু, বন্ধুদের ভালোবাসা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, করিডোর, সেমিনার, মল, সবুজাভ চত্বর, কেন্টিন, টিএসসি, জগন্নাথ হল সকল জায়গায় নিমাই স্থির, কোথাও বেপরোয়া নয়। প্রতি পদক্ষেপে ওর ছিলো মননশীল হৃদয়ের অভিজাত বোধবুদ্ধি। ভেতরের অসহিষ্ণু আবেগ ওকে তাড়িত করলেও প্রকাশে ছিলো সহজ ভঙ্গির সারল্যবোধ। না পাবার বেদনা, বঞ্চনার বেদনা ওকে কুরে কুরে খেলেও নির্বিবাদী মনে ‘ও’ ছিলো ধীরগতিতে মানিয়ে নেওয়া এক ধৈর্যশীল মানুষ। সহপাঠী বন্ধুদের হৃদয় নিঙরানো ভালোবাসা আমাকে যে অহঙবোধ আর যে ঐশ্বর্য দিয়েছে হিস্যাদারী ভালোবাসায় সকলের মতো নিমাই’র ভালোবাসাও আমাকে পূর্ণ করেছে অকৃপণভাবে। আজ নিমাই নেই। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ১৯ মার্চ ২০২১-এ আমাদের মায়া, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে নিমাই চলে গেছে অদৃশ্যলোকে-যেখান থেকে কেউ কোনদিন আর ফিরবে না। কত কথা, ভোলা না ভোলা কত স্মৃতি মনের আঙিনায় ভীড় করে আছে।

নিমাই বলতো তোর সব লেখা আমি পড়ি, বন্ধু তুই খুব ভালো লিখিস্। কথাচ্ছলে বললেও নিজের মধ্যে আত্মতৃপ্তির উচ্ছ্বাস আমাকে আমার মনকে উদ্দীপ্ত করতো, শিহরিত করতো, আলোড়িত করতো এক অভাবনীয় দ্বৈরথ জয়ের দ্বারপ্রান্তে যেতে! হিমালয়ের সুউচ্চ পাহাড় ছুঁয়ে দেখার বিলাসময় স্বপ্ন নিমাই-ই আমাকে দেখিয়েছিলো। দেখিয়েছিলো সমুদ্র-মহাসমুদ্রের তলদেশের অনতিক্রম্য রহস্যময়তা ভেদ করার স্বপ্নও। ১৯৮৫-এর কোনো একমাসে বাংলা বিভাগ ’৮২ ব্যাচ মাস্টার্সের রেজাল্ট বেব হবার পর আমরা একে অপর থেকে ছিটকে গেলাম জীবন সাজাবার জীবনযুদ্ধে।

দেশে তখন স্বৈরশাসন। চাকুরির ক্ষেত্রে এমবার্গো। কোনো ক্ষেত্রে এমবার্গো ওঠিয়ে দিলে সকলে সেখানেই চাকুরির জন্যে দরখাস্ত করে। অনেকেই মাস্টার্স এপিয়ারড বলেও দরখাস্ত করে যাচ্ছে।

জগন্নাথ হল থেকে আমাদের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে যেতে পথের মাঝে এসএম হল পড়ে। বলতে গেলে পাশাপাশিই থাকি। মাঝে মধ্যে চোখের দেখা হলেও মনের দেখার কমতি নেই। নিমাই আমার মন জুড়েই থাকে সবসময়।

বেশ অনেকদিন পর জগন্নাথ হলে হঠাৎ একদিন নিমাই’র সাথে আমার দেখা। চিরায়ত স্বভাবের নিমাই যেনো নিমাইতে নেই। ৮৪-এর বিসিএস-এ বন্ধুদের অনেকেই প্রশাসন-ক্যাডার পেলেও নিমাই পেয়েছে আনসার-ক্যাডার। মন খারাপ! বিষণ্ণতা জেঁকে ধরলেও বিসিএস তো-! আমি বুঝালাম। বোঝ মানলো। সেই থেকে নিমাইতে আমি আরও জড়ালাম। ও আমাকে যেমন ছাড়েনি আমিও কখনো ওকে কখনো ছাড়িনি।

একবার আমার টিম নিয়ে আমি গেলাম বরিশাল আমার ব্যাংক পরিদর্শনে। ওর সাথে যোগাযোগ হলো। ও আমার রেস্টহাউজে এসে আমার টিমের সকলকে ওর বাংলোয় ডিনারে নিমন্ত্রণ করলো। আমি অবাক হলাম! অবাক হলো আমার টিমের অন্যান্য মেম্বাররা!

সে কী আয়োজন! আমি অভিভূত হলাম। তার মন ভিজানো আতিথেয়তার গল্প জনতা ব্যাংকের সেই কলিগরা এখনো মনে রেখেছে। এখনো তারা আমার সেই বন্ধু নির্মলেন্দু বিশ্বাসের কথা বলে, নিমাই’র কথা বলে, আমার বন্ধু ভাগ্যের জৌলুশী স্মৃতিময়তার কথা বলে! নিমাই পোস্টিং পেয়ে যেখানেই যেতো। আমি সেখানেই যাওয়ার জন্যে অপ্রয়োজনে প্রয়োজন খুঁজতাম বার বার। এমনি তো আর দেখা হবে না। যদি কোন ছুতোনাতায় নিমাইর সাথে আবার আবার আমার দেখা হয়। আমার ছোট ছেলে রিশাদ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে চুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যে। চুয়েট ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা হলেও আমি সিদ্ধান্ত পাল্টে নিমাইর চট্টগ্রামের খুলশি এলাকার ফয়েজ লেকের সন্নিকটস্থ আনসার বাহিনীর সৌন্দর্য সৌকর্যে নির্মিত পাহাড়ঘেঁষা অরণ্যের কাছাকাছি এক বাংলোয় থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিমাই আমাকে বন্ধুর আর ভালোবাসার মর্যাদায় ওর বাংলোয় আমাকে থাকার সুযোগ করে দিলো। পরীক্ষার দিনে আমাদের যাতায়াতেরও ব্যবস্থা করে দিলো। ওর ভালোবাসা যেনো শুধু দেবার পাবার নয়। উল্লেখ্য, আমার ছেলে রিশাদ কিছু দিন আগে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে ইলেক্টিক এন্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং- এ। দিন যায়- যেতেই থাকে।

জীবন-জীবীকার প্রয়োজনে আমরা বন্ধুরা একটা সময় প্রায় বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিলাম। কারো কারো সাথে ফোন কিংবা বাস্তবে যোগাযোগ হলেও অনেকের সাথে সে যোগাযোগ একটা সময় পর্যন্ত বলতে গেলে ছিলোই না। বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ সময়ের সেই দুরত্ব কমা শুরু হলো যখন আমরা নিমাই এর নিবিষ্ট আতিথেয়তায় একদিন সফিপুর গেলাম।

৫ জানুয়ারি, ২০০৭। স্মৃতিময়তার এক অনন্য দিন! আমি বরাবরই বন্ধুপ্রিয় মানুষ! বন্ধুদের আড্ডা-আনন্দ আমার চৈতন্যে সকল প্রাপ্তির সেরা প্রাপ্তি। নিমাইকে ফোন করে একদিন সফিপুর আনসার ক্যাম্পে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে সানন্দে ‘ও’ সায় দিলো। সায় দিলো অনেক বন্ধু। বন্ধুদের সাথে কথা বলে দিনক্ষণ ঠিক করে ওকে জানালাম ৫ জানুয়ারি আমরা ওর ওখানে যাচ্ছি! ১৯৮৫তে মাস্টার্সের রেজাল্টের প্রায় বাইশ বছর পর সেই আড্ডায় একসময়ের কাছাকাছি বন্ধুরা পরস্পরকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো। পরস্পরকে জড়িয়ে আনন্দাশ্রু ঝরালো।

বগুড়া থেকে পারভীন এসে সফিপুরে আমাদের সাথে যোগ দিলো। সৈয়দ আল ফারুক এলো। লম্বা জলি এলো ইয়া বড়ো কেক, ফুল ও অন্যান্য নাস্তার বহর নিয়ে। জলির সাথে নিলুও এলো। নিলুর বর সরদার আরিফ উল্লাহ ভাই প্রিন্সিপাল, জিরাবো কলেজ, সাভার- সফিপুর থেকে ফেরার পথে আমাদেরকে যে আতিথেয়তা দেখালো সেটা জীবনেও ভোলার নয়।

রত্না, ইলা, বাদল, আওলাদ, সারা, রব, আমরা সকলেই ঢাকার সোবহানবাগে একত্র হয়ে সফিপুর আনসার ক্যাম্পে রওনা দিয়েছিলাম। সোবহানবাগের যে জায়গায় আমরা একত্রিত হলাম এখানেও যেন চিরচেনা বন্ধুদের বহুদিন পর দেখা পেয়ে পরস্পর ভালোবাসায় আপ্লুত হলো। এখানেও যেন এক আনন্দ বন্যা বয়ে গেল !

বন্ধু সোহরাব অল্প সময় নিয়ে সফিপুর এলেও তার উপস্থিতি আমাদের আবেগময় এ মিলনস্থলকে যেন পূর্ণতায় রূপ দিয়েছিলো।

সহপাঠী সকল বন্ধুর উপস্থিতি সম্ভব না হলেও ভালোবাসার সকল আবেগে সফিপুর আনসার একাডেমির মিলনমেলা ছিলো আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মনউজার করা বন্ধুদের স্মরণীয় এক অভূতপূর্ব মিলনমেলা! আর এই স্মরণীয় অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক আতিথ্য আপ্যায়নের সকল দায়িত্ব নিয়েছিলো আমাদের নিমাই। আজ নিমাই নেই! সকলের হৃদয় আজ ব্যথার ভারে বেদনার ভারে নিমজ্জিত! অব্যক্ত কষ্টে সকলের ভাঙা মনের সাথে আমার মনও একাকার! চাপা কষ্ট সকলের মনে আচ্ছন্ন!

নির্মোহ আবেগ আর প্রাণবন্ত ভালোবাসায় ক’দিন আগেও যে নিমাই ছায়াময় মায়াময় ছিলো, সেই নিমাই এখন স্বপ্নময় কুহেলিকা, নিকট-নৈকট্যের বেড়াজাল ছিন্ন করা দূর বহুদূরের হিরন্ময় সৌন্দর্যের স্বপ্নময় অধরা এক হাতছানি! স্নিগ্ধ কুয়াশা ভেজা সকালে, রৌদ্রময় দ্বিপ্রহরে, ঝড়ের তীব্র তান্ডবে, রাতের ঝলমলে নক্ষত্রের আলোকচ্ছটায় কিংবা বন্ধুদের আরাধ্য আড্ডায়- জানি নিমাই তুই আর কখনো আসবি না। তবে মিনতি করে বলি, তন্দ্রায় আসিস, স্বপ্নে আসিস, মনের জানলায় বার বার আসিস নিমাই, বন্ধু আমার! (চলবে)

(সদ্যপ্রয়াত হৃদয়বরেষু বন্ধু নির্মলেন্দু বিশ্বাস নিমাই স্মরণে)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়