প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২১, ০০:০০
কেমন দেশে বাস করছি আমরা। খবর শুনলেই রক্তচাপ বাড়ে। সেদিনের পত্রিকার দুটি শিরোনামে যাদের হাইপ্রেসার তাদের নিদেনপক্ষে রক্তচাপ ১০ বেড়ে যাবে নিচ এবং উপরের। পত্রিকার সংবাদ দুটি ছিল এমন ‘মাদক : মারাত্মক ধরনের ভেজাল’। আরেকটি ‘বাজারে ভেজাল, নিম্নমান ও নিষিদ্ধ ওষুধ!’ মাদকেও ভেজাল! ঔষধেও ভেজাল!! কোনোটাই সুখকর খবর নয়। ভাবা কি যায়, প্রাণ রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল! ঔষধে ভেজালের সংবাদ জনমনে শঙ্কা তৈরি করে। আর মাদকতো এমনিতেই আমাদের দৃষ্টিতে ভেজাল, কিন্তু তাতে ভেজাল হলে উপায় কি! উপরের সংবাদগুলো আমাদের অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলে বৈকি।
বাজার নাকি সয়লাব ভেজাল, নিম্নমান ও নিষিদ্ধ ওষুধে। কিছুতেই ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। একের পর এক ভেজাল ওষুধ ধরা পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। আর নিষিদ্ধ ও অপরীক্ষিত অনেক বিদেশী ওষুধ দেশে এনে নতুনভাবে প্যাকেটজাত করে তা বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ দূরের কথা, ওষুধ জ্ঞানসম্পন্ন অনেক ব্যক্তির পক্ষেও এসব ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রয়, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করেই দায়িত্ব শেষ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তাদের কোনো মনিটরিং কার্যক্রম নেই। দেশে বর্তমানে ১৫৪ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশই নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করে চলেছে। ওষুধের মান নির্ণয় করার জন্যে পর্যাপ্ত শক্তিশালী ল্যাব নেই। এতে চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে দেশের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা।
মাদকের কথা আর কী বলবো। আমরা জানি ধ্বংসের অপর নাম মাদক। তার ওপর সেই মাদক যদি হয় ভেজাল, তাহলে তো আর কথাই নেই। ভেজাল মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের বাজারগুলো। ভেজালের কারণে আরও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে মাদকও। আর এসব সেবনে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। মাদক সেবনে মেরুদ-হীন হয়ে পড়ছে যুবসমাজ। ভেজাল পরিহার করতে মাদকসেবীরা বারবার পরিবর্তন করছে মাদক। কিন্তু তাতেও ভেজাল পরিহার করতে পারছে না তারা। ফলে মাদকসেবীরা বিকল্প হিসেবে ঝুঁকে পড়ছে হেরোইন, ফেনসিডিলের দিকে। হেরোইন সেবনকারীরা দ্রুতই বিকল্প হিসেবে ইয়াবাকে বেছে নিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অতি লোভী একটি গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে মাদকে ভেজাল মেশাচ্ছে। দেশের মাদকসেবীদের একটি অংশ এখন ব্যাপক হারে ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ইয়াবা এমন একটি মাদক, যা মানুষকে শুধু মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না, মৃত্যুর আগেই ওই মাদক সেবনকারীকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। অথচ প্রাথমিকভাবে সেবনকারী বা তার আত্মীয়দের কেউ তা বুঝতেই পারেন না। দীর্ঘ দিন ইয়াবা সেবনকারী ব্যক্তি বাবা-মাকে শত্রু মনে করতে থাকে, এমনকি এক সময় নিজেকেই শত্রু ভাবতে শুরু করে। সে তখন শব্দ না হলেও শব্দ শুনতে পায় এবং কেউ উপস্থিত না থাকলেও কারো উপস্থিতি অনুভব করে। তার সামনে কোনো ছবি টাঙানো থাকলে সে মনে করে ওই ছবি তাকে হত্যা করবে। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না সে। এমনকি নিজেকেও না।
মাদকদ্রব্যে ভেজালের কারণে মাদকসেবীদের মধ্যে ভয়ঙ্কর সব পরিবর্তন ঘটছে। ভেজাল মাদক সেবন করায় নতুন নতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক আগে থেকে দেশে মাদকের প্রচলন থাকলেও মূলত আশির দশকে নারকোটিকস জাতীয় ড্রাগের অনুপ্রবেশের পর থেকে মাদক সমস্যা ব্যাপকতা লাভ করে। পরে নব্বইয়ের দশকে ফেনসিডিলে ভেজাল মেশানোতে এর গুণগত মান কমে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক ফেনসিডিলসেবী হেরোইনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ওই সময় দেশে শুরু হয় হেরোইনের রমরমা ব্যবসা। এরপর হেরোইনেও ভেজাল মেশানো হয়। দিন দিন কমতে থাকে হেরোইনের গুণগত মান। এসব ভেজাল মাদক সেবনে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয় সেবনকারীদের শরীরে, যা আগে কখনো হয়নি। ধীরে ধীরে মাদকসেবীরা কাছে টেনে নেয় আরেক মরণনেশা ইয়াবাকে। মাদকাসক্ত রোগীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, ধরণ ও প্রকৃতি দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা ভেজাল মাদক গ্রহণ করছে। ভেজাল মাদক গ্রহণের ফলে মাদকাসক্তরা হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে, শরীরে প্রচ- খিঁচুনি হচ্ছে, হাত-পাসহ বিভিন্ন স্থানে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ ছাড়া তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। বর্তমানে মাদক ও মাদকসেবীদের পরিবর্তন খুবই ভয়ঙ্কর দিকে যাচ্ছে। তাই সমাজ থেকে মাদক দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদক এবং ভেজাল মাদক মুক্ত করতে হবে দেশ।
আবারও ওষুধ প্রসঙ্গে আসা যাক। ভেজাল ওষধের ছড়াছড়ি গোটা দেশে। বেশি মফস্বল এলাকায়। কোভিড-১৯-এর কারণে ওষুধের ব্যবহার বাড়ায় নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির মাত্রা আরও বেড়েছে। ওষুধ বিক্রেতা ও গ্রহণকারীর অনেকেই নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর দেশের চারটি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ছ’টি ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রি, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করেছে এর আগে। এসব ওষুধ এখনও বাজারে মিলছে বলে দৈনিক জনকণ্ঠে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অ্যালকো ফার্মা লিমিটেডের লাইসেন্সভুক্ত দুটি ওষুধের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন স্থগিত করা হয়। সেগুলো হলো ‘ক্যাপসুল সেফক্স’ (অ্যামোক্সিলিন ২৫০ মিলিগ্রাম), এবং ‘সাসপেনশন টেমপিল’ (এসিটামিনোফেন)। মিরপুর শিল্পনগরীতে গড়ে ওঠা মেসার্স ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের লাইসেন্সভুক্ত ওষুধ ‘ক্যাপসুল ‘ডাইক্লোফেনাক টিআর’ (ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম বিপি) এবং দিনাজপুরের শেখ হাতিতে গড়ে ওঠা মেসার্স বেঙ্গল টেকনো ফার্মা লিমিটেডের লাইসেন্সভুক্ত ওষুধ ক্যাপসুল বিটি মক্স-৫০০ (অ্যামোক্সিসিলিন বিপি)-এর উৎপাদন, মজুদ, বিক্রি, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করা হয়েছে। আর নওগাঁর চকমুক্তারে গড়ে ওঠা মেসার্স নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের লাইসেন্সভুক্ত দুটি ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রয়, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো ‘ক্যাপসুল এন ডক্স’ (ডক্সিসাইক্লিনা এবং ক্যাপসুল টেট্রাসাইক্লিন (হাইড্রোক্লোরাইড)। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিষিদ্ধ ছয়টি ওষুধ এখনও রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের শিউলী ফার্মেসিতে পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ ছয়টি ওষুধের তিনটি। সেগুলো হলো ক্যাপসুল ডাইক্লোফেনাক টিআর, ক্যাপসুল টেট্রাসাইক্লিন ও ক্যাপসুল সেফক্স। পূর্ব রাজাবাজারের ৪টি ফার্মেসিতে ওই সব নিষিদ্ধ ওষুধ পাওয়া গেছে। কলাবাগান এলাকায় ঢাকা মেডিসিন ফার্মেসিতে ক্যাপসুল ডাইক্লোফেনাক টিআর এবং ক্যাপসুল বিটি মক্স-৫০০ পাওয়া গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে, ফার্মগেট ফুটওভারব্রিজের বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে। কলাবাগানের ৫টি ফার্মেসিতেও নিষিদ্ধ ওষুধগুলো পাওয়া গেছে।
বিগত বছর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দুটি দল অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ও নকল ওষুধ উদ্ধার করে। যে পরিমাণ ভেজাল ওষুধ বাজারে আছে তার এক আনাও উদ্ধার করতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এ সময় অভিযান চালানো হয় রাজধানীর মিটফোর্ড পাইকারি ওষুধ মার্কেটের আমির মার্কেট, ভূঁইয়া মার্কেট ও নায়না মার্কেটে। এভাবে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। মানবহির্ভূত ওষুধ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, পরিদফতর থেকে অধিদফতরে রূপ নেয়ার পরও গতিশীল হতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড ছাড়া কোনো কিছুতে পরিবর্তন আসেনি। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অভিযান সহায়ক যানবাহনের অবস্থাও আগের মতোই রয়ে গেছে। কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েও তারা ভেজাল ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে না। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। দেশে বর্তমানে ১৫৪ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশই নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করছে, করে চলেছে। অথচ ওই সব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না ওষুধ আদালত। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভেজাল ওষুধ বন্ধে দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকা ওষুধগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কার্য দক্ষতাও বাড়াতে হবে। দেশে আরও ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা দরকার। প্রতিটি ওষুধ কোম্পানির কাজ নিজস্ব উপায়ে মান নিয়ন্ত্রণ করা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দায়িত্ব খারাপ ওষুধ যেন বাজারে না আসে তা দেখা। আমাদের যত কোম্পানি আছে তার বিপরীতে আমাদের ন্যাশনাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি দুর্বল, জনবলের যে অভাব আছে তা বলতেই হয়। যে কোনো ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। আর এ জাতীয় ওষুধ তৈরি এবং বাজারজাত বন্ধ করা জরুরি।
এদিকে মাদকের ভেজাল আমাদের আরও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। প্রাণঘাতী ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, অ্যালকোহল ও হেরোইনের দখলে দেশের মাদকের বাজার। সর্বনাশা এ দ্রব্যগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেমন আসছে, তেমনিভাবে দেশেও সমানতালে ভেজাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন অপদ্রব্যের সংমিশ্রণে অলিগলিতে এগুলো তৈরি হচ্ছে। সেবনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখেই এতে ভেজাল মেশানো হয়। এগুলো দেখতেও প্রায় একই রকম, দামও কম। সহজলভ্যতার কারণে সেবনকারীও প্রচুর। বাস্তবে এগুলো আসলের চেয়েও ভয়ংকর। একই সঙ্গে মাদক ও ভেজাল দুই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে সেবনকারীরা। মাদকের বিষ এবং ভেজাল বিষের ভয়াল থাবা এক হয়ে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন।
মাদকদ্রব্য উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোর দেয়া তথ্যমতে, দেশে এখন অন্তত ২৫ ধরনের মাদক রয়েছে। এর মধ্যে এক সময় ফেনসিডিলই ছিল প্রধান। ইয়াবা আসার পর এর ব্যবহার কিছুটা কমেছে। দেশের মাদক সেবনকারীর বড় অংশই এখন ইয়াবায় আসক্ত। সহজলভ্য হওয়ায় গাঁজা সেবনকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশী মদের বাজারও রমরমা। হেরোইন অল্প পরিমাণে এলেও এর সেবনকারীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। দেশে বহুল প্রচলিত এ পাঁচ মাদকের বিষয়ে অনুসন্ধান চালালে। এতে মাদকের ভয়াল থাবার ভয়ংকর সব চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকেই নেশার থাবা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ভেজাল মেশানো মাদক মৃত্যু ও পঙ্গুত্বকেই ত্বরান্বিত করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসারও তেমন সুযোগ নেই। সব মিলে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আসলের চেয়েও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল মাদক। দেশের প্রচলিত মাদকের প্রায় সবই বিভিন্ন অপদ্রব্য দিয়ে ভেজালভাবে তৈরি হচ্ছে। যা খেয়ে প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার ফলে এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে চাহিদাও বাড়ছে। এ সুযোগে অলি-গলিতে রাস্তায় তৈরি এসব দ্রব্য মানুষ গ্রহণ করছে। এ অবস্থা বন্ধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে ইয়াবায়। বিশ্বের কোথাও ইয়াবার কোনো রেজিস্টার্ড ফর্মুলা নেই। ফলে যে যেভাবে খুশি সেভাবেই এটি তৈরি করছে। এটা এমফিটামিন জাতীয় ড্রাগ। তৈরির মূল উপাদান সিউডোফেড্রিন। রয়েছে ইফেড্রিনের ব্যবহারও। বিক্রিয়া ঘটিয়ে এই ট্যাবলেট তৈরি হয়। যা গ্রহণ করলে কিডনি, লিভার ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয় যৌন ক্ষমতা। বাড়ে রক্তচাপ ও হ্রাস পায় সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক কেজি সিউডোফেড্রিনের দাম মাত্র চার হাজার টাকা। এ পরিমাণ সিউডোফেড্রিন দিয়ে অন্তত এক লাখ ইয়াবা তৈরি করা যায়। যার মূল্য প্রায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। ফলে লোভে পড়ে অনেকেই এটি তৈরি করছেন। আর চাহিদা থাকায় তৈরি হচ্ছে প্রচুর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভেজাল ইয়াবা তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ প্যারাসিটামল, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, টেক্সটাইলের রং ব্যবহার হয়। এছাড়া পেইনকিলার, মসুরের ডাল, চক পাউডার, ট্যালকম পাউডার, গ্লুকোজ, বিশেষ ধরনের মোম কেমিক্যাল, ভ্যানিলা পাউডারও ব্যবহার হয়ে থাকে। অবস্থাটা এমন যে, ক্রেতাকে বোঝানো গেলেই হয় এটা ইয়াবা, তাহলেই বিক্রি হবে।
সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল অ্যালকোহল। দেশে ভেজাল মদ খেয়ে প্রায়শই মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আসল মদ অতিরিক্ত সেবনের ফলে প্রতিবন্ধী হওয়া, লিভার সিরোসিস, কর্মক্ষমতা হারানোসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সেখানে ভেজাল মেশানো মদ সেবন মানে মৃত্যু ডেকে আনা। মদ তৈরি হয় ইথাইল অ্যালকোহল বা রেক্টিফাইড স্পিরিট দিয়ে। এটি খাওয়া যায়। অবৈধগুলো মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে তৈরি। এগুলো খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রং, কেমিক্যাল, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন অপদ্রব্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেথিলেটেড স্পিরিট ১৫-১৬ মিলি লিটার, মানে বড় এক চামচ খেলে চোখ অন্ধ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। লিভার-কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়।
হেরোইন এখন অন্যতম ভয়ের কারণ। যা সেবনে লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত হতে পারে। দেশে উদ্ধার হওয়া এই হেরোইনেও পাওয়া গেছে মারাত্মক ভেজাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে যে হেরোইন পাওয়া যায় সেখানে ৩-৫ ভাগ হেরোইন থাকে। বাকিটা অপদ্রব্য থাকে। মূল হেরোইনের সঙ্গে তামাকজাত গুল ও চক পাউডার দিয়ে তৈরি হয়। এতে তা বহুগুণ লাভ। কারণ বর্ডার এলাকায় ২-৩ লাখ টাকা এর কেজি। যা ঢাকায় এলে ভেজাল মিশিয়ে ১০ লাখ টাকা হয়ে যায়। সেজন্যে তারা এতে ভেজাল মেশাচ্ছে। কোডিন ফসফেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে বেশিরভাগ ফেনসিডিল। আর এর বোতল, কর্ক চানখাঁরপুলেও বস্তায় বস্তায় পাওয়া যায়। ফেনসিডিল ভারতে ৩৭৫ টাকা আর ঢাকায় আড়াই হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। অবৈধ ব্যবসায়ীরা এ লোভ ছাড়তে পারে না। ১০টা ফেনসিডিল এনে কফের সিরাপ, ঘুমের ওষুধ, ব্যথার ওষুধ মিশিয়ে ২০-৩০টা বানায়। এতে ভেজালের কোনো শেষ নেই। এ মাদক সেবনে দেহের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
সব শেষে একটাই কথা, যে কোনো ভাবে দেশে ভেজাল মাদক, ভেজাল ঔষধ উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রশাসনকে ভেজাল রোধে সচেষ্ট হতে হবে। অবৈধ ভেজাল ঔষধ এবং মাদক বিক্রি বন্ধে সকল পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। তা না হলে অকাল মৃত্যুসহ মানব দেহের যে ক্ষতি হচ্ছে তা আমাদেও ভাবায় বৈকি।
সম্পাদক : নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম; চেয়ারম্যান : আল-রাফি হাসপাতাল লিঃ; প্রেসিডেন্ট : লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা ভিক্টরী। ৩০/৩১ বিসিআইসি ভবন (১৭ তলা), দিলকুশা বা/এ, ঢাকা-১০০০। মোবাইল : ০১৭১৩৩৩৪৬৪৮, [email protected]