প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া। বয়সে আমার বারো বছরের ছোট। আর শিক্ষাবর্ষে দশ বছরের জুনিয়র। আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ১৯৮০-এর ব্যাচ, আর তিনি ১৯৯০-এর ব্যাচ। তিনি আমার প্রিয় সহপাঠী শিবলীর ছোটভাইয়ের সাথে পড়তেন। এমনটি জেনেও আমি তাঁকে সতীর্থের অধিকারে 'তুমি' বলি না। কারণ, তিনি নানা কারণে আমার অতি আপন, অনেক প্রিয়।
২০০৮ সাল থেকে আমি চাঁদপুরের বিতর্ক আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ডাঃ পীযূষ শিক্ষাজীবনে ছিলেন একজন তুখোড় বিতার্কিক। পেশাগত কারণে ২০০৩ সাল থেকে তিনি চাঁদপুরে অবস্থান করছেন। তাঁর কর্মস্থল ছিলো গুয়াখোলার 'সূর্যের হাসি ক্লিনিক'। সেখানকার কর্মকর্তা ছিলেন আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ শাহেদ রিয়াজ। তাঁদের ক্লিনিক আমাদের পত্রিকা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের গ্রাহক ছিলো। চাঁদপুর কণ্ঠে ২০০৯ সালে শুরু হওয়া পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার সংবাদ প্রায়শই ছাপা হতো। এ সংবাদ মনোযোগ আকর্ষণ করে ডাঃ পীযূষের। তিনি শাহেদ রিয়াজকে তাঁর শিক্ষাজীবনে বিতর্ক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানালেন। শাহেদ রিয়াজ বলি বলি করে আমাকে বিষয়টি জানাতে কিছুটা দেরি করে ফেললেন। একদিন সুন্দর একটি পরিবেশে রিয়াজের সাথে আমার দেখা। তিনি বললেন, ''আপনি বিতর্ক নিয়ে এতো কাজ করছেন, আমাদের ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে তো কাজে লাগাতে পারেন। কেননা তিনি সাবেক বিতার্কিক ও বিতর্কবোদ্ধা--তাঁর সাথে বিভিন্ন আলাপচারিতায় আমার তা-ই মনে হলো।'' আমি বললাম, আরে এমন লোকই তো আমি খুঁজছি। তারপর একদিন ডাঃ পীযূষের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। কথা হলো বিতর্ক নিয়ে। তাঁকে আমাদের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিচারক এবং প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে জড়িয়ে ফেললাম। কোনো সম্মানী অর্থাৎ আর্থিক সংশ্লেষ ছাড়াই তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে বিতর্কের আপন মানুষ হিসেবে আন্তরিকভাবে কাজ করা শুরু করলেন। সভাপ্রধান, বিচারক হিসেবে তাঁর বক্তব্য এবং প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর দক্ষতা দেখে আমরা মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলাম। নিজের ঢোল তাঁর নিজেই পেটানোর অভ্যেস নেই বলে তাঁর বিশদ পরিচয় জানা হলো না।
চাঁদপুর কণ্ঠের পাক্ষিক ‘সাহিত্য পাতা’র বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক মিজানুর রহমান রানা। তিনি এই পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রথিতযশা লেখকদের সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করছিলেন। একদিন ডাঃ পীযূষেরটা পত্রস্থ হলো। এটি পড়ে তো আমি বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ন্যায় ‘ইউরেকা’ বলে উঠলাম। কারণ, ডাঃ পীযূষ আমার প্রিয় স্কুল চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের যে সাবেক ছাত্র, সেটি জানতে পারলাম। তাঁকে ফোন করে কিংবা সাহিত্য পাতার সাক্ষাৎকার পড়ার পর দেখা হওয়া মাত্রই বললাম, আরে পীযূষ দা! আপনি তো আমাদের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেনের পর আপনাকেই চাঁদপুরে তৃতীয় কলেজিয়েট হিসেবে খুঁজে পেলাম। সানন্দে বললাম, এটি বড্ড আনন্দের, অপরিমেয় আপনত্ব খুঁজে পাওয়ার উপাদান। তারপর তাঁর সাথে সতীর্থের অধিকারে আমার সম্পর্ক--আমি তাঁর বড়োভাই, আর তিনি আমার ছোটোভাই।
এই মধুর সম্পর্কহেতু ডাঃ পীযূষের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্কের বাইরেও তৈরি হলো নানা সম্পর্ক। এই সম্পর্কের বলে কমপক্ষে গত একযুগ ধরে আমরা দুজন একত্রে চাঁদপুরে কতো কাজই না করছি! এটি পর্যবেক্ষণ করে চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ্ব অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার আমি তো নয়ই, কারো কোনো দাবি বা চাহিদা ছাড়াই ডাঃ পীযূষকে করেছেন চাঁদপুর কণ্ঠের অন্যতম উপদেষ্টা। যেটি আপনত্বের মহিমায় আমার ও চাঁদপুর কণ্ঠের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অন্তর ছুঁয়েছে। শুধু কি তাই? তিনি আমাদের প্রিয় সংগঠন চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের অন্যতম উপদেষ্টা, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির অধ্যক্ষ, চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহ-সভাপতি এবং ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বাস্তবায়নযোগ্য পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার যুগপূর্তি আয়োজনের আহ্বায়ক। আরো কতো কিছুতে যে তিনি ও আমি একত্রে আছি, সেটা লিখতে গেলে তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার অনেক প্রমাণ মিলবে নিশ্চয়, তবে নিজেদের ঢোল নিজেরা পেটানোর অভিযোগ কিন্তু উঠবেই।
‘ডাঃ পীযূষ চাঁদপুরে সবার প্রিয়’ এটা আপাতত না বললেও অনেকের যে খুব প্রিয়, সেটা হলফ করে বলতে পারি। এটা তাঁর 'দুহাতে লিখা'র গুণে, বাগ্মিতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে হয়েছে--এটা সুধীজনমাত্রই অকপটে স্বীকার করেন। তাঁকে নিয়ে আমি চাঁদপুর কণ্ঠে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলাম। নি¤েœ সেটির উল্লেখযোগ্য অংশ পত্রস্থ করেই আমার এই লিখা শেষ করলাম। বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে অনেক বড়ো লিখার ইচ্ছা আছে আমার।
সম্পাদকীয় নিবন্ধটির শিরোনাম হয়েছে ‘উদ্যোগটি চাঁদপুরে প্রথম ও প্রশংসনীয়’। এতে আমি লিখেছি, গত ৭ জুলাই ২০২৩ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নারী সংগঠন ‘ইনার হুইলে’র চাঁদপুর শাখা (ইনার হুইল ক্লাব অব চাঁদপুর সেন্ট্রাল) একজন মেধাবী ও গুণী পুরুষকে সংবর্ধিত করে কম-বেশি তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সেই পুরুষটি হচ্ছেন ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, যাঁকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে এই সংগঠনটি সংবর্ধিত করেছে। এই সংবর্ধনার স্থান হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে চাঁদপুরের লেখকদের আবেগের জায়গা সাহিত্য একাডেমীকে।
চাঁদপুরের অনেক সংগঠন/প্রতিষ্ঠান স্থানীয়-অস্থানীয় লেখকদেরকে সংবর্ধনা/সম্মাননা দিয়েছে সাহিত্যের কোনো একটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ। কিন্তু সাহিত্যের অনেক ক্ষেত্রে কিংবা সাহিত্যের প্রায় সকল ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সব্যসাচী লেখক হিসেবে স্বীকৃতি বা সংবর্ধনা প্রদানের উদ্যোগ নেয়নি। অবশেষে সাহিত্য সংগঠন না হয়েও ইনার হুইল ক্লাব অব চাঁদপুর সেন্ট্রাল সে উদ্যোগ নিয়েছে। তারা চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী এবং বর্তমানে পেশাগত কারণে চাঁদপুরে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছে। কথা হলো, তারা কি সঠিক কাজটি করেছে?
আমাদের মতে, ইনার হুইল ক্লাব অব চাঁদপুর সেন্ট্রাল ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে সংবর্ধিত করে সঠিক, সময়োচিত, সাহসী ও প্রশংসনীয় কাজই শুধু করেনি, তারা চাঁদপুরে সর্বপ্রথম এই কাজটি করেছে। এটার অর্থমূল্য না থাকলেও ডাঃ পীযূষকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক অনেক উদ্দীপ্ত করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এটা অবশ্যই বলতে হবে যে, চাঁদপুরের ব্র্যান্ডিং বুক ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ সারাদেশের জেলাগুলোর ব্র্যান্ডিং বুকের মধ্যে ব্যতিক্রম হয়েছে ডাঃ পীযূষের সুখপাঠ্য ছড়ার কারণে এবং নিবন্ধগুলোর মানসম্মত ইংরেজি অনুবাদে সহযোগিতার কারণে। তিনি শুধু বাংলা নয়, ইংরেজিতে বলা ও লেখায় সাবলীল এবং পারদর্শী। তিনি ছড়াকার হিসেবে যেমন খ্যাত, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গান সহ সাহিত্যের বাকি ক্ষেত্রগুলোতেও পারদর্শী। তিনি একজন খ্যাতিমান বিতার্কিক, বিতর্ক বিষয়ক লেখক ও গ্রন্থকার, বিতর্ক সংগঠক ও অনলবর্ষী বক্তা। এবারের নজরুল জয়ন্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর আলোচনা সভায় তিনি চাঁদপুরে থেকেও প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং বিদগ্ধ শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। গণহত্যা বিষয়ক চাঁদপুরের নাটক ‘মধ্যরাতের মোলহেড’র অন্যতম রচয়িতা হিসেবে তিনি দর্শকদের কাঁদানোর মতো যে সংলাপ ও বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা এককথায় অসাধারণ। তিনি একজন গবেষক। তাঁর গবেষণামূলক নিবন্ধ ও গ্রন্থপাঠের মুগ্ধতা অনেক বেশি। তাঁর ব্যতিক্রম পর্যবেক্ষণ ও উদ্ভাবনী চিন্তায় সুস্পষ্ট হয় তাঁর মনীষা। কবিতা নিয়ে তাঁর যে পরীক্ষামূলক মুন্শিয়ানা, সেটাও কম কীসে! বর্তমানে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ২২টি। এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের কলেবর বিবেচনায় ডাঃ পীযূষের সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকলেও আমরা এটা অকপটে বলতে পারি যে, চাঁদপুরে তো বটেই, চট্টগ্রাম বিভাগে ডাঃ পীযূষের সমান্তরালে সব্যসাচী লেখকের সংখ্যা তৈরি করা কষ্টকর। এই বিদগ্ধ লেখকের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হবে ১০ অক্টোবর ২০২৩। তাঁর কাছ থেকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে চাঁদপুরসহ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং পুরো দেশবাসী আরো অনেক কিছু পাওয়ার আশা রাখে। সেজন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে সুস্থতার সাথে তাঁর দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করছি। তিনি দীর্ঘজীবী হলে ও সুস্থ থাকলে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা অর্ধশতাধিক হওয়াটা অস্বাভাবিক হবে না এবং তাঁর বক্তৃতা/ কথামালায় ঋদ্ধ হবে আমাদের দেশ ও সমাজ। আর অনেক বড় ধরনের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতিতে তিনি অবশ্যই উজ্জ্বল প্রতিভাসে নিজেকে ইতিহাসের পাতায় করবেন স্মরণীয় ও বরণীয়-এমনটি বললে অত্যুক্তি হবে না এবং আত্যন্তিক প্রত্যাশা করা হবে বলেও আমরা মনে করি না।
লেখক পরিচিতি : প্রধান সম্পাদক : দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; মহাপরিচালক (সাবেক) : সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর।