প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় অখ্যাত ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। সেই গ্রামেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বুধবার জন্মগ্রহণ করেছিলো এক শিশু। বাবা শেখ লুৎফুর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। সেই ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট খোকাই একদিন তার নিজ মেধা, কর্মদক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বের বড় সার্থকতা বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তায় সমৃদ্ধ করা। বিখ্যাত লেখক গ্যারী উইলস ১৯৯৪ সালে ‘দি আটলান্টিক মান্থলী’ পত্রিকায় ‘হোয়াট মেকস এ গুড লিডার’ প্রবন্ধে বলছেন যে, নেতৃত্বের যে বৃত্ত তার উপাদান ৩টি খবধফবৎ, ঋড়ষষড়বিৎং ্ এড়ধষং. নেতার প্রয়োজনীয় গুণাবলি হলো ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী ক্ষমতা, জনগণের সামনে স্পষ্ট এমন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যম ও উদ্যোগে নেতৃত্ব দেয়ার মতো নেতার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। এমন গুণাবলিসমৃদ্ধ নেতাকে ‘কারিশমা’সম্পন্ন নেতাও বলা হয়। একজন নেতা তখনই তার অনুসারীদের জন্যে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন যখন তিনি ত্রিকালদর্শী হন। অর্থাৎ নেতা অতীত সম্পর্কে অভিজ্ঞ, বর্তমানকে অনুধাবন করেন এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে পারেন।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী নেতৃত্বের মধ্যে উল্লেখিত সব উপাদান পরিলক্ষিত হয়। তাঁর নেতৃত্বের দুটো পর্ব আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ১ম পর্ব এবং ২য় পর্ব স্বাধীন বাংলাদেশ (১৯৭২-৭৫)। ১ম পর্বে ছিলো স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম। আর ২য় পর্বে ছিলো অত্যন্ত কঠিন ও বৈরী পরিস্থিতিতে দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভে শেরে বাংলা এ.কে.এম. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেকের নাম স্মরণীয়। এঁদের কাছে বঙ্গবন্ধুরও ঋণ ছিলো অপরিসীম। তবে অনস্বীকার্য যে, চূড়ান্ত মুহূর্তে বাঙালি জাতির নেতৃত্বের কর্ণধার ছিলেন শেখ মুজিবই। আর সে কারণেই তিনি মুজিব থেকে মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতার পদ অলকৃত করেছিলেন।
রাজনৈতিক ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার নিপুণ রূপকার স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পল্লীকবি জসিমউদ্দীন তাঁর বিখ্যাত কবিতায় মুজিবের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে বলেছেন, ‘রাজ ভয় আর কারা শৃঙ্খল হেলায় করেছে জয়/ফাঁসির মঞ্চে মহত্ত্ব তব তখনো হয়নি ক্ষয়। বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ/প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত তাজ।’ মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ২৫ মার্চ ৭১ হানাদার পাকিস্তানীরা তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলে এই মুজিবের নামেই বাংলার মুক্তিপাগল বীর সন্তানেরা ৯টি মাস দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিলো। পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ তাঁরই দিকনির্দেশনায় এবং নামে পরিচালিত হয়। তিনিই প্রথম বাঙালি সরকারপ্রধান যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন।
বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করায় এবং এর ভিত্তিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মুজিব বাঙালি জাতির ইতিহাসে ‘জাতির পিতা’ রূপে অমর হয়ে থাকবেন। তিনিই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ও প্রাণপ্রদীপ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে কপর্দকহীন হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করা, শহীদ পরিবার, আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাসহ এক কোটি ভারত প্রত্যাগত বাঙালি শরণার্থীর পুনর্বাসিত করে যখন ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ডাক দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডি রোডস্থ ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের ইশারায় বিশ্বাস ঘাতক স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় সেনা কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করে। আবারো একবার বাংলার মাটিতে রচিত হলো বেঈমানির নির্লজ্জ ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার সাথে ক্ষমতার লোভে নবাব হবার আশায় বেঈমানী করেছিলো তারই সেনাপতি ও পরম আত্মীয় মীর জাফর আলী খান। ১৯৭৫ সালে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো রাষ্ট্রপতি হবার খায়েশে মুজিবের রাজনৈতিক সহচর, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্য কুমিল্লার খন্দকার মোশতাক। উভয়ের পরিণতি বাংলার মানুষ দেখেছে। বিশ্বাস হত্যাকারীর আত্মীয়-স্বজনও আজ তাদের স্মরণ করে না। উভয়ের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলো স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। স্বাভাবিক মৃত্যু ও দাফন তাদের ভাগ্যেও জোটেনি। তাদের উভয়ের সাঙ্গপাঙ্গরা আমৃত্যু পলাতক ও নিন্দিত জীবন যাপন করেছেন। অধিকাংশ সাঙ্গপাঙ্গ লাভ করেছে অভিশপ্ত মৃত্যুর স্বাদ। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিরকাল বেঁচে থাকবেন ৫৫ হাজার বর্গমাইলের সবুজ-শ্যামল এ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাটি ও মানুষের হৃদয়ে।
বাংলাদেশের মতোই শাশ্বত চিরায়ত ও দেদীপ্যমান বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সকল দুরভিসন্ধি আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আজ মানুষ বুঝতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চাভিলাষী ধ্যানধারণা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। বাংলাদেশকে মুছে ফেলতে না পারলেও কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার সকল দুরভিসন্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানী চক্র এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের গোপন আঁতাত, যেটি আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ঝড়সব ঢ়বড়ঢ়ষব পধহ নব ভড়ড়ষবফ ভড়ৎ ংড়সব ঃরসব, নঁঃ ধষষ ঢ়বড়ঢ়ষব পধহ হড়ঃ নব ভড়ড়ষবফ ভড়ৎ ধষষ ঃরসব (কিছু সময়ের জন্য কিছু লোককে হয়তো বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব লোককে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না)। তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চাভিলাষী ধ্যানধারণা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। সূর্য অস্তমিত হলেই তারপর জোনাকিরা জ্বলে। কিন্তু জোনাকিরা কখনোই সূর্যের বিকল্প হতে পারে না। যতোই দিন যাচ্ছে এ সত্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব-অমর। তাই তো কবি অন্নদা শঙ্কর রায় বলেছেন, ‘যতোদিন রবে পদ্মা, মেঘনা/গৌরি যমুনা বহমান/ততোদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবর রহমান’।
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : পরিচালক, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মোবাইল ফোন : ০১৮১১-৪৫৮৫০৭