প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
যে মেয়েটি কম্পিউটারকে ভয় পেতো, যে মেয়েটিকে পিছিয়ে দেয়ার জন্যে ছেলেরা কম্পিউটার সায়েন্স নিতো, আর যে মেয়েটিকে বিজ্ঞানের আধুুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা হতো না, সেই মেয়েটিই কি না এক সময় হয়ে উঠে গুগলের একদল তথ্য-প্রযুক্তির কর্মীর বস। যার বেতন আজ আকাশছোঁয়া। সেই নারীর নাম তাব্রিজ। আমাদের দেশে হলে আমরা তাকে ‘তাবিজ’ বলে ডাকতাম!
আমি যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি, ছোটবেলায় দেখেছি, আমার বোনকে পড়াশোনা না করানোর জন্যে আত্মীয়-স্বজন আমার বাবাকে উৎসাহিত করতো। বলতো, মেয়েরা তো স্বামীর ডেকচি আলো করবে, তাকে পড়ানোর দরকার কী? আমার সেই বোন আজ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক হয়ে কুয়েতের মতো দেশে বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য সামলিয়ে কানাডায় সন্তানসহ বেশ সুখে আছেন।
তো উদাহারণটি টানলাম এজন্যে যে, বাংলাদেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন কিছু মানুষের মন-মানসিকতা এখনও সেকেলে। এখনও তারা ভূতপ্রেত, দৈত্যদানো নিয়ে, তাবিজ-কবজ নিয়ে পড়ে আছে। আর অন্যদিকে উন্নত দেশের নারীরা আজ তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠেছে সাহসিকতার এক উদাহরণ। এমনই এক নারী পারিসা তাব্রিজ। যার সাহসিকতার গল্প আজ আপনাদেরকে শোনাবো।
হ্যাকিং দুনিয়ায় তাব্রিজকে তুলনা করা যায় গ্লিন্ডার সাথে, যে ছিলো ভালো এক সাহসিনী। বলা যায় যে, সব ধরনের ক্ষমতা, দক্ষতা, শক্তিশালী বাহিনী সাথে থাকা সত্ত্বেও সে কারো ক্ষতি করে না। একদল হ্যাকার ইঞ্জিনিয়ারের কর্তৃত্বে থাকা তাব্রিজকে বেতন দেয়া হয় অপরাধীদের মতো চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে, গুগল ক্রোমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার জন্যে। অন্য কেউ হ্যাক করার আগে সর্বাধিক ব্যবহৃত ইন্টারনেট ব্রাউজারের কোন্ কোন্ অংশ হ্যাক করা করা যায় তা শনাক্ত করার জন্যেই বেতন দেয়া হয় তাকে।
মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাব্রিজ হয়ে উঠেছে হ্যাকিং সার্কেলের দুর্লভ এক নারী এবং হ্যাকিং সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করতে অগ্রগামী এক তারকা।
তাকে বলা হয় গুগলের গোপন অস্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠা পোলিশ-আমেরিকান-ইরানি মেয়েটি হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের একটি দল পরিচালনা করছে, যাদের প্রধান কাজ ‘ব্যাড গাই’ হিসেবে পরিচিত ব্ল্যাক হ্যাটদের মোকাবিলা করা। ব্ল্যাক হ্যাটরা ইন্টারনেট থেকে অন্যের তথ্য চুরি করে, ওয়েবসাইট বা আইডি হ্যাক করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে, তাদের ঠেকানোই হোয়াইট হ্যাটের কাজ। গুগল ক্রোমের প্রায় এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীর তথ্য অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কাজ করছে পারিসা তাব্রিজ আর তার দল।
মেয়েরা নাকি প্রযুক্তির খুঁটিনাটি বোঝে না, তথাকথিত এই ভুল ধারণাটিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৩০ সদস্যের একটি পুরুষপ্রধান দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাব্রিজ। তাব্রিজের দেখাদেখি বর্তমানে সিলিকন ভ্যালিতে আরও অনেক নারী সদস্য যোগদান করছে। এ বছর প্রথমবারের মতো গুগল তাদের কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সে অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি ১০০ জন কর্মীর মধ্যে ৩০ জন নারী সদস্য রয়েছে।
তাব্রিজ বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে নারীদের এমন বিপুল অংশগ্রহণ কেবল আইন আর চিকিৎসাক্ষেত্রেই দেখা যেতো, এই পরিবর্তন শুভ বলেই মনে হচ্ছে।
২০০৭ সালে গুগলে যোগ দেয়ার পর থেকে কখনো নেতিবাচক লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গির হামলার শিকার হতে হয়নি তার। তবে গুগলের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরপরই কলেজের এক বন্ধু মুখের উপর বলেছিলো, মনে রেখো, শুধুমাত্র মেয়ে বলেই চাকরিটা তোমাকে দিচ্ছে। তবে তাব্রিজ সাবলীল ভাষায় জানান, যারা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে, কেবলমাত্র তাদের মুখ থেকেই এমন বাক্য বের হওয়া সম্ভব।
পারিসা তাব্রিজ তার সাহসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। প্রচণ্ড ধৈর্যশক্তি ও কর্মস্পৃহায় মানুষের বাক্যবাণ তাকে দমাতে পারেনি। তিনি ২০১২ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের ৩০ বছরের কম বয়সী শীর্ষ ক্ষমতাধারী ৩০ নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, প্রযুক্তির জগতে মেয়েদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ মেয়েরা নিজেরাই। তিনি বলেন, এক বছর আগে একটি গবেষণায় ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞেস করা হয়, কম্পিউটার কোর্স না নেয়ার পেছনে তাদের কারণ কী। সেই গবেষণা থেকে উঠে আসে, মেয়েরা বি মাইনাস গ্রেড পাওয়ার পরেও ব্যক্তিগত ভীতির কারণে পরবর্তীতে আর কোনো মেয়েকে এই কোর্স নিতে উৎসাহিত করেনি। আর সেখানে ছেলেরা সি গ্রেড পেয়েও বিষয়টিকে মজার মনে করে কোর্স চালিয়ে গেছে। মজা আর ভয়ের অনুভূতিগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। কোনো জিনিসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে সেখানে আপনি ভালো করতে বাধ্য।
জীবনে কোনোদিন কম্পিউটার ছুঁয়ে না দেখা মেয়েটি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বেছে নেয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। জন ড্র্যাপারের, ক্যাপ্টেন ক্রাঞ্চ হিসেবেই যিনি সুপরিচিত, গল্প শুনে দারুণ উদ্দীপ্ত হয়েছিল সে। ড্র্যাপার ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে কাজ করতেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর রাডার টেকনিশিয়ান হিসেবে। কাপ এন্ড ক্রাঞ্চ কর্ন ফ্লেক্সের প্যাকেটের ভেতরে একটি খেলনার সাহায্যে বিনামূল্যে লং-ডিসটেন্স কল করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। এর মাধ্যমে এমন জোরে বাঁশি বেজে উঠতো যে, তা তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ফোন নেটওয়ার্ককেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো!
পারিসা তাব্রিজ প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়কে একজন সাধারণ অপরাধীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা রাখে। ‘ব্যাড গাই’দের মনের ভেতর থেকে ঘুরে এসে গুগল ইঞ্জিনিয়ারদের খামতি সম্পর্কে অবগত করে সেই ভুলগুলো সংশোধন করাই তাদের প্রধান কাজ। সেমিনারগুলোতে তাব্রিজ প্রথমেই সবাইকে পরামর্শ দেয় অপরাধ বন্ধ করার জন্য প্রথমে অপরাধীদের মতো করে চিন্তা করার মানসিকতা তৈরি করতে। গুগলের কাজের পরিবেশটাই এমন রোমাঞ্চকর, যে কেউ এখানে সম্পূর্ণ মেধা আর মনন প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে। যে ঘরে তাব্রিজদের কনফারেন্স হয়, সেটি সাত সিটের একটি বাইকের আকৃতিতে তৈরি। চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে রয়েছে ‘থিংকিং জোন’!
প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত গুগলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্যের নীতি হলো শত্রুদের কখনো চোখের আড়াল হতে দেয়া যাবে না। কাজেই গুগল ক্রোমের বাগ বা অন্য কোনো ভুলচুক ধরিয়ে দিতে পারলে হ্যাকারদের নগদ ৩০ হাজার ডলার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে পারিস। সেই সূত্র ধরে ইতোমধ্যে প্রায় ৭০০ বাগের বিনিময়ে ১.২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে গুগলের। তাব্রিজের কথা হলো, এই ব্ল্যাক হ্যাটদের যদি হোয়াইট হ্যাটে পরিণত করা যায়, তাহলে তা অনলাইন দুনিয়ার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। তাব্রিজ তাদেরকে নিজের পাশে চায়, বিপরীতে নয়।
প্রতিদিন সবার অনলাইন জগতের নিরাপত্তার জন্যে শত-সহস্র বিনিদ্র রজনী উৎসর্গ করা তাব্রিজ তথ্যপ্রযুক্তির জগতে মানুষের মঙ্গলের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই অনলাইন জগত নিরাপদ রাখতে চান আর মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে চান। আজকের নারীরা তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এগিয়ে যাবে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের কল্যাণে-এই কামনা করছি।
তথ্যসূত্র : গুগল, রোয়ার মিডিয়া।