শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২১, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ
অনলাইন ডেস্ক

পর্ব-২১

এ পেশায় এসে যেটা প্রকটভাবে অনুধাবন করলাম তা হলো শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার অভাব। যা আমাকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করে। শিক্ষক মানেই আমি কল্পনা করি একজন হিতকর মানুষ। যিনি প্রতিটি মুহূর্ত ছাত্রের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করবেন। ছাত্র হবে তার সন্তানতুল্য। শিক্ষকের কাছে প্রতিনিয়ত নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শিরোনামের এই কবিতাটি জানেন না এমন পাঠক বিরল। কবিতাটির রচয়িতা কবি কাজী কাদের নেওয়াজ। দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়ানোর দায়িত্ব ছিল একজন শিক্ষকের ওপরে। একদিন বাদশাহ দেখতে গেলেন পুত্র কেমন শিক্ষা লাভ করছে। দেখলেন, বাদশাহ-পুত্র শিক্ষকের চরণে পানি ঢালছে। শিক্ষক তার চরণ ধুয়ে মুছে সাফ করছেন নিজ হাতে। বাদশাহকে দেখে শিক্ষক ভাবলেন, দিল্লীপতির পুত্রের হাতে সেবা নিয়েছি, আজ আর তার নিস্তার নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই শিক্ষকের মনে হলো : ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার/দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার, /ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল/বাদশাহ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।’ কিন্তু শিক্ষককে তা আর শোনাতে হয়নি। ‘বাদশাহ-পুত্র শিক্ষাগুরুর চরণে পানি ঢেলেছে, কিন্তু নিজ হাতে চরণ ধুয়ে দেয়নি বলে বাদশাহ কষ্ট পেয়েছেন। ‘বাদশা বলিলেন নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন, পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ। ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।’ শিক্ষক উচ্ছ্বাসভরে বলেছেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ এই কবিতার মাধ্যমে কবি কাদের নেওয়াজ শিক্ষকের মর্যাদাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কবি নিজেও একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন।

এ কবিতাটি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। বুঝে হোক না বুঝে হোক পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামক কবিতাটি। যে কবিতা আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের আচরণ কেমন হওয়া উচিত। এই কবিতা আমাদের শিখিয়েছে, পানি ঢেলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেওয়া মর্যাদার। এমন শিক্ষণীয় একটি কবিতা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হলো কোন্ বিবেচনায়? এই কবিতায় না আছে কোনো রাজনীতি, না আছে ধর্মীয় উগ্রবাদ। জানি না কেন ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই প্রজন্মকে। যুক্তি যাই থাকুক, শিক্ষক ভক্তির এই গুরুত্বপূর্ণ গল্পটা অজানাই থেকে যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে। এ ধরনের নৈতিক শিক্ষা আজ বাচ্চাদের দেয়া যাচ্ছে না বলে ছাত্র দ্বারা শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এমন কবিতা বারবার উচ্চারণের প্রয়োজন বোধ করি।

কেবল ‘শিক্ষাগুরুর ভক্তি’ই বাদ যায় নি। পাঠ্যবই থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে কবি কালিদাসের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটিও। যে কবিতায় আমরা শিখেছিলাম কী করে মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে গভীর রাতে বহুদূর থেকে হলেও পানি আনতে হয়। কী করে ঘুমন্ত মাকে না জাগিয়ে পানির পেয়ালা হাতে নিয়ে তাঁর শিয়রে সকাল অবধি দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বায়েজিদ বোস্তামী ছিলেন একজন সুফি সাধক। শৈশবে মায়ের প্রতি তাঁর ভক্তি-আদর্শ নিয়ে লেখা এই কবিতা কেন বাদ দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। এই কবিতায় রাজনীতি নেই, কোনো ধর্মীয় চেতনার পক্ষপাতিত্বও নেই। বাদ দেয়ার কারণ যাই হোক, এমন অনন্য একটি কবিতার মধ্য দিয়ে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কর্তব্য শিক্ষা নেয়ার সুযোগ থেকে কয়েকটি প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে।

মানুষের মধ্যে সততার বিস্তার ঘটাতে চাইলে ছেলেবেলা থেকেই সেই শিক্ষা দিতে হয়। তাই তো ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচিত ‘সততার পুরস্কার’ নামে একটি গল্প ছিল। যেখানে আমরা শিক্ষা পেয়েছি সততা রক্ষা করে চললে তার পুরস্কার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই গল্পটিও বাদ দেয়া হয়েছে। স্থান, কাল, পাত্র যাই হোক; সততার গল্পগুলো যদি শৈশব থেকেই শোনানো না হয়, তাহলে সমাজে ভালো মানুষ গড়ে উঠবে কীভাবে? শিক্ষণীয় যেকোনো কিছুই মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরি করে। সাম্প্রতিককালে পাঠ্যবই থেকে বিভিন্ন গল্প-কবিতা তুলে দেয়ার ধরণ দেখে লালনের বাণীই মনে পড়ে, ‘জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা...’।

ভালো মানুষ গড়ে তুলতে চাইলে ব্যক্তির মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করা খুবই জরুরি। সে কারণে নবম শ্রেণির বইয়ে আমাদের পড়ানো হয়েছে আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’। কিন্তু প্রত্যেক বাঙালির মনে গেঁথে যাওয়া দেশপ্রেমের এই অনন্য কবিতাটিও পাঠ্যপুস্তক থেকে বিদায় করা হয়েছে।

শিশুরা কাদা মাটির মত। শৈশবে তাদের মনোজগতে যা স্থান করে নেয় যৌবনে এবং বার্ধক্যে তা-ই প্রতিফলিত হবে। কিন্তু শিক্ষকতা করতে এসে যা দেখলাম, এই নৈতিকতাগুলোর বড়ই অভাব ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। ছাত্র শিক্ষকের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা বড়ই নড়বড়ে। এই যে আজ আমরা সমাজে কিশোর গ্যাং নামের এক নতুন উপদ্রব দেখতে পাই, এগুলো কি বাচ্চাদের নৈতিক শিক্ষার অভাবের প্রতিফলন নয় কি?

আমরা ছোটবেলায় সতীনাথ বসাকের আদর্শলিপি পড়ে বড় হয়েছি। কী অসাধারণ কথাগুলো ছিল। অ তে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর। আ তে আলস্য দোষের আকর। আরো পড়েছি মদনমোহন তর্কালঙ্কার-এর ‘আমার পণ’

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, /সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।

আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, /আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।

সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,/মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।

সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি, /কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিই ফাঁকি।

শিশুরা জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আমরা কি শিশুকে জীবনবোধ শিক্ষা দিতে পারছি ?

সমালোচনার মাঝে শিশু বেড়ে উঠলে /সে নিন্দা করতে শেখে।

শত্রুতার মাঝে শিশু বেড়ে উঠলে/ সে হানাহানি করতে শেখে।

ধৈর্যের মাঝে শিশু বেড়ে উঠলে/ সে সহিষ্ণুতা শেখে।

প্রশংসার মাঝে শিশু বেড়ে উঠলে/ সে তার মূল্য দিতে শেখে।

সমতার মাঝে শিশু বেড়ে উঠলে/ সে ন্যায়পরায়ণতা শেখে।

স্বীকৃতি আর বন্ধুত্বের মাঝে বেড়ে উঠলে/ সে শিশু পৃথিবীতে ভালোবাসা খুঁজে পেতে শেখে।

ডিজিটাল যুগে এসে আমরা শিশুদের কী শিখাচ্ছি? কী শিক্ষা দিচ্ছি। শিশুরা তার পরিবার থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো কি শিশুদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারছে ? মা তার বাচ্চাকে টিফিন দিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে। বাচ্চা সেই টিফিন বন্ধুরা সহ ভাগ করে খেয়েছে। পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় মা সন্তানকে বকুনি দিয়ে বলেছেন, তুমি একা খাবে। অন্য কাউকে দিবে না। এইতো আমাদের শিক্ষা দেয়া। শিক্ষার ভিতটা গড়ে উঠে ছোটবেলায় । যে শিক্ষা তাকে মানুষ করে তোলে। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো বারবার সে শিক্ষা দিতেই ব্যর্থ হয়েছে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়