প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২১, ০০:০০
‘আমার নিজ গ্রাম কচুয়া উপজেলার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী পরিবার লুন্তি নোয়া-বাড়িতে বীর শহীদ সফিউল্লার জন্ম। তিনি ছিলেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের একজন হোটেল ব্যবসায়ী। ১৯৭১-এ পাক-বাহিনীর অত্যাচারে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে আসেন। ৬ ফুট উচ্চতার সুঠাম দেহের অধিকারী সফিউল্লার সাহসী ভূমিকার জন্য সকলে ছিল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’ ‘অতীতকে জানবো, আগামীকে গড়বো’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের এমনি স্মৃতিবহ বহু ঘটনার কথা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ব্যুরো ইনচার্জ মোহাম্মদ মহিউদ্দিনকে জানিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আনোয়ার হোসেন সিকদার।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গ্রাম বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এবং ঘর-বাড়ি ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতে ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। অজানা অচেনা পথ পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি জমানোর মানুষগুলোকে পথের দিশা দেয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় দুঃসাহসী সফিউল্লাকে। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, কচুয়া ও বরুড়া নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচিত এমএনএ অ্যাডভোকেট আঃ আউয়ালের পরামর্শে এমএ রশিদ প্রধান অবাধে চলার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বাক্ষর ও সীলমহর যুক্ত একটি পরিচিতিপত্র সফিউল্লাকে প্রদান করেন। এর অনুকূলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তার স্থায়ী পরিচয়ের জন্য পায়ের হাঁটুর উপরে রানের মধ্যে একটি সীল মোহর মেরে দিয়েছিল। সর্বদা মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেবামূলক কাজে সফিউল্লাহ বাংলাদেশের ভিতরে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতেন। ৬ জুলাই ১৯৭১ খান সেনাদের দালাল রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে জল্লাদ বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সামরিক জান্তার পৈচাশিক ও বর্বরোচিত নির্যাতনে সফিউল্লাহ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহটি টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে উঠানোর সময় তিনি ‘পানি পানি’ বলে জিহ্বা বের করার চেষ্টা করেন। ইয়াজিদের দল পানি না দিয়ে পিপাসার যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা সফিউল্লাকে গালি-গালাজ করে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং তাকে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ব্যথা আর যন্ত্রণায় ছেলেকে রক্তাক্ত যখম ও মুমূর্ষ অবস্থায় দেখে সফিউল্লার বাবা কচুয়া বাজারের ব্যবসায়ী মরহুম ইসহাক মিয়া বুকভরা কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি করেছিলেন। খবর নিয়ে জানা যায়, পাক সেনারা সফিউল্লাকে চাঁদপুরে নিয়ে টর্চার সেলে রেখেছিল। পরদিন তার বাবা তার জন্য ওষুধ ও জামাকাপড় নিয়ে চাঁদপুরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিল। বহু দরজায় গিয়েও ছেলের হদিস মিলেনি। অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি জানান, সফিউল্লাসহ কয়েক ব্যক্তির লাশ বস্তাবন্দি করে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বাবা জানালেন, ‘আমার বুকের ধন, মানিক রতন সফিউল্লার ভাগ্যে দাফন কাফনও বুঝি জুটেনি।’
আনোয়ার হোসেন সিকদার জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে সেদিন সফিউল্লার বাড়ির মৌঃ আঃ রব, ভূমি মন্ত্রণালয় ও দুদকের সাবেক সচিব মরহুম দেলোয়ার হোসেন, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজসেবক খোরশেদ আলম মন্নান, কচুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আমার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি আবু তাহের, বিমানের সাবেক সিবিএ নেতা মিজানুর রহমানের ভাই আমার কমিটির দপ্তর সম্পাদক মরহুম মুজিবুর রহমান, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা নুরুল ইসলামসহ সে বাড়ির অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন। একই বাড়ির সেনাবাহিনীর আর্টিলারী (অবঃ) হুমায়ন মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সীমান্তের সালদা নদীতে মরণপণ যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন। এ যুদ্ধে সালদা নদীর পানি বাংলার মানুষের রক্তে লালে লাল হয়েছিল। আমার লুন্তি গ্রামের সাবেক বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা যিনি কচুয়া হাই স্কুল মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছিলেন, সিরাজুল ইসলাম এবং আর্টিলারি হুমায়ন মিয়া এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারেননি। আমি আনোয়ার হোসেন সিকদারের সাথে আমার গ্রামের গর্বিত বীর শহীদ সফিউল্লার সাথে ভারতে দেখা হতো। ১৯৭১-এর জুন মাসের শেষার্ধে ত্রিপুরা রাজ্যের মহাকুমা সদর সোনামুড়া ফকির বাড়িতে তাঁর সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি বক্সনগর, মতিনগর, হাতিমারা, কাঠালিয়া, বড়মুড়া, পদ্মনগর, পালাটোনা, কাকড়াবন এবং মেলাঘরের বিভিন্ন যুব-শিবির এবং শরণার্থী শিবিরে অবাধে বিচরণ করতেন সফিউল্লাহ্ ভাই।
তিনি আরো জানান, কচুয়া উপজেলার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও কচুয়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম শামছুল আলম সিকদার, মরহুম সিরাজুল ইসলাম সিকদার এবং নোয়াবাড়ির মরহুম আব্দুল হক সওদাগর টাকা-পয়সা দিয়ে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। আমার ছোট ভাই সরকারি কলেজের অধ্যাপক (অবঃ) আলহাজ্ব মোঃ আজহারুল হক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যাবতীয় খবর সংগ্রহ করে আমাদের জানাতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে দিতেন। কচুয়া-কালিয়াপাড়া তৎকালীন কচুয়ার একমাত্র পাকা রাস্তায় লুন্তি খন্দকার বাড়ির দক্ষিণ পাশে ট্রেন্স কেটে এবং বিভিন্নভাবে ব্যারিকেড তৈরি করে খান সেনাদের কচুয়ায় আসতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করাসহ বিভিন্ন কারণে গ্রামটির উপর বহু ঝড় বয়ে যায়। সর্বশেষ ৬ ডিসেম্বর কচুয়া মুক্ত দিবসে ভোর রাতে আমার (সিকদার) বাড়ির সামনে হানাদার বাহিনীর বিশাল গাড়ি বহর রেখে আমার (সিকদার) বাড়ি, নোয়াবাড়ি, মৃধা বাড়ি, মুহুরী বাড়ি এবং খন্দকার বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে গ্রামটি ঘেরাও করে ফেলে। রাজাকারদের পরামর্শে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেওয়ার পূর্ব পরিকল্পনা থাকলেও রাজাকার কমান্ডার খালেক রাজাকার বাহিনী নিয়ে ভিন্নপথে পালিয়ে যাওয়ার কারণে আল্লাহর রহমতে গ্রামটি সেদিন রক্ষা পায়। গ্রামের পুরুষ-মহিলারা সবকিছু ফেলে রেখে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কচুয়ার মুক্তিযোদ্ধারা পাক-বাহিনীকে আক্রমণের পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলেও তারা টের পেয়ে যায় এবং পলায়ন করে।
তিনি বলেন, আমার গ্রামের এই বীর শহীদ সফিউল্লার স্মৃতিকে অম্লান করার জন্য ও তাঁকে স্মরণীয় বরণীয় করার জন্য তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি এবং তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।